আজ বেশ কয়েকদিন হলো একটা কাজ নিয়ে ছুটছি। যথেষ্ট জটিল বিষয়। বিষয়টি রাজনৈতিক বলয়ের মধ্যে ফেলে করতে হচ্ছে। আগে-পিছে অনেক বিষয় মাথায় নিয়ে এগুতে হচ্ছে। যদিও এই কাজটির আগে আরেকটি বিষয় নিয়ে লিখব বলে অদেখা বন্ধু রাজু আলাউদ্দিনকে কথা দিয়েছিলাম; বিষয়টি শহীদুল জহিরকে নিয়ে অনুবাদক ভি রামস্বামী ও শাহরোজা নাহরিনের সাক্ষাৎকার ও আমার পর্যালোচনা, সাথে অনুবাদ সাহিত্যের তাত্ত্বিক বিষয়ের গুঢ়তা এবং এর ভেতরের রহস্য নিয়ে কথাবার্তা। লেখাটা কিছুদূর এগিয়ে আলটপকা রাজুকে ফোন দিয়ে জানালাম এই বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু এই মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছে দেশের বতর্মান রাজনীতির উথালপাতালের মধ্যে ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ নিয়ে কথা বলাটা অতীব জরুরী। লেখার শিরোনাম ঠিক করলাম:
“বাঙালি জাতীয়তাবাদের বৃত্তের মধ্যে নব্য দেশী প্রাচ্যবাদীদের বিভ্রম ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উপর সাংস্কৃতিক আধিপত্য”। রাজুকে বলতেই তার আগ্রহের কমতি দেখলাম না। বেশ উৎসাহ এবং সাহস পেলাম কাজটা এগিয়ে নিতে, যেহেতু রাজুর দর্শন শাস্ত্র , শিল্প ও সাহিত্য বিদ্যাবত্তার ওপরে আমার ভীষণ আস্থা। এই আস্থাটা তৈরি হয়েছে ওর লেখালেখি ও পড়ার ভেতর দিয়ে, এবং একইভাবে মাঝেমধ্যে ফোনে কথাবার্তা ও আলাপচারিতার ভেতর দিয়ে। লেখাটি মাঝামাঝি পর্যায়ে এসে যখন আমি প্রাচ্যতত্ত্বের মূল বিষয়; “প্রাচ্যতত্ত্ব আসলে সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যের নিমিত্তে ব্যবহারিক ও সাংস্কৃতিক বৈষম্যের একটি পদ্ধতি হিসেবে কাজ করে বলেই এই দাবিটি ওরা প্রতিষ্ঠা করেছিল যে পাশ্চাত্যের প্রাচ্যতাত্ত্বিকরা প্রাচ্যের প্রাচ্যতাত্ত্বিকদের চেয়েও প্রাচ্য সম্পর্কে অনেক বেশি জানেন”, এবং পাশাপাশি অ্যান্টোনিও গ্রামসির তত্ত্ব ‘নিম্নবর্গ’-এর ভেদাভেদ নিয়ে বাহাসটা ওঠাবার চেষ্টা করছিলাম আমাদের সমকালীন জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ফানুস ও ভূ-রাজনীতির বলয়ের ভেতর থেকে। অনেকটা এইভাবে যে, ‘নিম্নবর্গ বলতে গ্রামসি এমন ধরনের গোষ্ঠীগুলোকে বুঝিয়েছেন যারা রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের প্রতিষ্ঠিত কাঠামোর বাইরে থাকে’। যেমনটি আমাদের সাঁওতাল, ধাঙড়, বুনো বা অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরা। এটার সমর্থনের জায়গাটি খুঁজছিলাম গ্রামসির ইতিহাস ও জাতীয়তাবাদ সম্পর্কিত সমালোচনামূলক প্রবন্ধগুলোর ভেতরে।
কাজটা নিয়ে মধ্যরাত অবধি লড়াই চলছে, রেফারেন্স বইগুলোর পাতা যখন ওলটপালট করছি ঠিক তখনই মুঠোফোনে শব্দ। নাট্যনির্দেশক ও প্রফেসর বন্ধু জনাথনের কন্ঠ, আমাদের দুজনেরই প্রিয় মানুষ, নির্দেশক ও তাত্ত্বিক পিটার ব্রুককে হারাবার সংবাদ। বেশ কিছুক্ষণ দুজনেই নিস্তব্ধ। কোনো কথা নেই। ফোন ছাড়ার আগে ও জানতে চাইলো, ‘তুমি প্যারিসে আসবে’? উত্তরে বললাম ‘দেখি’! প্রত্যুত্তরে বললো, ‘যদি তুমি আসো তবে দেখা হবে’, বলেই ফোনকল মুছে দিল। বেশ কিছুক্ষণ সময় কেটে গেল। ভাবছি ; মানুষের চলে যাবার গল্পের ফ্যালাসি :
‘মানুষ মরে না,
পৃথিবীই মরে যাচ্ছে মানুষের কাছ থেকে’।
ভাবতে ভাবতেই চোখ আটকে পড়লো Edvard Munch-এর ডায়েরি: “A Ghost I Leave You – এর ওপরে। বইয়ের আলনা থেকে টেনে ডায়েরির পাতাটা ফোঁড়াফুঁড়ি করতেই অজান্তে বেরিয়ে পড়লো গঁহপয এর শিল্পভাবনার খোলামেলা কথা:
`A good picture never disappears
A brilliant thought does not die…’
Munch–এর ভাবনাটির গভীরে আমি কোথায় যেন ব্রুক ও ব্রুকের ভাবনার মিল পাই পারস্পরিক কান্তিবিদ্যার কেন্দ্রগত অবস্থানে: “Brilliant thought”-এর সঙ্গে “Something new”-এর সংযোগ। এখানেই ব্রুকের সৃজনশীলতার রহস্য- “ Each time one must think up something new. ” িব্রুকের কথার পিঠে কথা রেখে বলতেই হয়, নতুন কিছু সৃষ্টি যদি নাই করা যায় তবে শিল্প হয়ে পড়ে মৃত। যেটা এই মুহূর্তে ঘটছে; এখানে, ওখানে, সবখানে, জাতীয়তাবাদের নামে।
আমাদের এখন বোঝার সময় এসেছে; শিল্পকে কেন, কোন সময়ে এবং কোন কৌশলে আধুনিকতার কাছ থেকে সরিয়ে পেছনের দিকে জোর করে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, “শেকড়ের সন্ধান” নাম দিয়ে, এবং পাশাপাশি এটাও আমাদের বুঝতে হবে বাঙালি সংস্কৃতির ‘স্বখাতসলিল’ থেকে জল উঠাতে গিয়ে কেন পানি গড়িয়ে পড়ছে সাংস্কৃতিক আধিপত্যের সরোবরের মধ্যে? হয়তো সেটা নিয়ে সরাসরি কিছু খোলা কথা হবে আগামীতে, কিন্তু আজ পিটার ব্রুকের থিয়েটার ভ্রমণের স্থানান্তর বিন্দুগুলোর ওপরে কালিকলমের ঘষাঘষিতে দেখার চেষ্টা করি তাঁর থিয়েটারের রঙ ও রেখার বুনন প্রক্রিয়ার ধোঁয়া। এই লেখাতে আমি ব্রুকের তত্ত্ব ও প্রয়োগের ভেদ, ভেদবুদ্ধি বা ভেদাভেদ নিয়ে কথা বলছি না। কথাগুলো বলছি পিটার ব্রুক আর আমার নানা সময়ের আড্ডার বিষয়ের নোটবুকের পাতা থেকে, বিশেষ করে ২০০৭-২০০৮ সালে, যখন আমি International Ibsen Awardকমিটির জুরি বোর্ডের সদস্য। শুরুতেই পুরস্কারটি দেওয়া হয় পিটার ব্রুককে। এই পুরস্কারের জন্য বিশ্ব-থিয়েটারের বহু নামিদামি নির্দেশকদের নাম বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে বহু গুণী ও জ্ঞানী মানুষেরা মনোনীত করে পাঠান; যেখানে এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ থিয়েটার ডিরেক্টরদের নাম বাদ পড়েছিল বলে মনে পড়ে না। এটা বিশ্ব-থিয়েটারের সবচেয়ে বড় পুরস্কার; অর্থ ও সম্মান উভয়দিক থেকে। এই পুরস্কারের সম্মানী ২.৫ মিলিয়ন। পুরস্কারটির সামগ্রিক দায়িত্বে ‘নরওয়ের সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়’, সহযোগিতায় ‘ন্যাশনাল থিয়েটার’। বিভিন্ন কারণে আমাকে বহু বছর এই কমিটিতে সক্রিয়ভাবে কাজ করতে হয়েছিল। প্রথম কমিটির কার্যক্রম শুরু হয় ২০০৭ সালে বিশ্ব-থিয়েটার ও চলচ্চিত্রের একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী খরা টষষসধহ এর নেতৃত্বে। তার আরো একটি পরিচয়, তিনি ছিলেন Ingmar Bergman -এর সঙ্গিনী, এবং নরওয়ের লেখিকা Linn Ullman হচ্ছেন খরা Liv Ullman I Bergman- -এর কন্যা।
Ingmar Bergman -এর সাথে আমার পরিচয় ১৯৯০-এর দশকে Stockholm -এর“The Royal Dramatic Theatre ”-এ তাঁর নির্দেশিত নাটক দেখার মাধ্যমে। এই সময়ে তিনি চলচ্চিত্রের চেয়ে পূর্ণমাত্রায় মনোযোগী ছিলেন থিয়েটারের প্রতি, কেবলই থিয়েটার। তাঁর সঙ্গে একবার আমার আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছিল মূলত Shakespeare, Moliere, Ibsen, Strinberg, Brecht-কে নিয়ে। এটা ছিল অনেকটা আমার আগ্রহের জায়গা থেকে, কারণ আমি ততোদিনে এই সকল নাট্যকারদের বেশকিছু নাটক নির্দেশনা দিয়ে ফেলেছি এবং এদের নাট্যসাহিত্য সম্পর্কে কথা বলবার বা আলোচনা করবার সাহসটা অর্জন করেছি; যে-কারণে তাঁর সাথে আলোচনার মাঝেমাঝে কথা এবং কথার রেশ ধরতে আমার কোনোরকম অসুবিধা হচ্ছিল না। ঝযধশবংঢ়বধৎব নিয়ে কথা বলার এক পর্যায়ে আমাদের দুইজনের আলোচনায় ঢুকে পড়লো Jan Katt এর Shakespeare নিয়ে দুর্দান্ত আলোচনা- Shakespeare Our Contemporary”-এর দার্শনিক ও তাত্ত্বিক পর্যালোচনা। আলোচনার এক ফাঁকে পিটার ব্রুকের কথাও উঠে আসলো। আলোচনার শেষের দিকে আসতেই উনি মনে করিয়ে দিলেন পিটার ব্রুকের- “King Lear”-এর নির্মাণ-কৌশল ও ব্যাখ্যা। কীভাবে ব্রুক, তাঁরKing Lear”-কে যুক্ত করে ফেললেন Samuel Beckett- এর Endgame ” এর সঙ্গে। তাঁর মতে, ব্রুকের সাহসের পেছনে ছিল Jan Kott -এর কথা:”Reborn in the imagination of another। সোজাসাপ্টা বাংলায় বলতে গেলে ব্রুকের কাজটি হয় উঠেছিল- অন্যের কল্পনায় পুনর্জন্ম। আর সেই জন্যে তাঁর থিয়েটারের ভেতরে জন্ম নিলো এক ‘নতুন থিয়েটার’; যে থিয়েটারের সীমানার বাইরে ছিল জাতি, জাতিগত প্রশ্ন, জাতীয়তাবাদ এবং ধর্ম। যে কারণে তাঁকে আমি বলি একজন ভয়ঙ্কর প্ররোচনাকারী প্রৌঢ়-কিশোর নাট্যপরিচালক। এর প্রমাণ প্যারিসে তাঁর প্রতিষ্ঠান, International Centre for Theatre Research (CIRT । যে প্রতিষ্ঠানের প্রধান উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ছিল বিশ্ব-থিয়েটারের খোঁজ এবং থিয়েটারকে সনাতন কাঠামোর বাইরে এনে পরিচালক ও অভিনেতাদের মধ্যে একধরনের স্বাধীন সম্পর্ক তৈরি করার কৌশল আবিষ্কার করা। যার সূত্রপাত আমাদের অঞ্চলের মহাকাব্যের রূপান্তরিত ইউরোপীয় ভাষ্য “দ্য মহাভারত”। এই কাজটি করতে যেয়ে তিনি সমস্ত পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি, ভাষা ও জাতিগোষ্ঠীর অভিনেতাদের একত্রিত করলেন সংস্কৃতির সংযোগ বা “culture of links”- -কে খুঁজে বের করার জন্য। এটা করতে যেয়ে বেরিয়ে এলো; “মানুষ ও সমাজের মধ্যে সম্পর্ক, একটি জাতি এবং অন্য জাতির মধ্যে সম্পর্ক, মাইক্রোকজম এবং ম্যাক্রোকজমের মধ্যে সম্পর্ক, মানবতা এবং যন্ত্রের মধ্যে সম্পর্ক, দৃশ্যমান এবং অদৃশ্যের মধ্যে সম্পর্ক, এক ভাষার সাথে অন্য ভাষার অন্তরঙ্গতা এবং ভাষার অন্তর্গত অন্তদর্শনের অন্তর্দ্বারকে আবিষ্কারের অন্বেষণ। তিনি এই পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রটি তৈরির জন্যে বেছে নিলেন ‘Bouffes du Nord’ নামের এক জরাজীর্ণ থিয়েটার। একের পর এক নতুনের সৃষ্টি। দেখবার সুযোগ হয়েছিল The Conference of the Birds, The Cherry Tree and La Tragedie de Carmen তিনটি প্রযোজনাই। এক অসাধারণ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি আমি হয়েছিলাম। এ যেন Stanislavski, Artaud, Brecht, Meyerhold, Craig এবং Zeami সকলের সঙ্গে তাঁর একরূপতার এক অবিসংবাদিত সংযোজন।
যাক সে কথা, এবার ফিরে আসি International Ibsen Award কমিটির অন্য কথায়। আমার বাইরে জুরি বোর্ডের অন্যান্য সদস্য ছিলেন: নরওয়ের প্রথম সারির চলচ্চিত্র ও মঞ্চ অভিনেত্রী এবং লেখক Anna Bache-wii , আমেরিকান সাহিত্যের প্রফেসর yvind Gulliksen , ডেনমার্কের অত্যন্ত উঁচুমানের চলচ্চিত্র ও মঞ্চের অভিনেত্রী National Theatre , সুইডেনের শিল্প সমালোচক খবরভ তবৎহ এবং নরওয়ের ঘধঃরড়হধষ ঞযবধঃৎব- এর অৎঃরংঃরপ উরৎবপঃড়ৎ ঊৎরশ ঝঃঁনধ. এদের মধ্যে আমিই একমাত্র বাদামি রঙের জুরি সদস্য; যে ছিল অন্য বলয়ের মানুষ। যদিও আমি তখন অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইবসেন স্টাডিজের গবেষক। গবেষণার মূল কেন্দ্রে ছিল আমার নির্দেশিত সেন্টার ফর এশিয়ান থিয়েটারের প্রযোজনা হেনরিক ইবসেনের “ব্র্যান্ড”। গবেষণার শিরোনাম ছিল: “ Contemporary political relevance of Ibsen’s Brand- the case of Islamic fundamentalism”। গবেষণা পত্রটি প্রকাশিত হয় ২০০৭ সালে ইবসেন স্টাডিজ জার্নালে। (Ibsen Studies ; Volume 7, Issue 1, June 2007 .)
এখানে আরেকটু খোলাসা করে না বললেই নয়, আর সেটা হচ্ছে ২০০৬ সালে নরওয়ের আন্তর্জাতিক ইবসেন কনফারেন্সে আমি ছিলাম একজন প্রধান বক্তা, এবং আমার বক্তৃতার বিষয়ও ছিল “ব্র্যান্ড” নাট্যপ্রযোজনার কৌশল ও ধারণা, পাশাপাশি “ব্র্যান্ড”-এর প্রযোজনায় ‘রাজনৈতিক ইসলামের’ সমন্বয়। বক্তৃতা শেষে তুমুল আলোচনা ও সমলোচনা শুরু হলো নরওয়ের প্রধান প্রধান পত্রিকাগুলোতে: ‘আফটেনপোস্টেন’ (২৪ আগস্ট ২০০৬); ‘ডাগব্ল্যাডা’ ( ১ অক্টোবর ২০০৬); ‘ভেগা’ (২৪ আগস্ট ২০০৬); ‘ক্লাসেক্যাম্পেন’ (৩০ মার্চ ২০০৬); শুরু হলো নানা বাকবিতণ্ডার ঝড়। কেউ আমার পক্ষে বলছে, আবার কেউ আমার বিপক্ষে। কেউ আবার একটা মাঝামাঝি পথ ধরে কথা বলছে। সে এক দারুণ অভিজ্ঞতা। এককথায় সকলের দৃষ্টি আমার দিকে। আমি না চাইলেও আমাকে কথা বলতে হচ্ছিলো আমার ডিসকোর্স এবং কাউন্টার ডিসকোর্সের বিষয় নিয়ে। যেটা ছিল ‘জ্ঞানতত্ত্বের বিশ্ববাজারে একজন খাঁটি বাঙালির নতুন ভাবনা-চিন্তার জয়জয়কার’। এই রকম তর্কাতর্কির মুখোমুখি হবার অভিজ্ঞতা যে কেবল আমার নরওয়েতেই হয়েছে সেটাই নয়; এইরকম চিৎকার চেঁচামেচি আমাকে যেমন আর্জেন্টিনাতে শুনতে হয়েছে, তেমনি ভারতে, এমনকি দেশের মাটিতেও। সেই অভিজ্ঞতার ভাগীদার হয়তো আপনারা অনেকেই! পূর্বের কথা নাইবা মনে থাকুক, অন্তত দেশের মাটিতে আমার শেষ নির্দেশনা “স্তালিন” নাটকটি, যেটার বাংলা ভাষ্য ছিল রায়হান আখতারের, সেটার কথা নিশ্চয়ই ভুলে যাননি! এইসব কথা হয়তো আরো খোলামেলা বলা যাবে সামনে, যদি ক্ষয়ে না যাই। সে অনেক অভিজ্ঞতা, অনেক অজানা কথা…।
প্রসঙ্গক্রমে একটা কথা বলে নিচ্ছি, সেটা হচ্ছে পিটার ব্রুকও কিন্তু রক্ষা পায়নি ‘সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদী’ খেতাবের হাত থেকে। ‘মহাভারত’ নির্মাণের পরই তাঁকে এই তকমা জুড়ে দিয়েছিল আমাদের অঞ্চলের নব্য-প্রাচ্যবাদীদের দলটি। এই ধারার প্রাচ্যবাদীদের সৃষ্টি ঔপনিবেশিকদের দ্বারাই এবং যাদের বসবাস উত্তর-ঔপনিবেশিকতার ভেতরে। যাদেরকে সমাজ ও রাষ্ট্রের কাঠামোতে “বিশিষ্টজন” বলে চিহ্নিত করা হয়। এদের সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হলে, প্রিয় পাঠক, সময়করে নীচের দু’টি বই পড়বেন:
১) Black Skin White Masks; Frantz Fanon
২) Brown Skin White Masks; Hamid Dabshi
এই দুটি বইয়ের ভেতরেই বসবাস করছে Comprador intellectual”-দের ভূমিকা এবং অবস্থান। যাদেরকে আমাদের ভাষায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘ ‘বেনিয়ান বা কদলী বুদ্ধিজীবী’। এইরকম একজন কদলী বুদ্ধিজীবী পিটার ব্রুকের সৃষ্টি “মহাভারত”-কে বললেন- “ব্রুকের ‘মহাভারত’ একটি সাংস্কৃতিক সালাদ”। এই সালাদের উপাদানগুলো বিশ্বের প্রায় সকল জায়গা থেকে আনা হয়েছে, তবে সালাদের ড্রেসিংটা ব্রুকের ঘরে বানানো, যাতে করে সালাদটি হয়ে উঠেছে ব্রুকের মুখের স্বাদ”। “ব্রুকের ‘মহাভারত’ কিছুই হয়নি। এটি একজন নির্বোধের বলা গল্প, শব্দ এবং ক্রোধে পূর্ণ, কিছুই বোঝা যায় না”। হ্যাঁ, “কিছুই বোঝা যায় না” (?) একটি চমৎকার প্রশ্নবোধক শব্দ ! এই একই ধরনের কদলী বুদ্বিজীবীদের (নির্দিষ্ট) বাগবৈশিষ্ট্যের সাথে আমার প্রথম পরিচয় ২০১৪ সালে সেন্টার ফর এশিয়ান থিয়েটারের প্রযোজনা, আমার নির্দেশনা, আনিকা মাহিনের গধপধনৎব নাটকের উদ্বোধনী প্রদর্শনীর পরপরই। এ নিয়ে হবে কথা একদিন। হবেই হবে।
যাক আবারো ফিরে আসি ব্রুক ও “মহাভারত”-এর অভিযোগ প্রসঙ্গে। এই ধরনের গড়গড়ে অভিযোগের বসবাস উত্তর-ঔপনিবেশিক দেশগুলোর জ্ঞানতাত্ত্বিক জগতের মধ্যে। এটা একটা চিরাচরিত মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা। “ব্রুকের ‘মহাভারত’ একটি সাংস্কৃতিক সালাদ”- একটা শব্দ! ভয়ঙ্কর শব্দ! একটা আওয়াজ! একটা হৈচৈ! একটা হট্টগোল! একটা চেঁচামেচি! সমগ্র পৃথিবী নড়েচড়ে বসলো। বাহাসের পর বাহাস সৃষ্টি হতে থাকলো। জন্ম নিতে থাকলো যেমন নতুন নতুন ডিসকোর্সের; তেমনি তৈরি হতে থাকলো কাউন্টার ডিসকোর্সের। ব্রুকের কথা ধরেই ওদেরকে বলছি, “একজন মানুষ যখন একা একটা ফাঁকা স্থানজুড়ে হেঁটে যাচ্ছে তখন অন্য কেউ যেন তাকে দেখছে…”।
আন্তঃসংস্কৃতির শুদ্ধ ও অশুদ্ধ প্রয়োগের ডেলা-ডেলি শুরু হয়ে গেল। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের পণ্ডিতরা জ্ঞানের ঝোলা থেকে বের করে আনলেন, “Self” এবং “Other”-কে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে। তর্কাতর্কিতে মহাভারতের নতুন সৃষ্টিকর্তা পিটার ব্রুক হয়ে পড়লেন ভারতীয়দের চোখে এক “অশুদ্ধ মানুষ”। এইসব নিয়ে ব্রুকের সাথে কথা হয়েছে বহুবার। বিভিন্ন থিয়েটার সেমিনার ও ক্লাসরুমে এই বিষয় নিয়ে কথা বলতে হয়েছে। অসলোতে বসে ব্রুকের কাছ থেকে তাঁর নিজের থিয়েটারের অভিজ্ঞতার গল্প বলার এক ফাঁকে “মহাভারত” নিয়ে কথা বলার এক পর্যায়ে বললেন- “প্রতিটি সংস্কৃতিই নিজের অভ্যন্তরীণ অ্যাটলাসের আলাদা আলাদা অংশ প্রকাশ করে। কিন্তু ‘সম্পূর্ণ মানবের সত্য’ বিশ্বব্যাপী। থিয়েটার এবং একমাত্র থিয়েটারের সাহায্যেই এর ধাঁধাগুলো কাটিয়ে ওঠানো সম্ভব এবং এটার ভেতরের ‘Jigsaw-র টুকরাগুলো একত্রিত করা সম্ভব। আর সে-জন্যেই ‘মহাভারত’-এর গল্পটা বলার জন্যে ভারতের জাতিগত জায়গাটা খুব জোরালোভাবে এড়াতে হয়েছিল, যাতে আমাদেরকে ‘মানুষ’-এর পরিচয় থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে না যায়। আমি আবারো বলছি, ‘মহাভারত’-এর গল্পটাতে আমরা বলতে চেয়েছিলাম ‘মানুষ’-এর” গল্প, কোনো জাতিগত অথবা জাতিতত্ত্বের গল্প নয়”। আলোচনার গভীরে যেতেই এক পর্যায়ে আমার কাছে মনে হলো ব্রুক তাঁর ‘গল্প’-কে কোনোভাবেই ‘ভারতীয় মাটিতে প্রোথিত’ করতে চাননি; যদিও গল্পটি ভেসে বেড়াচ্ছিল এক ধরনের মেক-বিলিভ ভারতের আকাশে, কল্পনা আর বাস্তবতার মাঝখানে, না এখানে, না ওখানে। আর তাই আমি বিশ্বাস করি পিটার ব্রুকের “মহাভারত” মানব ও মানবসভ্যতার সর্বজনীন অর্থের সাথে যুক্ত। সমকালীন “হিন্দুত্ববাদী” ভারতীয়দের স্বপ্নের “ভারত”-এর সঙ্গে নয়।