গ্রাম বাংলার চিরাচরিত ঐতিহ্য হিসেবে পৌষের হিম শীতে পিঠা খাওয়ার ধুম হরহামেশাই চোখে পড়ে। কিন্তু শীত যাই যাই করছে, ঠিক এ সময়ের এক সকালেও কংক্রিটের চার দেয়ালের এই শহরে যে ভাপা, নকশি আর পাটিসাপটাসহ আবহমান বাংলার বৈচিত্রপূর্ণ রকমারি পিঠার আয়োজন হতে পারে তার প্রমাণ পাওয়া গেল গতকাল শুক্রবার চিটাগং সিনিয়রস ক্লাব লিমিটেড আয়োজিত পিঠা উৎসবে। উৎসবে ক্লাব সদস্য ও তাদের পরিবারবর্গ আনন্দ-উচ্ছ্বাসের সঙ্গে যোগ দেন। তারা বাহারি সব পিঠার স্বাদ গ্রহণ করেন।
পিঠা উৎসবের উদ্বোধন করেন লায়ন্স ক্লাবের সদ্য বিদায়ী জেলা গভর্নর লায়ন কামরুন মালেক। অতিথি ছিলেন দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক।
উদ্বোধনী বক্তব্যে কামরুন মালেক বলেন, বাহারি রঙের পিঠা আমাদের সংস্কৃতির একটি অংশ। দেশে সামাজিক, পারিবারিক ও ধর্মীয় উৎসবে পিঠার প্রচলন অতি প্রাচীন। আবহমান বাংলার ঐতিহ্যমণ্ডিত সুস্বাদু পিঠাগুলোকে নগরজীবনে ক্রমাগতভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে পরিচিত করে দেয়ার জন্য চিটাগাং সিনিয়রস ক্লাব এ ধরনের উৎসবের আয়োজন করেছে। ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত থাকবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তিনি আরও বলেন, কোভিড-১৯ সংক্রমণকালের মধ্যেও চিটাগং সিনিয়রস ক্লাব পিঠা উৎসব আয়োজন করায় ক্লাব প্রেসিডেন্ট ডা. সেলিম আকতার চৌধুরী ও কমিটির সদস্যদের প্রতি সাধুবাদ জানাই। আমরা একটি কঠিন সময় অতিক্রম করছি, তবে বিশ্বের অনেক ধনী ও উন্নত দেশের চেয়েও বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে। আমরা এরই মধ্যে কোভিড-১৯ প্রতিরোধক ভ্যাকসিন পেয়ে গেছি। এজন্য আমরা অনেকটা স্বস্তিতে আছি। আমাদের দেশের গ্রামীণ জনপদে কোভিড-১৯ ফণা তুলতে পারেনি। এ নিয়ে শহরের মানুষ যতটা উদ্বেগ-উৎকন্ঠায় আছে গ্রামের মানুষের মাঝে তার তেম প্রভাব পড়েনি। এমনকি আক্রান্তের সংখ্যা গ্রামে নেই বললে চলে। তিনি উল্লেখ করেন, এ করোনাকালেও আমরা সৌভাগ্যবান এ কারণে যে আমাদের অর্থনীতির চাকা এখনও সচল রয়েছে। আমাদের রিজার্ভ এবং রেমিটেন্স প্রবাহে ঈর্ষণীয় সক্ষমতা বিদ্যমান।
চিটাগং সিনিয়রস ক্লাব লিমিটেডের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক বলেন, ষড়ঋতুর বাংলাদেশে বার মাসে তের পার্বণ হয়ে থাকে। এতে আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ছোঁয়া আছে। আগে এ শীতে গ্রামে-গঞ্জে নতুন ধানের চালের গুঁড়ো দিয়ে রকমারি পিঠা-পুলি তৈরি হতো এবং উৎসবের ধুম পড়ে যেত। দুঃখের বিষয় নাগরিক জীবন থেকে পিঠা-পুলি প্রায়ই মুছে গেছে। তিনি শৈশবের স্মৃতিচারণ করে বলেন, অতীতে আমাদের মা-দাদী-নানী, ফুফু ও চাচীদের কঠোর শ্রমে যে সুস্বাদু পিঠা তৈরি হতো তা আজকের শহুরে ছেলে-মেয়েদের কাছে গল্প বলে মনে হয়। তাদের কাছে গ্রামীণ পিঠার স্বাদ কিছুটা হলেও পৌঁছে দেয়ার জন্য এ ধরনের উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে। এ ধরনের আয়োজন সবাইকে গ্রাম-বাংলার সংস্কৃতিকে স্মরণ করিয়ে দেয়। চিটাগং সিনিয়রস ক্লাব গত চার বছর ধরে প্রতি শীতে পিঠা উৎসব করে এসে আমাদের মধুর নষ্টালজিয়ার ভুবনকে ফিরিয়ে এনেছে। এটা চিটাগং সিনিয়রস ক্লাব লিমিটেডের বড় অর্জন।
অনুষ্ঠানে চিটাগং ক্লাবের সাবেক চেয়ারম্যান ও সিনিয়রস ক্লাবের সদস্য এ. কামরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, পিঠা উৎসব সত্যিকার অর্থে আমাদের লোকজ সত্তার প্রতিনিধিত্ব করে। তাই এর সাথে আমাদের আত্মিক সম্পর্ক বিদ্যমান। করোনাকালে যে ধাক্কাটি এসেছিল তাকে আমরা সামাল দিতে পেরেছি। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, মানুষই সকল সমস্যার সমাধান দিতে পারে। সমস্যা থাকবে এবং তাকে মোকাবেলা করে আমাদের বেঁচে থাকতে হবে। এজন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন টেকসই উন্নয়ন এবং এটাই হচ্ছে আমাদের সুদৃঢ় অস্তিত্বের ভিত্তি।
ক্লাবের সদস্য মো. গোলাম মোস্তফা কাঞ্চনের সহধর্মিনী আবিদা সুলতানা বলেন, টেকসই উন্নয়নের ধারায় অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা সচল থাকে। করোনাকালে অর্থনৈতিকভাবে সারা বিশ্ব ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বাংলাদেশে টেকসই অর্থনৈতিক অবকাঠামো বিদ্যমান থাকায় আমরা করোনাকালীন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পেরেছি। তিনি এ টেকসই উন্নয়নের ধারায় সিনিয়রস’ ক্লাবের পিঠা উৎসবে অংশগ্রহণকারীদের নারী উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে উঠার সম্ভাবনার কথা জানিয়ে তিনি ক্লাবের প্রেসিডেন্ট ডা. সেলিম আকতার চৌধুরী ও তাঁর কামিটির সদস্যদের প্রশংসা করেন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে সিনিয়রস’্ ক্লাব প্রেসিডেন্ট ডা. সেলিম আকতার চৌধুরী বলেন, পিঠা উৎসব এ ক্লাবের একটি সাংবাৎসরিক আয়োজন। এতে ক্লাবের সদস্যরা, তাঁদের সহধর্মিনীরা ও পরিবারের সদস্যরা অংশগ্রহণ করেন। পিঠা উৎসবে ১০টি স্টলে যে সকল রকমারী পিঠার ডালি সাজিয়েছেন তাঁরা একদিন সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবেন। এ করোনাকালে নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডে কোভিড-১৯ প্রতিষেধক ভ্যাকসিন প্রধান কার্যক্রমে সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমার টিম নিয়ে নাগরিকদের সেবা দিয়েছি এবং আমরা নগরীতে টিকা প্রদানে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ইতিমধ্যে সম্পন্ন করেছি। এর দ্বিতীয় ডোজ টিকা প্রদানের কার্যক্রমও একইভাবে পরবর্তীতে চলবে। তিনি ক্লাব সদস্যদের ক্লাবের আইটি সেক্টরে অথবা যে যেখানে অবস্থান করছেন সেখান থেকে টিকা প্রদানে নিবন্ধিত হওয়ার জন্য আহ্বান জানান।
স্বপনীল বড়ুয়ার সঞ্চালনায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন, মেম্বার মাশফিক-উল-হাসান। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আলাউদ্দিন, ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য এম. ইয়াকুব আলী, ডা. মোহাম্মদ ইমাম হোসেন (রানা), মোহাম্মদ আব্বাস এবং নুরুল আফসার মজুমদার (স্বপন)।
উৎসবে অংশ নেওয়া স্টলগুলোর টেবিলজুড়ে থরে থরে সাজানো বাহারি পিঠা। কি নেই সেখানে। নানা সব পিঠার মধ্যে ছিল পাটিসাপটা পিঠা, মালপোয়া পিঠা, লবঙ্গ লতিকা, রসফুল পিঠা, বিবিখানা পিঠা, নারিকেলের ভাড়াপুলি, চাঁদ পাকন পিঠা, ভেজিটেবল ঝাল পিঠা, ভাপা পিঠা, পুলি পিঠা, নারিকেল পুলি পিঠা, ভাপা কুলি পিঠা, পাটিসাপটা, লাল পাটিসাপটা, পাকন পিঠা, লবঙ্গ লতিকা, পাটিসাপটা, ফ্রায়েড মেমো, গোলাপ, হৃদয় হরণ, শঙ্খ, স্পঞ্জ, গোকুল, ম্যারা, মিষ্টিপুলি, পায়েস রোল, সেমাই, রস, নকশি, দুধ কুশলি, কমলা, পেয়াজু, গাজরের মিষ্টিপান, সুজি, ডিমের ঝাল পাটিসাপটা, নুডলস পাকৌড়া, চিতই, মন মহিনী, খাস্তা, তেল, তালের, খির চমচম, খেজুর, দুধপুলি, পুতুল, জামাই, বিস্কুট, রসে ভেজা সূর্যমুখী পিঠা, তালের পিঠাসহ রকমারি স্বাদ ও নকশার পিঠা। এ যেন পিঠাদের মিলনমেলা।
অংশ নেওয়া স্টলগুলো একটির নাম শিখার সখ। নিজের নামেই স্টলের নামকরণ করেছেন তিনি। ৩৫ ধরনের পিঠা স্থান পেয়েছে তার স্টলে। কথা হয় শিখার পুত্রবধূ রেহনুমার সাথে। তিনি বলেন, পুরো কৃতিত্ব আমার শাশুড়ি মা ও তাঁর সঙ্গীদের। পিঠাগুলো বানানোর জন্য কত রাত যে তারা জেগে ছিলেন, বলে বুঝাতে পারবো না। অনেক পিঠার নাম জানি না। আমরা এ প্রজন্ম এ বিষয়ে কখনো ইন্টারেস্ট দেখাইনি। ডেজার্টের প্রতি ক্রেজ আমাদের। অথচ এ পিঠাগুলো কতোটা মমতা নিয়ে বানাচ্ছেন তা দেখে চমকে উঠেছি। এ ঐতিহ্য আবারো ফিরিয়ে আনা উচিত বলে তিনি মানেন।
অলকানন্দা স্টলের কর্ণধার রুবামা শারমিন বলেন, তার স্টলে ২২ ধরনের পিঠা আছে। সাথে আছে ঘরে তৈরি আচার ও খেজুর গুড়। খাবারের সাথে মনের আনন্দ যোগ করেছে স্টলে রেখেছেন বিভিন্ন ধরনের গাছের চারা। তিনি বলেন, বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে পিঠাপুলি তৈরির আগ্রহ তৈরি হচ্ছে। আমি শেখাই। তারা পিঠা তৈরির বিভিন্ন টেকনিক শিখতে আমার কাছে আসে। চালের গুঁড়ো শুধু নয়, মসুর ডাল, মুগ ডাল কিংবা গাঁজর দিয়েও যে পিঠা তৈরি হতে পারে, তা দেখা গের তার স্টলে।
পারিজাত স্টলটি দিয়েছেন নিবেদিতা বড়ুয়া। তার স্বামী চট্টগ্রামের কৃতী সংস্কৃতি কর্মী ডা. ভাগ্যধন বড়ুয়া বলেন, আগেকার দিনে পিঠা তৈরির ব্যাপারটি ছিল একটা উৎসবের মতো। মনের টান না থাকলে পিঠা বানানো যায় না। এটা একটা শিল্প। মানুষকে খাইয়ে যে শান্তি পাওয়া যেত তা অমূল্য। মেয়ের বাড়িতে পিঠা পাঠাতে হবে, অতিথি আপ্যায়ন করতে হবে, সবকিছু মিলে গ্রাম বাংলার চিরায়ত এই ঐতিহ্য সভ্যতার ক্রম বিকাশের সাথে সাথে হারিয়ে যাচ্ছে। এ ধরনের উৎসব আয়োজনের মাধ্যমে সেই ঐতিহ্যটাকে ধরে রাখার চেষ্টাটুকু অবশ্যই সাধুবাদ পাওয়ার মতো। উৎসব প্রাঙ্গণজুড়ে একটা কালারফুল আবহ, দারুণ লাগছে।
উৎসবে আরো অংশ নিয়েছে সেতারা বেগমের দুইটি স্টল কর্ণফুলী ও হালদা। আছে ফেরদৌস ইয়াসমিনের স্টল ফুড বাজ, মুরতুজা বেগমের এ অ্যান্ড জেড ক্যাটারিং, নাজমুন নেছা বেগমের খায় য লয় য ও চিটাগাং সিনিয়রস্’ ক্লাব লিঃ। উৎসবে সদস্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন মো. গোলাম মোস্তফা কাঞ্চন, ফিরোজ আহম্মদ, ইঞ্জিনিয়ার পরিমল কান্তি চৌধুরী, ডা. সরফরাজ খান চৌধুরী, নোয়েল জি. ম্যান্ডেস, বেলায়েত হোসেন, মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম, কাজী মাহ্মুদ ইমাম (বিলু), গোপাল কৃষ্ণ লালা প্রমুখ।