বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের জন্মদিন ছিল নয় ডিসেম্বর। এইদিন একটি অনলাইন পত্রিকায় বেগম রোকেয়ার উপর লিখিত এক নিবন্ধের কমেন্ট সেকশনে এদেশেরই একদল মানুষের প্রচণ্ড নারী বিদ্বেষের যে চিত্র ফুটে উঠেছে তা ভয়াবহ। বাঙালির আধুনিক যুগের ইতিহাসে যে-নারীর নাম গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয় সেই নাম হচ্ছে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। বাঙালি সমাজ যখন ধর্মীয় প্রতিবন্ধকতা আর সামাজিক কুসংস্কারে আচ্ছন্ন ছিল, সেই সময় বেগম রোকেয়া বাংলার মুসলিম নারী সমাজে শিক্ষার আলো নিয়ে এসেছিলেন। বাঙালি মুসলমান নারী জাগরণের তিনি ছিলেন অন্যতম একজন পথিকৃৎ। স্বাধীন সার্বভৌম এই দেশে নারী অগ্রযাত্রার যে-স্বপ্ন দেখা হয়েছিল সবসময় তাঁর তীব্র বিরোধিতা করে গেছে একদল মানুষ। এই গোষ্ঠী নীরবে ডালপালা মেলতে মেলতে আজ বিশাল মহিরুহে পরিণত হয়েছে। আগে যা ছিল গোপন মানসিকতায় তা আজ প্রকাশ্য।
নারী অগ্রযাত্রার পথিকৃত বেগম রোকেয়া শতবছর আগে নারীদের বিশেষ করে মুসলিম নারীদের মুক্তির জন্য বেশিকিছু না, তাদের পড়ালেখা শেখা এবং ঘরের বাহির হওয়ার উপর জোর দিয়েছিলেন। সে দিনের সেই শুরুটার পর হাজার ঝড়-ঝাপটা ঠেলে ধীরে ধীরে নারী এগিয়েছে সামনে। যে সংগ্রাম বেগম রোকেয়া শুরু করেছিলেন গুটি গুটি পায়ে তা সাফল্যের মুখ দেখে। সকল ক্ষেত্রে নারীর সফল পদচারণার যে বীজ তিনি বোপন করেছিলেন বহু বছর আগে, তা আজ অনেক বিস্তৃত। নারীরা কাজ করছে সকল ক্ষেত্রে। নারীর পরিস্ফুটনের এই দৃশ্য কখনই সহজ চোখে দেখেনি পুরুষতান্ত্রিক ভূত।
বিগত এক দশকে উগ্র মৌলবাদের উত্থান খুব স্পষ্ট। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ক্রমশ এটা প্রকট হয়ে উঠছে। পার্শ্ববর্তী দেশেও হিন্দু মৌলবাদ ইতিহাসের সকল মাত্রাকে অতিক্রম করেছে। ধর্মীয় অনুশাসন সবসময় নারীর অগ্রযাত্রায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মিসোজিনি বা নারী বিদ্বেষ থেকেই নারীকে দমিত করার প্রবণতা রয়েছে সকল ধর্মেই । নারীর স্বাধীনভাবে চিন্তার শক্তিকে তাই পুরুষতান্ত্রিক ধর্ম ব্যবস্থা কঠোর হাতে দমনের ব্যবস্থা করেছে। এই গোষ্ঠী ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়ে হয়েছে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায়। নারী অবমাননা যেন তাদের প্রকাশ্য অধিকার।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সকল শ্রেণির মানুষের উপস্থিতি সহজ হওয়ায় পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা দিন দিন স্পষ্ট এবং প্রকট হয়ে উঠছে। নারীকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে শত বছরের প্রচেষ্টা উগ্র মৌলবাদের কারণে একদশকেই পিছিয়ে গেছে শত বছরের আগের অবস্থায় বা তারও পেছনে। মারাত্মক সাইবার বুলিং এর শিকার হচ্ছে নারী। বেগম রোকেয়াও এর থেকে মুক্তি পাননি। নোংরা ভাষায় তাকে আক্রমণ করেছে ঘৃণ্য পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার একবিংশ শতাব্দীর মানুষ। নারী বিদ্বেষ তাদের এতো প্রকট যে তারা ঘৃণতম ভাষা প্রয়োগেও পিছপা হয়নি।
বেগম রোকেয়ার অপরাধ তিনি নারীদের ঘরের বাহির করেছেন, তাদের আলোকিত হতে বলেছেন শিক্ষার আলোয়। তাঁর এই অপরাধের বিচার করছে বিজ্ঞানের আলোয় আলোকিত একবিংশ শতাব্দীর উঠানে বসে ঘৃণ্য নারী বিদ্বেষের পোকায় খাওয়া মানসিকতা। তাদের সুরক্ষিত সমাজের প্রভূত ক্ষতি সাধন করেছেন বেগম রোকেয়া তাই তিনি আজ বিচারের কাঠগোড়ায়। নারীকে পুনরায় ঘরে আবদ্ধ করলেই কেবল সমাজ রক্ষা হয় তাদের।
নারীর শিক্ষাগ্রহণ, নারীর মুক্তজীবনে চলাফেরা এবং তাদের স্বাধীন চিন্তা- চেতনার অধিকার, কাজের অধিকার এই বিষয়গুলো যে নারী মুক্তির সাথে সাথে সমাজের সার্বিক উন্নয়নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেসব কথা বেগম রোকেয়া সারা জীবন বলে এসেছেন। এই মহীয়সী নারী সমাজের ক্ষতি নয় বরং নিজের আরামের জীবন বিসর্জন দিয়ে সমাজের কল্যাণ করেছেন। তাঁর দূরদর্শী চিন্তা প্রশস্ত করেছে মানবজাতির কল্যাণের পথ। একটা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মানব কল্যাণের পথকে বিপরীত দিকে ঘুরানোর ঘৃণ্য প্রচেষ্টা কখনই ভালো কিছু বয়ে আনবে না।