পিটাছড়ার বনে অতি দুর্লভ লাল মাথা কুচকুচি

সমির মল্লিক, খাগড়াছড়ি | শনিবার , ১৮ জানুয়ারি, ২০২৫ at ৫:৩৬ পূর্বাহ্ণ

প্রায় তিন বছর প্রচেষ্টার পর খাগড়াছড়ির বনে অতি দুর্লভ পাখি লাল মাথা কুচকুচির দেখা পেলাম। লাল মাথা ট্রোগন নামেও পাখিটি পরিচিত। পিটাছড়ার বনে মাঘের মধ্যদুপুরে পাখিটির দেখা মিলেছে। পাহাড়ে পাখি ও বন্যপ্রাণীর ছবি তোলার কারণে প্রায় জঙ্গলে ঘুরে বেড়াই। তবে লাল মাথা কুচকুচির দেখা পাওয়া যায়নি। এবার মিলল। খাগড়াছড়ি জেলা সদর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে মাটিরাঙার পিটাছড়া বনে পাখিটির দেখা মিলেছে। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হওয়ায় পুরুষ ও স্ত্রী পাখি উভয়ের দেখা পেয়েছি। অনেকটা সংশয় নিয়ে সকালে খাগড়াছড়ি থেকে পিটাছড়ার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। মোটরসাইকেলে প্রায় ১ ঘণ্টা সময় লাগে। পাহাড়ি পথ ধরে পিটাছড়া পৌঁছাই দুপুরে। পিটাছড়া বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের উদ্যোগের প্রতিষ্ঠাতা মাহফুজ রাসেল আমাদের স্বাগত জানালেন। মাঘের দিন হলেও শীতের অনুভব নেই। আলো ঝলমলে পিটাছড়ার বন। পিটা মেহগিন, কড়ই, জামসহ অসংখ্য ছোটবড় গাছে ভরা জঙ্গল।

জঙ্গলে গিয়ে দাঁড়াতেই চোখে পড়ল বহুল প্রত্যাশিত সেই লাল মাথা ট্রোগান। দ্রুত পাখিটির ছবি তোলার চেষ্টা করলাম। প্রত্যাশিত পাখিটির দেখা পেয়ে কিছুক্ষণ অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিলাম। বিস্ময়ের ঘোর কেটে আবার ছবি তোলা শুরু করলাম। কিছুক্ষণ পরে এসে যোগ দিল আরেকটি ট্রোগন। একসাথে পাশাপাশি দুটো ট্রোগনের দেখা পাওয়া অনেকটা ‘স্বপ্নের মতো’। কিছুক্ষণ পরে পাখি দুটো পাহাড়ের উপর থেকে নিচের ঝিরির বনে নেমে যেতে লাগল। ঝিরির পাশের বনেও বেশ কয়েকবার একবার দুটোর দেখা পেলাম। ক্যামেরার শাটারে যেন জঙ্গলের নীরবতা ভাঙছে। লাজুক পাখি ট্রোগন প্রায় ২০ মিনিট সময় দিল। এর মধ্যেই কয়েকশ ছবি তোলা হলো। ঘন জঙ্গলের কারণে ঠিকভাবে ছবি তোলা কষ্টসাধ্য। পিটাছড়া বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ উদ্যোগের প্রতিষ্ঠাতা মাহফুজ রাসেল বলেন, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে এক জোড়া লাল মাথা কুচকুচির দেখা মিলছে। সকাল ও বিকালে তাদের দেখা যায়। তিন বছর আগে প্রথমবারের মতো ট্রোগনের দেখা মিলেছে। এরপর প্রতি বছরই শুষ্ক মৌসুমে ট্রোগন দেখা যায়। বর্ষায় ঘন জঙ্গলের কারণে দেখা যায় না। এখানে অন্তত দুই জোড়া ট্রোগন রয়েছে। পিটাছড়ার জঙ্গলে শিকার নিষিদ্ধ। ফলে এখানে পাখি ও বন্যপ্রাণীর বিচরণও বেশি। আমরা পাখি ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের পাশাপাশি নিবিড় প্রকৃতি নির্ভর পাহাড় গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালাচ্ছি।

লাল মাথা কুচকুচি শান্ত ও লাজুক পাখি। ঘন প্রশস্ত পাতার চিরসবুজ বন ও মিশ্র বাঁশবনে বিচরণ করে। পাহাড়ি বনভূমিতেই এরা বাস করে। বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটের বাইরে লাল মাথা কুচকুচি দেখা যায় না। এপ্রিল থেকে জুলাই এদের প্রজননকাল। এ সময় ঘন বনে বৃক্ষের প্রাকৃতিক কোটরে কিংবা কাঠঠোকরার শূন্য গর্তে বাসা করে। বাসায় ৩৪টি ডিম পাড়ে। এদের দৈর্ঘ্য ৩৫ সেন্টিমিটার, লেজ ১৯.২ সেন্টিমিটার। পুরুষ কুচকুচির চেহারা স্ত্রী কুচকুচির থেকে কিছুটা আলাদা। পুরুষ কুচকুচির মাথা, ঘাড়, গলা ও বুক সিঁদুরে লাল। পেটের দিকের বাকি অংশ উজ্জ্বল গোলাপি। বুকের লাল ও গোলাপির মাঝখানে একটি সাদা অর্ধবলয় থাকে। লেজ ক্রমান্বয়ে ছোট থেকে বড় পালকে গড়া। পিঠ থেকে লেজ হালকা দারুচিনি বা মরচেবাদামি রঙের। ঠোঁটের কোণা, পা ও পায়ের পাতা বেগুনি। ঠোঁটের উপরের পাটি বেগুনিনীল ও নিচের পাটি কালো বর্ণের। স্ত্রী কুচকুচির সারা শরীর দারুচিনি রঙের। লাল মাথা কুচকুচি বাংলাদেশের দুর্লভ আবাসিক পাখি। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২ অনুসারে এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত।

খাগড়াছড়ির বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. ফরিদ মিঞা বলেন, পাখিসহ বন্যপ্রাণী রক্ষায় বন বিভাগ খুবই সতর্ক। ইতোমধ্যে আমরা কয়েকটি এলাকায় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে সচেতনতামূলক প্রোগ্রাম করেছি। তবে ট্রোগন বা লাল মাথা কুচকুচি যেহেতু খুবই দুর্লভ প্রাণী, এটি সংরক্ষণে আমাদের বাড়তি মনোযোগ থাকবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিছানায় গৃহবধূর লাশ, স্বামী পলাতক গ্রেপ্তার ১
পরবর্তী নিবন্ধসংসদে কোনো নারী কোটা থাকা যাবে না : ইসলামী আন্দোলন