১৯৭২ সাল ; কক্সবাজার ; একজন শিল্পীর উত্থান
বয়স কতো আর হবে– এগার কি বারো বছর হবে। কক্সবাজারে ডিসি বাংলোর পাশে গানের অনুষ্ঠান চলছে। অংশগ্রহণে সংগীতশিল্পী গোষ্ঠী– বালার্ক। মঞ্চে গাইছেন প্রবাল চৌধুরী ও উমা চৌধুরী। বাদ্যযন্ত্র শিল্পী হিসেবে আছেন নকীব ভাই, মিলনদা, দেবুদা। তাদের সাথে ড্রামসেট বাজাচ্ছে এগার বছরের এক কিশোর। দর্শক সারি থেকে এই কিশোরকে দেখা–ই যাচ্ছিল না ভালো করে। তারপরও বাজিয়ে চলেছে এবং প্রশংসাও পেলো কিশোরটি। আর ১৯৭২ সাল থেকে নিতান্তই শখের বশে এভাবেই অবিস্মরণীয় এক যাত্রা শুরু হলো কিশোর সংগীত শিল্পীর ।
আরও পরে ১৯৭৭ সাল থেকেই মূলত: নিয়মিত ড্রাম বাদক হয়ে উঠলেন। আর এখন ২০২৪ সাল। প্রায় ৪৭ বছর ধরে গানের জগতের সাথেই আছেন গুণী এই সংগীত শিল্পী। যিনি একাধারে ড্রামবাদক, গায়ক, সুরকার। সেই কিশোরই হলেন আজকের শাহবাজ খান পিলু। বাংলাদেশের সংগীত ভুবনে পিলু খানের মতো এমন শিল্পী আছেন কিনা জানি না।
যাঁদের প্রেরণায় সংগীতে ভ্রমণ যাত্রা
বাংলাদেশের সংগীত ভুবনে তিন খানের অবদান স্মরণীয়। এই খান পরিবার হচ্ছেন জিলু খান, নকীব খান, শাহবাজ খান পিলু। বড় ভাই জিলু খানের মাধ্যমেই সংগীতে হাতেখড়ি। ড্রাম বাজানোর বিষয়টি তিনিই শিখিয়েছিলেন
কারণ বড় ভাই জিলু খানের গড়া সংগীতের দল বালার্ক–এর সংগীত চর্চা হতো বাসায়। বাদ্যযন্ত্রও ছিল বাসায়। সুতরাং, পছন্দ অনুযায়ী বা যার যা ভালো লেগেছে, তা দিয়েই শুরু করেন সংগীত চর্চা। যেমন নকীব ভাই শুরু করলেন একোডিয়ান দিয়ে। পরে দেশসেরা অর্গান বাদক হলেন। পিলু খান শুরু করলেন ড্রাম বাজানোর মধ্য দিয়ে। এখন তিনিই দেশসেরা ড্রামবাদক। বড় ভাই জিলু খানের অকুণ্ঠ প্রেরণা ও উৎসাহের ফসল– আজকের নকীব খান এবং পিলু খান। এবং এখানে উল্লেখযোগ্য বড় ভাইয়ের মতো এই দুই ভাইও সুরকার। এক পরিবারে এমন ঘটনা খুব কমই আছে। আমরা দেখেছি আনোয়ার পারভেজ, জাফর ইকবাল এবং শাহনাজ রহমতুল্লাহ– এই তিন ভাইবোনের সংগীতে যুক্ত থাকা। পেয়েছি আলম খান–আজম খানের মতো শিল্পী। আরও পেয়েছি মাহমুদ উন নবী, ফাহমিদা নবী ও সামিনা চৌধুরী। পেয়েছি সন্জীদা খাতুন–ফাহমিদা খাতুনের মতো বরেণ্য সংগীত শিল্পীদের। আরো পেয়েছি লাকী আখন্দ এবং হ্যাপী আখন্দের মতো প্রমুখ গুণী শিল্পীদের।
এমন তিন ভাইয়ের সংগীতের প্রতি অনুরাগী হওয়ার নেপথ্যের কথা বললেন পিলু খান। তিনি জানালেন, “আমার বাবা আইয়ুর খান চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী কাজেম আলী স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তিনি ছিলেন সংগীতানুরাগী। পারিবারিকভাবে আমার দাদা ও নানার পরিবার সংগীতানুরাগী ছিল। আমার নানা বদরুল সিদ্দিকী ছিলেন বৃটিশ আমলে বিশিষ্ট কাওয়াল। তৎকালীন সময়ে এইচএমভি থেকে এলপি প্রকাশিত হয়েছিল। আর আমার বাবার সাথে দারুণ সখ্যতা ছিল চট্টগ্রামের আরেক বরেণ্য নৃত্য শিল্পী বুলবুল চৌধুরী। বাবার থেকে শুনেছি বুলবুল চৌধুরী নিজের প্রথম নাচ পরিবেশন করেছিলেন আমার বাবার সামনে। যা হোক, এমন সংগীতানুরাগী পিতৃকুল এবং মাতৃকুলের রক্তের ধারায় আমাদের বেড়ে ওঠা এবং প্রেরণা।”
এক নজরে পিলু
আগেই বলেছি, পিলু খান একাধারে ড্রামবাদক, গায়ক, সুরকার। বিরল প্রতিভাবান এই শিল্পীর জন্ম ১৯৬১ সালের ১৫ ডিসেম্বর। পৈতৃক নিবাস চট্টগ্রামের চুনতি, ডেপুটি বাড়ি। বাবা আইয়ুব খান যেহেতু চট্টগ্রামের কাজেম আলী স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন, সেই সুবাদে পড়ালেখা ও বেড়ে ওঠা স্কুল এলাকায়, কলেজ রোডে। গভর্মেন্ট এম.ই স্কুল (বর্তমানে চট্টগ্রাম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়), কাজেম আলী স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (বর্তমানে সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ) থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে ঢাকায় চলে যান। এবং একটি শিপিং কোম্পানিতে যোগদানের মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন।
সংগীতে পরিভ্রমণ
শিক্ষাজীবন ও কর্মজীবন–এই দুইয়ের মধ্যে থেকে ব্যাহত হয়নি সংগীতজীবন। যুক্ত ছিলেন সোলস এবং সৈকতচারীর সাথে। বাংলাদেশের প্রথম ব্যান্ড অডিও এলবাম সুপার সোলস প্রকাশের নেপথ্যে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন পিলু খান।
এরপর এগিয়ে গেছে বর্ণাঢ্য সংগীত জীবন। পরবর্তীতে যুক্ত হলেন রেনেসাঁ ব্যান্ডের সাথে।
ব্যান্ডের পাশাপাশি নিজে গানে সুর করা এবং গায়ক হিসেবে গড়ে তুলেছেন পিলু ভাই। এক অভাবনীয় ঘটনা এই যে, ড্রামসেট বাজানোর সময়ে চার হাত–পা সক্রিয় থাকে। এটা এক কঠিন বিষয়। ড্রামসেট বাজানোর সাথে গান করাও কঠিন বিষয়। সবার পক্ষে এই দুটোতে মনোনিবেশ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। একাগ্রতা ও কঠিন অনুশীলনের মাঝেই রপ্ত করা সম্ভব। এই বিষয়ে পিলু ভাইকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন: “এটা বাজাতে বাজাতে হয়ে গেছে। আর গান গাওয়ার বিষয়টিও এসে গেল স্বাভাবিকভাবেই। বড় ভাই জিলু খান এবং নকীব খানের প্রেরণা তো ছিলই। তাঁদের কাজগুলো দেখতাম। এখানে আমার ড্রাম বাজানোর বিষয়ে আরেকজনের কথা বলতেই হয়। তিনি হলেন তসলিম ভাই (মরহুম তসলিম উদ্দিন চৌধুরী, সাবেক সম্পাদক, দৈনিক পূর্বকোণ)। তিনি বিদেশে গেলে লংপ্লে রেকর্ড নিয়ে আসতেন। গানের ম্যাগাজিনও আনতেন। আর লংপ্লে বাজিয়ে ড্রাম বাজানোর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতেন। যা আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। তসলিম ভাই আমাকে এভাবে উৎসাহ যুগিয়েছেন।”
গায়ক ও সুরকার
রেনেসাঁ ব্যান্ডের প্রথম অডিও এলবামে গান গেয়ে গায়ক পিলু খানের যাত্রা। আর সুর করার সময়টাও ঐ সময়ে। ১৯৮৬/৮৭ সাল থেকেই বলা যায় নিয়মিত সুর করার কাজ শুরু করেন।
তাঁর সুর করা উল্লেখযোগ্য গান হচ্ছে :
আজ যে শিশু ( রেনেসাঁ)
এ যেন বৃষ্টির লেখা কবিতা (রেনেসাঁ)
চিরদিনই ভাবতে পারো (রেনেসাঁ)
সময় যেন কাটে না (সামিনা চৌধুরী)
হে বাংলাদেশ তোমার বয়স হলো কতো (রেনেসাঁ)
তৃতীয় বিশ্ব, এমনই এক বিস্ময় (রেনেসাঁ)
তুমি তো বলেছিলে ঝিরি ঝিরি বাতাসে (সামিনা চৌধুরী ও পিলু খান)
এসো হে বন্ধু এসো হে (সামিনা চৌধুরী ও পিলু খান)
সব কথা শেষ হলে শেষের ঠিকানায় (পিলু খান)
এ যেন তোমার আমার আমাদেরই কথা (রেনেসাঁ ও এলিটা)
তুমি জানো কি? আমি তোমার জন্য (পিলু খান)
এই দিন তো রবে না (রেনেসাঁ)
আকাশ আমার (রেনেসাঁ)
এখনও দারুণ দারুণ গান সুর করে চলছেন পিলু ভাই। সুর করার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মূলত শ্রদ্ধেয় শহীদ মাহমুদ জঙ্গী ভাইয়ের কারণেই আমার সুরকার হয়ে ওঠা। জিলু ভাই ও নকীব ভাইয়ের কাছ থেকে দেখেছি, সুর করার বিষয়টি। আমিও শুরু করলাম গান সুর করা। একসময়ে ঢাকার লালমাটিয়ায় একই ভবনে থাকতাম জঙ্গী ভাই ও আমি। সুতরাং, জঙ্গী ভাইয়ের নতুন কোনো গান লেখা হলে আমি দেখতাম। সুরও করতাম। আবার এমনও হয়েছে, একটা সুর তৈরি করলাম। পরে জঙ্গী ভাই কথা বসিয়ে দিলেন। আমি মনে করি, গীতিকার ও সুরকারের সুন্দর সমন্বয় একটা সুন্দর গানের সৃষ্টি করে। একজন গীতিকবি হিসেবে জঙ্গী ভাই জানেন, কোন গানের সুর আমাকে দিয়ে করালে ভালো হবে। সেভাবেই তিনি আমাকে দেন। আবার আমিও কোনো সুর তৈরি করলে জঙ্গী ভাইকে বলি। তিনিও সেভাবেই লিখেন। এখানে পারস্পরিক সম্পর্ক, সমন্বয় যে কোনো সৃষ্টিকে অন্যমাত্রা এনে দেয়। আমার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।
সুর করার বিষয়ে আলাপচারিতায় পিলু ভাই এক তথ্য জানালেন। একবার প্রয়াত সুরকার ও গীতিকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল পিলু ভাইকে বলেছিলেন– “তোমার মতো সুর আজকাল কেউ করে না। তুমি রেকর্ডিং করে রেখো। নতুবা সুর হারিয়ে যাবে।” কথাটা আমারও মনে ধরে গেলো। মাস খানেক আগে ঢাকায় শ্রদ্ধেয় গীতিকবি শহীদ মাহমুদ জঙ্গী ভাইয়ের বাসায় উনার লেখায়, পিলু ভাইয়ের সুর করা পান্থ কানাইয়ের গাওয়া একটি গান শুনলাম। সদ্যই রেকর্ড করা হয়েছে। এখনো রিলিজ হয়নি। অভিভূত হয়ে শুনলাম তিন,চারবার। কারণ, সুরের বৈচিত্র্য। আগের গানগুলোর সাথে কোনোই মিল নেই। বক্তব্যধর্মী গানের সুর একরকম, আবার রোমান্টিক সম্পর্কের কথায় সুর আরেকরকম। পিলু ভাইয়ের বৈচিত্র্যময় সুর অবশ্যই আমাদের সংগীত ভুবনকে সমৃদ্ধ করেছে।
আমাদের সকলের প্রত্যাশা থাকবে পিলু ভাইয়ের কাছে, সুরকার হিসেবে তাঁর গানগুলো রেকর্ডিং করে রাখা। যেহেতু, এখন তো আর আগের মতো ক্যাসেট, সিডি প্রকাশের যুগ নেই। তাই রেকর্ড করে রাখলে, পরে রিলিজ করলো। তাতে গানটিও সংরক্ষিত হয়ে থাকলো।
পিলু ভাইয়ের উত্তরাধিকার
এমন সংগীত পরিবারের পরবর্তী বংশধররা গানে যুক্ত থাকবে না– তাতো হয় না। পিলু ভাইয়ের ছেলে দামীর খান ইতোমধ্যে গায়ক হিসেবে কাজ করছে। একক এলবাম প্রকাশিত হয়েছে দুটি। মেয়ে যোয়া খানও গানের সাথে যুক্ত আছে।
ড্রামার, সুরকার ও গায়ক শাহবাজ খান পিলু নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের গানের জগতে ঈর্ষণীয় একটি নাম। তিনি আমাদের গানের জগতকে সমৃদ্ধ করেছেন। পিলু ভাইয়ের সংগীত জীবন আরো বর্ণাঢ্যময় হোক, এই প্রত্যাশা করি।