পিবিআই প্রধান বনজসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে বাবুলের মামলার আবেদন

হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ

আজাদী প্রতিবেদন | শুক্রবার , ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৬:১৩ পূর্বাহ্ণ

পিবিআই হেফাজতে বাবুল আক্তারকে নির্যাতন করা হয়েছে, এমন অভিযোগে পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদারসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ জেবুন্নেছার আদালতে গতকাল মামলার আবেদন করেছেন কারাগারে থাকা বাবুল আক্তার নিজেই। বনজ কুমার মজুমদার ছাড়া বাকী অভিযুক্তরা হলেন, পিবিআই চট্টগ্রাম জেলার এসপি মো. নাজমুল হাসান, পিবিআই চট্টগ্রাম মহানগরের এসপি নাঈমা সুলতানা, সাবেক পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রোর পরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমা, সাবেক পিবিআই চট্টগ্রাম জেলার পরিদর্শক একেএম মহিউদ্দিন সেলিম ও এনায়েত কবির। এদের মধ্যে সন্তোষ কুমার চাকমা বর্তমানে নগরীর খুলশী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে এবং একেএম মহিউদ্দিন সেলিম ডিবির বন্দর জোনে এসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। মহানগর পিপি ফখরুদ্দিন চৌধুরী আজাদীকে বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, মামলার আবেদন পরবর্তী উক্ত বিষয়ে শুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে আদেশ হয়নি। আদেশের জন্য আদালত আগামী ১৯ সেপ্টেম্বর দিন ধার্য করেছেন। বাবুল আক্তারের আইনজীবী গোলাম মাওলা মুরাদ আজাদীকে বলেন, স্ত্রী খুনে বাবুল আক্তার বাদী হয়ে একটি মামলা করেছিলেন। সে মামলার প্রস্তুতকৃত চার্জশিট দেখাতে গত বছরের ১০ মে তাকে ঢাকা থেকে ডেকে আনা হয়। একপর্যায়ে উক্ত মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে শ্বশুরকে দিয়ে নতুন একটি মামলা করানো হয়। এ মামলায় বাবুলকে ১ নম্বর আসামি করা হয়। একপর্যায়ে ১২ মে আদালতে নিয়ে যাওয়া হয় এবং ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করিয়ে তাকে হেফাজতে নেয় পিবিআই। হেফাজতে নিয়ে স্বীকারোক্তি আদায় করতে তার ওপর নানাভাবে নির্যাতন করা হয়। মামলার আবেদনে যাদেরকে অভিযুক্ত করা হয়েছে, তারাই এর সাথে জড়িত।
২১ পৃষ্ঠার মামলার আবেদনে উল্লেখ করা হয়, গত বছরের ৮ মে মিতু হত্যায় বাবুলের করা মামলার তদন্ত শেষ করে অভিযোগপত্র দাখিল করার আগে বাবুলকে বিষয়টি জানানোর জন্য তৎকালীন তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই পরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমা হোয়াটস অ্যাপে ফোন করে পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো অফিসে আসতে অনুরোধ করেন। এ সময় সন্তোষ বলেন, ‘পিবিআই প্রধান বনজ স্যার বলেছেন, আপনি আসলে বনজ স্যারকে জানাবেন।’ এ সময় বাবুল বলেন, ‘আমি ১০ মে আসবো। কিন্তু ৯ মে বনজ কুমার মজুমদারকে কয়েকবার ফোন করেন বাবুল। তবে তিনি সেই ফোন কল রিসিভ করেননি। বাবুল ১০ মে তার রাজধানীর বাসা থেকে পিবিআই চট্টগ্রাম অফিসে এসে পৌঁছান সকাল সাড়ে ৯ টায়। পরিদর্শক সন্তোষ কুমারের রুমে গেলে তিনি চার্জশিট দেখতে দেন বাবুলকে। ২০ মিনিট পর সন্তোষ জানান, ‘স্যার এসপি স্যারের রুমে আসেন।’ বাবুল পিবিআই এসপি (মেট্রো) নাঈমা সুলতানার রুমে ঢুকে দেখেন নাঈমাসহ অভিযুক্তরা ওই রুমে উপস্থিত আছেন। এ সময় এসপি নাজমুল বলেন, ‘তোমাকে আমার অফিসে যেতে হবে।’ কেনো জানতে চাইলে নাজমুল বলেন, ‘এতো কৈফিয়ত দেবার সময় নেই, বনজ স্যারের নির্দেশ।’ এরপর সন্তোষ ও মহিউদ্দিন মিলে বাবুলকে জোরপূর্বক একটি মাইক্রোবাসে করে পিবিআই মেট্রো অফিস থেকে পিবিআই জেলা অফিসে নিয়ে যান। তাকে একটি ফ্লোরের বন্ধ একটি রুমে রাখা হয়। এ সময় বাবুল তার মেঝো ভাই সাহাবুল হকের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে নাজমুল মোবাইল ফোন কেড়ে নেন। এ সময় বাবুল নাজমুলের কাছে জানতে চান, ‘কেন তাকে এখানে আনা হয়েছে? কেনো কারো সাথে যোগাযোগ করতে দেয়া হচ্ছে না?’ তখন নাজমুল ‘পরে বুঝবা’ বলে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। যাবার সময় নাজমুল বলেন, ‘শালারে দেইখা রাখ।’ বাবুল আক্তার উক্ত রুমে ৫৩ ঘণ্টা আটক থাকেন বলেও মামলার আবেদনে বলা হয়।
মামলার আবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়, ১০ মে আসরের আজানের পর নাজমুল এবং নাঈমা আবার রুমে আসেন। এ সময় নাজমুল বলেন, ‘বনজ স্যারের নির্দেশ তোমাকে তোমার স্ত্রী হত্যা মামলায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে হবে।’ তখন বাবুল বলেন, ‘আমি কেন স্বীকারোক্তি দেবো, কিসের স্বীকারোক্তি দিব, আমিতো কোনো অন্যায় করি নাই।’ এ সময় নাজমুল বলেন, ‘অন্যায় করো আর না করো, স্বীকারোক্তি তোমাকে দিতেই হবে। কিভাবে স্বীকারোক্তি আদায় করতে হয় আমরা জানি। বনজ স্যার চাইলে সব হয়।’ একপর্যায়ে সেখানে এসে এনায়েত কবির বলেন, ‘শালা, তুই আমার বিরুদ্ধে রিপোর্ট দিয়েছিলি। এবার তোর মজা দেখাবো। কোনো বাপ তোরে এবার বাঁচাতে পারবে না।’ এরপর মহিউদ্দিন সেলিম এসে বলেন, ‘বনজ স্যার চাইলে বাঘে মহিষে একঘাটে পানি খায়। আপনি কোনোভাবে বাঁচতে পারবেন না। আপনাকে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিতেই হবে। মাগরিবের আজানের পর সন্তোষ এসে বলেন, ‘আপনার পাঁচলাইশ থানার ১(৬)২০১৬ নম্বর মামলা শেষ। আপনার বিরুদ্ধে এখন নতুন মামলা হবে। বনজ স্যার আপনার শ্বশুরের বাসায় পিবিআইয়ের গাড়ি পাঠিয়েছেন। আপনার শ্বশুর আসলে তাকে দিয়ে আপনার বিরুদ্ধে নতুন করে মামলা নেওয়া হবে। ১২ মে দুপুর ১২ টার দিকে হঠাৎ সন্তোষ এসে বলেন, ‘আপনার দায়ের করা মামলা শেষ। এখন আপনি আসামি। কোর্টে চলেন। রিমান্ডে আসলে বুঝবেন। ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি আপনাকে দিতেই হবে।’ একপর্যায়ে পিবিআই জেলা অফিস থেকে হাতকড়া পরিয়ে তাকে আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে নতুন মামলায় তার পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হলে মেট্রো অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই অফিসের দুই তলায় নিয়ে যাবার পর হ্যান্ডক্যাপ লাগানো অবস্থায় চোখ বেঁধে একটি প্লাস্টিকের চেয়ারে বসিয়ে রাখা হয়। রিমান্ডে বাবুল আক্তারের সাথে কী কী হয়েছে তাও উল্লেখ করা হয় মামলার আবেদনে। বলা হয়, তাকে যারা জিজ্ঞাসাবাদ করতেন সে অফিসাররা মাঝে মাঝে তার কাছে দুঃখ প্রকাশ করতেন। রিমান্ডে বার বার জিজ্ঞেস করা হতো ‘তোর বাপের নাম কি?’ জবাব না দিলে, মাথার বাম পাশে ধাক্কা দেয়া হতো। হঠাৎ করে প্লাস্টিকের চেয়ারের পেছনে লাথি মেরে বলতো, ‘শালার সাহস কত? ১৬৪ ধারার জবানবন্দি দিবে না।’ চোখ খোলা হতো খাবার সময়। তবে পেছনে তাকাতে দিতো না। খাওয়া শেষ হবার সাথে সাথে চোখ বেঁধে এবং হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে দেওয়া হতো। হাত ধোয়ার পানি দেওয়া হতো না। বোতলে করে অল্প খাবার পানি দেওয়া হতো। গোসল নেই, অজুর পানি নেই। বলা হতো, ‘তায়াম্মুম করে নামাজ পড়।’ চোখ বাঁধা অবস্থায় বাথরুমে নিয়ে হ্যান্ডকাফ খোলা হতো। নির্দেশনা দেওয়া হতো, ‘বাম পাশে বদনা আছে।’ পানি ব্যবহারের পর সাবান ধরার আগেই হ্যান্ডকাফ পরিয়ে বের করে ফেলতো। রিমান্ডের দ্বিতীয় দিন সন্ধ্যার পর নাঈমা সুলতানা, নাজমুল হাসান, সন্তোষ কুমার চাকমা, মহিউদ্দিন সেলিম ও এনায়েত কবির আসে। পূর্ব পরিচয় থাকার সূত্রে তাদের কণ্ঠ চেনেন বাবুল। নাঈমা চেয়ারের পেছনে লাথি মেরে বলেন, ‘শালা হিজড়ার বাচ্চা, এখনো ১৬৪ ধারার জবানবন্দি দিতে রাজি হচ্ছে না?’ নাজমুল বলে ওঠেন, ‘সন্তোষ, শালারে লটকাইয়া ফেলেন তো।’ এ সময় এনায়েত কবির বলেন, ‘স্যার চিন্তা করবেন না, শালাকে ১৬৪ ধারার জবানবন্দি দিতেই হবে, আমরা ব্যবস্থা করছি।’ মহিউদ্দিন সেলিম বলেন, ‘স্যার আপনারা যান, আমরা জানি কিভাবে জবানবন্দি করাতে হয়। আমরা চাইলে লোহাও ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয়।’ মামলার আবেদনে বলা হয়, ১৪ মে ঈদুল ফিতর ছিল। সেদিনও নির্যাতন থেকে রেহায় পাননি বাবুল। ১৫ মে জিজ্ঞাসাবাদরত অফিসারদের একজন বাবুলকে বলেন, ‘আপনাকে যে অফিসাররা শুতে দিয়েছিল, সেই অফিসারদের শাস্তি হিসেবে চট্টগ্রাম থেকে দক্ষিণাঞ্চলের দূরবর্তী এক জেলায় বদলি করা হয়েছে।’ এমন নিষ্ঠুর, অমানবিক ও লাঞ্ছনাকর আচরণ সহ্য করতে না পেরে একপর্যায়ে বাবুল বলেন, ‘আমি স্বীকারোক্তি দেবো, কি বলতে হবে বলেন।’ এ সময় উপস্থিত অফিসারেরা রুমের বাইরে গিয়ে কারোর সঙ্গে ফোনে আলাপ করেন। কিছু সময় পর মহিউদ্দিন সেলিম ও সন্তোষ আসেন। এ সময় বাবুল তাদের জানান তিনি ১৬৪ ধারার জবানবন্দি দিবেন। ১৭ মে সকাল ১০টার দিকে সরকারি গাড়ি ব্যবহার না করে খয়েরি রংয়ের একটি প্রাইভেট কারে করে আদালতে নেওয়া হয় বাবুলকে। পথে যেতে যেতে মহিউদ্দিন সেলিম বলেন, ‘১৬৪ ধারার জবানবন্দি না দিলে আপনার অবস্থা কি হবে আল্লাহ জানে। আবার রিমান্ডে নিয়ে আসা হবে। আপনার বাচ্চাদের মুখ হয়তো আর দেখতে পাবেন না।’
উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে নগরীর পাঁচলাইশ থানার ওআর নিজাম রোডে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার পথে বাসার অদূরে গুলি ও ছুরিকাঘাত করে খুন করা হয় মাহমুদা খানম মিতুকে। স্ত্রীকে খুনের এ ঘটনায় এসপি বাবুল আক্তার বাদী হয়ে নগরীর পাঁচলাইশ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। সে সময় বাবুল আক্তার দাবি করেন, জঙ্গিরাই তার স্ত্রীকে গুলি করে হত্যা করেছেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসেই ৬ তলা ভবন ভাঙা শুরু
পরবর্তী নিবন্ধভারত সফর শেষে দেশে ফিরেছেন প্রধানমন্ত্রী