চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী ও দৃষ্টিনন্দন বর্মী–বাংলা স্থাপত্যে মিলিত কৌশলে ১৯১৩ সালে ব্রিটিশ শাসনামলে নির্মিত সার্কিট হাউস ভবন এবং তৎসংলগ্ন উম্মুক্ত প্রাঙ্গণ (প্রায়৩.৮৯ একর) দেশের ইতিহাসের প্রত্যক্ষদর্শী এবং ঐতিহ্য বহন করে। চারপাশে অবাঞ্ছিত সব নির্মাণে প্রায় ঢাকা পড়ে গেছে এই নান্দনিক স্থাপত্যকর্ম, নষ্ট হয়ে গেছে এর চারপাশের পরিকল্পিত ভূদৃশ্য। পুরাতন সার্কিট হাউসের পাশে তারই আদলে নতুন সার্কিট হাউস হয়েছে। দুই সার্কিট হাউজের সীমানায় এই ঐতিহাসিক মাঠ।
এক অর্বাচীন সিদ্ধান্তে সাধারণ জনগণের ব্যবহতি বহুদিনের এই সবুজ ঐতিহাসিক মাঠ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আগ্রহে ১৯৯২ সালে ১৩ জুলাই এই মাঠে শিশুপার্ক স্থাপনে নগর সংস্থাটিকে অনাপত্তি দিয়েছিল প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়।
পরে ১৯৯৪ সালে ঢাকার প্রতিষ্ঠান ‘ভায়া মিডিয়া বিজনেস সার্ভিসেস লিমিটেড’কে ২৫ বছরের জন্য জমিটি প্রথমবার ইজারা দিয়েছিল সিটি কর্পোরেশন। ২০১৯ সালের নভেম্বরে ওই ইজারার মেয়াদ শেষ হয়। এরপর আবারও ২০২০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি একই প্রতিষ্ঠানের সাথে ১৫ বছরের চুক্তি নবায়ন করে নগর সংস্থা।
এরই ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রামের বিভিন্ন পরিবেশ সংগঠন, সুশীল সমাজ ও স্থানীয় মানুষের দাবিতে ২০২১ সালের ৯ মে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি, স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব এবং চট্টগ্রামের মেয়রকে চিঠি দিয়ে ‘চিটাগাং শিশু পার্ক’ নামের পার্কটির ইজারা বাতিলের অনুরোধ করেন এবং পরবর্তীতে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে এই মাঠটি বুঝিয়ে দেওয়া হয়।
বর্তমানে আবারও এই ঐতিহাসিক উন্মুক্ত ময়দানে দেওয়াল তুলে দেওয়া হয়েছে।
চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজ সংলগ্ন এই প্রাঙ্গণ যুগ যুগ ধরে নগরবাসীর সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনে একটি উন্মুক্ত ও সবুজ নাগরিক কেন্দ্রের সুবিধা দিয়ে এসেছে। চত্বর সংলগ্ন বিভিন্ন ক্রীড়া সংস্থার দপ্তর ও সাবেক বিভাগীয় স্টেডিয়ামের অবস্থান থাকায় এলাকাটি কিশোর–তরুণদের খেলাধুলার প্রাণকেন্দ্র হিসেবেও পরিচিত।
সবুজ ও উন্মুক্ত স্থান আধুনিক নগরজীবনের আবশ্যিক চাহিদা কিন্তু অপরিকল্পিত নগরায়ন ও উন্নয়নের ফলে শহরে মুক্তাঙ্গন ক্রমেই দুর্লভ হয়ে পড়েছে। চট্টগ্রাম শহরের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার বিপরীতে মাথাপিছু উম্মুক্ত স্থান অতি নগণ্য।
এই বাস্তবতায়, সার্কিট হাউজ চত্বরটি চট্টগ্রামের একটি ল্যান্ডমার্ক হিসেবেও গণ্য। তাই সঙ্গত কারণেই সার্কিট হাউজের ঐতিহ্য রক্ষার্থে এই ঐতিহাসিক চত্বরে কোনরকম বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণ না করে এটি উন্মুক্তভাবে সংরক্ষণ অতি জরুরি। এটি চট্টগ্রাম মহানগরীর মাস্টারপ্ল্যানে উন্মুক্ত পরিসর হিসাবে চিহ্নিত স্থান। চট্টগ্রামে প্রথম স্বাধীনতার পতাকা ১৭ ডিসেম্বর ‘৭১ এখানে উত্তোলন হয়, ১৯৮৮ তে প্রথম বিজয় মেলার মঞ্চ হয় এই মাঠে। নগরজীবনে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য উপযুক্ত আলো, হাওয়া সমৃদ্ধ সবুজ মুক্তাঙ্গন, যেমন : উদ্যান, খেলার মাঠ, পাহাড়, জলাশয়, দিঘি, পুকুর, ডোবা ইত্যাদি আবশ্যক। পাহাড় উদ্যান, জলাশয়সহ সকল উন্মুক্ত স্থান তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, বায়ু দূষণ ও নগর বন্যার রোধে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করে। সেই বিচারেও সার্কিট হাউজ প্রাঙ্গণসহ চট্টগ্রাম মহানগরীর বিভিন্ন স্থানে প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা উন্মুক্ত পরিসরগুলোকে সংরক্ষণ করা জরুরি।
গত ৪ঠা অক্টোবর বিকেলে তুমুল বৃষ্টির মাঝে এই ঐতিহাসিক মাঠের সামনে সম্মিলিত পরিবেশ রক্ষা আন্দোলন এর পক্ষ থেকে হাজারো মানুষের মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মিলিত পরিবেশ রক্ষা আন্দোলন–এর পক্ষ থেকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা প্রধান উপদেষ্টা মহোদয়কে অনুরোধ করা হয়– আর কোনো কনক্রিটের দেয়াল নয় আপনি প্রজ্ঞাবান মানুষের প্লালস বুঝেন –এই ঐতিহাসিক মাঠটি আমাদের সন্তানদের জন্য, মানুষের হাঁটার জন্য, ক্লান্ত পথিকের জিরানো জন্য, শহরের সুস্থতার জন্য উম্মুক্ত ও সবুজ থাকুক।
লেখক : চিকিৎসক ও পরিবেশকর্মী