পাহাড়খেকোদের মোকাবেলা করতে হবে শক্ত হাতে

| সোমবার , ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৬:০৩ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামে পরিবেশ আইন না মেনে পাহাড় কাটা চলছে দেদারছে। বাড়ি নির্মাণ, রাস্তা সংস্কার এবং ইটভাটাসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহারের জন্যও পাহাড় কাটছে একটি চক্র। পাহাড়ের মাটি কেটে ট্রাকে করে নিয়ে যাচ্ছে পাহাড়খেকোরা। দিনের আলোয় পাহাড় কাটা চললেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন পরিবেশকর্মীরা। গত ১৮ সেপ্টেম্বর দৈনিক আজাদীতে ‘নাগিন পাহাড় বাঁচবে না? রাতের আঁধারে মাটি নিয়ে যান প্রভাবশালীরা, পাহাড়ি ভূমিতে তৈরি হচ্ছে ভবন’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘সমুদ্র, নদী, পাহাড়ের মেলবন্ধন রয়েছে চট্টগ্রামে। প্রাকৃতিক অপার সৌন্দর্যের নগরীর পাহাড়গুলো একে একে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। প্রভাবশালী ভূমিপুত্রদের কুনজরে হারিয়ে যাচ্ছে বেশিরভাগ পাহাড়। কেউ কাটছে কৌশলে, কেউ কাটছে দিনদুপুরে কিংবা রাতে। চট্টগ্রাম নগরীতে এ ধরনের অসংখ্য পাহাড়ের একটি বায়েজিদ বোস্তামী এলাকার নাগিন পাহাড়। পরিবেশ অধিদপ্তর জরিমানা করে দায় সারলেও ঠেকানো যাচ্ছে পাহাড় কাটা। আবার ধসে পড়া মাটিও রাতের আঁধারে সরিয়ে নেয় প্রভাবশালী এবং দুষ্কৃতকারীরা। এভাবে নাগিন পাহাড়ের আশেপাশে পাহাড়ি ভূমিতে তৈরি হচ্ছে একে একে অট্টালিকা। প্রশ্ন উঠেছে, নাগিন পাহাড়কে রক্ষার দায় কার?’
প্রতিবেদনটিতে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগর কার্যালয়ের পরিচালক ও চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের বক্তব্য সংযোজন করা হয়েছে। তাতে দেখা যায়, তাঁরা পাহাড় কাটার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং পাহাড় রক্ষায় প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন।
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগর কার্যালয়ের পরিচালক বলেন, ‘বিগত বেশ কয়েকবছর ধরে পাহাড়ি ভূমিতে দালান উঠেছে। দালানগুলো কিভাবে উঠেছে তা প্রশ্ন তৈরি করছে। আমরা আবারও ওই এলাকাটি ভিজিট করবো। ওখানে যতটুকু শুনেছি সিডিএ’র অনুমোদন নিয়েই বহুতল ভবনগুলো উঠেছে। স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন পুরো এলাকাটিতে নাগিন পাহাড়ের অবস্থান ছিল। পাহাড় শ্রেণির জমিতে সিডিএ কিভাবে বিল্ডিং করার অনুমোদন দিয়েছেন, সেটিও আমরা খতিয়ে দেখবো।’ চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার বলেন, ‘চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো বালিমাটিযুক্ত। শুধু দেওয়াল দিয়ে এসব পাহাড় রক্ষা করা দুরূহ। চট্টগ্রামের পাহাড়গুলোকে রক্ষার জন্য ফিজিবিলিটি স্টাডিসহ বিশেষজ্ঞ মতামত নিয়ে একটি প্রকল্প প্রস্তাবনা সরকারের কাছে দেবো।’
চট্টগ্রামের পাহাড় কাটা নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিদ্যা ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক এস এম সিরাজুল হক একটি বেসরকারি সংস্থার হয়ে ২০১১ সালে ‘হিল কাটিং ইন অ্যান্ড অ্যারাউন্ড চিটাগং সিটি’ শীর্ষক এক গবেষণা করেন। এতে বলা হয়, বেশির ভাগ পাহাড় কাটা হয় পাহাড়তলী, খুলশী, বায়েজিদ, লালখান বাজার মতিঝরনা, ষোলশহর এবং ফয়’স লেকে। ১৯৭৬ থেকে ৩২ বছরে চট্টগ্রাম নগর ও আশপাশের ৮৮টি পাহাড় সম্পূর্ণ এবং ৯৫টি আংশিক কেটে ফেলা হয় বলে গবেষণায় উল্লেখ করেন। ১৯৭৬ সালে নগরের পাঁচ থানা এলাকায় মোট পাহাড় ছিল ৩২ দশমিক ৩৭ বর্গকিলোমিটার। ২০০৮ সালে তা কমে হয় ১৪ দশমিক ০২ বর্গকিলোমিটার। এ সময়ে ১৮ দশমিক ৩৪৪ বর্গকিলোমিটার পাহাড় কাটা হয়। এটা মোট পাহাড়ের প্রায় ৫৭ শতাংশ। নগরের বায়েজিদ, খুলশী, পাঁচলাইশ, কোতোয়ালি ও পাহাড়তলী থানা এলাকায় এসব পাহাড় কাটা হয়। সবচেয়ে বেশি ৭৪ শতাংশ কাটা পড়ে পাঁচলাইশে।
এদিকে ২০১৫ সালে ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব ন্যাচারাল অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সেসে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপর এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ‘এনভায়রনমেন্টাল ডিগরিডেশান থ্রো হিল কাটিং ইন চিটাগং ডিসট্রিক্ট অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণাকর্মটি হয় ২০০৫ সালে। এর নেতৃত্বে ছিলেন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক এম এ সাত্তার। এই প্রতিবেদনে বলা হয়, চট্টগ্রাম নগরের খুলশীতে সর্বোচ্চ ৬৩ দশমিক ৬ শতাংশ এবং শহরতলির চৌধুরীহাট এলাকায় সর্বনিম্ন ২০ শতাংশ পাহাড় কাটা হয়। ৫ থেকে ২০ বছরের মধ্যে এসব পাহাড় কাটা হয়। নগর ও আশপাশের ২০০ পাহাড়ের মধ্যে প্রায় ১০০টি কেটে বিভিন্ন আবাসিক এলাকা গড়ে উঠেছে বলে গবেষণায় বলা হয়। এভাবে ধীরে ধীরে উধাও হয়ে যাচ্ছে পাহাড়গুলো।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, পাহাড়গ্রাসী লোভাতুর দখলদারদের মোকাবেলা করতে হবে শক্ত হাতে। কেননা পাহাড়খেকো-দুর্নীতিবাজদের শিকড় গভীর ও শক্তিশালী। এ সমাজে তাঁদের অবস্থান বড় মজবুত। এই জন্যই সচেতন মানুষ, সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান-সংগঠন যতই উচ্চকণ্ঠ থাকুক না কেন, প্রতিদিন রাতের আঁধারে, প্রকাশ্য দিনের আলোয় নানাভাবে, নানা জায়গায় পাহাড় কাটা চলছেই। এ জন্য প্রশাসন তথা সরকারকে শক্ত হতে হবে। পাহাড় রক্ষা করা খুবই দরকার। পাহাড় কাটার কারণে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়। পরিবেশ অধিদপ্তর একটু তৎপর হলে পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষা করা সম্ভব।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে