চট্টগ্রাম বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অফ ফ্যাশন এন্ড টেকনোলজি (BUFT) তে পিঠা উৎসব হলো। পৃথিবীর সমস্ত অবজেক্ট যদি তা মানুষ তৈরি করে তাহলে তা অবশ্যই কোন না কোন ম্যাসেজ ধারণ করে। মিডিয়ার ক্ষেত্রে মার্শাল ম্যাকলুহান একে ‘Medium is the message‘ বলে উল্লেখ করেন। পিঠাপুলি স্ট্যাপল বা প্রধান খাবার নয়। খাবার মূলত দুই ধরনের। স্ট্যাপল বা প্রধান খাবার ও স্ন্যাকস বা হালকা বা জলখাবার। পিঠা মানুষের তৈরী অবজেক্ট বা খাবার। পৃথিবীর সব সৃষ্টি তা প্রযুক্তি হোক বা অন্য কোনঅবজেক্ট, তা অবশ্যই ম্যাসেজ বা বার্তা প্রচার করবেই। আর তা করে পিঠাও।
খাবার কোন জনপদের সংস্কৃতি ও অর্থনীতির প্রচারক। এইযে আমরা বলি, ‘বাঙালি হচ্ছে মাছে–ভাতে বাঙালি, এ মূলত আমাদের ভৌগলিক অবস্থান ও এর দ্বারা নির্ধারিত সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যকেই বোঝায়। যদি ভূগোলের কথা বলি, তাহলে দেখি, নদীমাতৃক বাংলাদেশ হচ্ছে, হাওর, বাওর , নদ–নদী, বিল, পুকুরের পরিপূর্ণ অঞ্চল। ফলে জলজ প্রোটিনের উৎস হিসেবে মাছের প্রাকৃতিক নির্বাচনের ভূমি বাংলাদেশ। পলিমাটির এই ভূমিতে, চাষের এমন সুবিধা আমাদের চাল উৎপাদনের এক প্রধান ক্ষেত্রভূমি করেছে। প্রকৃতি এমন করেই এক বিশেষ সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য নির্মাণ করেছে। হাওরের শীতকালীন বৈশিষ্ট্য একই সাথে জেলে ও চাষী হওয়ার প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে। সিলেটের ভূ–প্রকৃতি চা কে অর্থকরী ফসলের ক্ষেত্রভূমি করেছে। আমাদের গান, নৃত্য প্রাত্যাহিক জীবনাচার আমাদের ভূগোল যেমন নিয়ন্ত্রণ করে, তেমনি বিশ্বাস, অর্থ ব্যবস্থা ইত্যাদিও।
খাবার সামাজিক জীবনাচারের বড় অংশ। মূলত খাবার সংগ্রহের অর্থনীতি থেকে খাবার উৎপাদনের অর্থনীতিতে পদার্পণ সভ্যতা বা সমাজ তৈরির প্রধান কারণ। খাদ্য উৎপাদন ও বণ্টনের বিষয় না থাকলে পরিবার, সংঘ, সংগঠন, রাষ্ট্র কোন কিছুরই অস্তিত্ব থাকেনা। খাবারের পরেই আসে পোশাক, বাসস্থান, চিকিৎসা এবং আরো পরে, শিক্ষার চাহিদা। লক্ষ্যণীয় এমন ব্যবস্থায় উত্তরণের আরেক কারণ আগুনের আবিষ্কার। আগুনের ব্যবহারে লোহা দিয়ে লাঙ্গল বানাতে পারি। ফলে শুরু হয় কৃষি সভ্যতার।আগুনে ঝলসে খাবার বানানোর চর্চা শুরু হয় ঐ কাল থেকেই।
প্রকৃতি আমাদের জীবনের বড় নিয়ন্তা,তার প্রমাণ দিনক্ষণ গণনা করবার ক্যালেন্ডার। বাংলা সন বা সাল, সেওতো বাংলার ভৌগলিক বৈশিষ্ট্য থেকে উৎসারিত। হেমন্তে ফসল ওঠার সময়ের নির্ধারণে আকবরের বাংলা ক্যালেন্ডারের আবির্ভাব। আর ফসল শুধু প্রধান খাবার বা Staple Food নির্ধারণ করে তা নয়, পার্শ্ব খাবার বা স্ন্যাকস বা হালকা বা জলখাবারেরও নির্ধারণ করে। হেমন্তের পরেই শীত ও বসন্ত। হেমন্তের ধান হয়ে উঠে, শীতের হালকা বা স্ন্যাকস খাবারের কাঁচামাল। এসময় রবি শস্যের কাল। শীতের খেজুর ও রস ও এথেকে বানানো গুড় ও রাব হালকা খাবার বানানোর উপাদান বৃদ্ধি করেছে মাত্র। ফলে পিঠা হয়েছে বাংলাদেশের খাবারের সাংস্কৃতিক ব্যঞ্জন।
অর্থনীতিক প্রাণী সাংস্কৃতিকও। উৎপাদন ও বণ্টনও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের অংশ। এই যেমন, ঘরেরে যে মা আমাদের জন্য পিঠা বানাচ্ছেন, তার কাঁচামাল বা ময়দা বা চালের গুড়ি বাবা বাজার থেকে কিনে এনেছেন। এতে পণ্যের বিনিময় হয়েছে। এ এক অর্থনীতিক কাজ। চালের গুড়ি পিষিয়েছে ময়দার কলে। সেখানেও অর্থের বিনিময় হয়েছে। চালের গুড়ি চাল বানাতে ধানের বেচাকেনা হয়েছে। আবার চাষীকে ধানের চারা কিনতে হয়েছে। এমন অর্থনীতিক কাজের শেষ নেই। মায়ের বানানো যে পিঠা আমরা খাই তার পেছনে কি বিশাল অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ আছে, কখনো আমরা চিন্তা করে দেখেছি?
আগেই জেনেছি খাবার, মানুষের প্রাথমিক চাহিদা হলেও বস্ত্র বা পোশাক আইন–কানুন, রীতি–নীতির সভ্য সমাজে খাবারের পরের চাহিদায় স্থান করে নেয়। আর পোশাকের সৌন্দর্যের আরোপ এখান থেকেই। খাবারের সৌন্দর্যের চর্চা ও দেখবার মত। পোশাকের মতো খাবারের ফ্যাশন না থাকলেও, সৌন্দর্য চর্চা ঠিকই আছে। পিঠাপুলির নকশা আমাদের তাইই জানান দেয়।
পিঠা আবার পোশাককেও এক ভিন্ন মাত্রার রূপ দিয়েছে। বৈশাখের উৎসবে প্রকৃতির রং এ সাজানোর জন্য বসন্তের রং কে বাসন্তী নামে অভিহিত করা হয়েছে। আর বসন্তের আগমন আমাদের সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক জীবনকেও এক বিশেষ মাত্রা দিয়েছে। ঋতু কেন্দ্রিক ফসল ও তার খাবার, নাচ আর গানের বৈশিষ্ট্যকেও মাত্রা দিয়েছে।
খাবারের আবার রাজনীতিও আছে। গ্লোবালাইজেশন বলি যাকে, তা আমাদের অর্থনীতি আর সংস্কৃতির নিয়ন্তা হয়েছে তাই নয়, এ আমাদের খাদ্যাভ্যাসকেও পাল্টে দিয়েছে। যে পিঠাপুলি আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ, পাশ্চাত্যের স্ন্যাকস আমাদের তরুণদের রসনার স্বাদকে ভুলিয়ে দিয়েছে।
এও সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের ফল। রসনার স্বাদ শুধু প্রাকৃতিক নয়, সাংস্কৃতিকও বিষয়টি গ্লোবালাইজেশন বুঝিয়ে দিলো।
খাবারের সাথে শাসকের পরিচয় জড়িয়ে আছে। মোগলাই খাবার তেমনি। তবে তা মূলত প্রধান বা স্ট্যাপল বা প্রধান খাবার হলেও, মোগলাই পরোটা বা হালিম ইত্যাদিকে হালকা খাবার হিসেবেও চিহ্নিত করা যায় । ইউরোপে পিঠা হলো ওঁদের স্ন্যাকস্ । কেক, পেস্ট্রি, ডোনাট, ক্রোসিয়ান্ট ইত্যাদি, একই সামাজিক– অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অধীন হওয়ায় কন্টিনেন্টাল স্ন্যাকস হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। সমাজ আর রাজনীতি খাবারের নামায়নে এক ভূমিকা রেখেছে।
সামাজিক–অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সাথে খাবারের বৈশিষ্ট্য বা প্রকৃতির পরিবর্তনের সহগামী সম্পর্ক আছে। প্রস্তর যুগের paleo বা নিয়ানডার্থাল ফুড ঐ সামাজিক ব্যবস্থার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিলো। বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির পরিবর্তন, সমাজ ও অর্থনীতির সাথে সাথে খাদ্যাভ্যাসও পরিবর্তন করে। সাথে পরিবর্তনের কারণ হিসেবে অবশ্যই আছে ভৌগলিক অবস্থা ও ঋতু। মানুষের বিশ্বাসও খাবারের ধরন নির্ধারণ করে।
খাবার সংস্কৃতির অংশ আবার এ কোন জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ও জীবনাচারের অংশ হয়ে যায়।
গ্লোবাল এম্পায়ার বা বিশ্ব অর্থনীতির কালে, অর্থনীতির আধিপত্যের সাথে সংস্কৃতি আর খাবারের আধিপত্যও দেখবার মতো। হালকা পানীয় কোকা কোলা যেমন ভূবনব্যাপী রাজত্ব করছে, খাবারে করছে ম্যাকডোনাল্ড‘স। সবই হালকা খাবারের ক্ষেত্রে। এ ভুলিয়ে দেয় পিঠাপুলিকে। বিশ্ব অর্থনীতি স্থানিক সংস্কৃতিকে ধ্বংস করছে। যেমন করেছে প্রান্তিক দেশগুলোর সৌন্দর্য চর্চা পর্যন্ত। আফ্রিকা আর এশিয়ার নারীদের সৌন্দর্যচর্চা এখন পশ্চিম কেন্দ্রিক। আমাদের আলতা দিয়ে পা রাঙানো এখন ইতিহাস। এমন হতে থাকলে স্থানিক সভ্যতার নিদর্শন নিশ্চিহ্ন হবে। ইউনেস্কো‘র হেরিটেজ রক্ষার আন্দোলনে খাবার নেই?
বাতি জ্বলে উঠলে, শুধু একটি নির্দিষ্ট এলাকাকে আলো দেয় তাই নয়, চিন্তায় অন্ধকারের বিশ্বাসকেও দূরীভূত করে। এই বাতি প্রযুক্তি নিভর্র একটা জীবনাচার গড়ে তোলে। আমাদের অর্থনীতি, পোশাক, আমাদের রন্ধন প্রণালী সবই এখন প্রযুক্তি নিভর্র। আমরা যে হেরিটেজ এর কথা বলি তা আসলে কতক অবজেক্ট মাত্র, যা আমাদের জীবনাচার ও বিশ্বাসকে নিয়ন্ত্রণ করে। পিঠা ভুলে গেলে ভুলে যাবো খেজুরের রসের কথা, গুড়, রস সংগ্রহকারী পেশার কথা আর একে কেন্দ্র করে অর্থনীতির যজ্ঞকে।
খেজুরকে কেন্দ্র করে আরব উপদ্বীপে এক বিশাল শিল্প গড়ে উঠেছে। আর আমাদের খেজুর নয়, খেজুরের গুড়। এই সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য রক্ষা করবেন কে? ছাত্র–ছাত্রীরা যখন পিঠা উৎসব করে তা যে এক বিশাল হেরিটেজ রক্ষা করবার কথা জানান দিচ্ছে এ বিবেচনায় নিই? আর সব খাবারের উপাদানগুলোকে ভিত্তি করে যে অর্থনীতিক কাজ আমাদের এউচ বাড়ায় তা–ওতো দেখবার মতো। সক্রেটিসের অমিয় বাণী, “Know Thyself” এর ভাবের অর্থ, নিজের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যকে জানার কথাও বোঝায়। পিঠা বানানো, আর খাওয়া আর রসদ সংগ্রহের অর্থনীতি কিভাবে কাজ করে, BGMEA এর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তা কিন্তু জানিয়ে দিলো।
মানুষের পাঁচ ইন্দ্রিয়ের কাজ সেন্স করা এবং বস্তু জগতের জ্ঞান নেয়া। মুখ খাবারের জন্য আর জিব স্বাদের ধারণা দেয়। চোখ দেখবার আর কান শুনবার জন্য। এগুলো আমাদের দেখা ও কোন অবজেক্টকে মডিফিকেশন এর ধারণা দিতে সাহায্য করে। খাবার যেমন শিল্প, মানুষের পোশাকও তেমনি। শিল্পী, শিল্পকে শিল্পোত্তীর্ণ করে। কারিগরী ও প্রকৌশল বিদ্যা মানুষের বেঁচে থাকবার জগতকে নির্মাণ করে আর করে শিল্পমন্ডিত। আর মানব প্রয়োজনের প্রথম তাগিদ যে খাবার তার চর্চাও কিন্তু সভ্যতারই অংশ। আগুন জ্বালানোর বিদ্যা না জানলে মাংস ঝলসে খাওয়া যেতনা। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি আর শিল্প মানুষের বেঁচে থাকবার উপায়। যাঁরা ভবিষ্যতে আমাদের শুধু বস্ত্র পরিধানের পণ্য তৈরি করবার পথ বাতলাবেন তা নয়, সাথে সাথে ফ্যাশনে মোড়াবেন তাঁদেরই হাতে,খাবারের বিশেষ করে হালকা খাবারের মেলা নয়া সম্ভাবনার আলো দেখায়। আমাদের পিঠা উৎসব হোক আমাদের গর্বিত ঐতিহ্য। খাবার তৈরি করবার প্রযুক্তি সমাজের পরিবর্তনের একটা ক্ষণকে সামনে আনে। আমাদের ছাত্ররা এই সময়কে জানিয়ে দিলো।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, সমাজতত্ত্ব বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।