পাহাড় ধস প্রতিরোধে সচেষ্ট হতে হবে

তরুণ কান্তি বড়ুয়া | সোমবার , ২৮ জুলাই, ২০২৫ at ৪:৫৯ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশে বর্ষাকালে পাহাড় ধসের ঘটনা একটি গুরুতর সমস্যা, বিশেষ করে পার্বত্য জেলাগুলো, চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার অঞ্চলে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে এটি সাধারণত ভারী বৃষ্টিপাত, ভূমিকম্প ও অন্যান্য কারণে ঘটে থাকে। মাধ্যাকর্ষণের ফলে পাহাড় বা পর্বত গাত্র বেয়ে মাটির চাকা বা পাথর খন্ড নীচে পড়ে গেলে পাহাড় ধস ঘটে থাকে। প্রায় সময় পাহাড়ের ওপর জল ও মাটি মিশে কাদা আকারে বিপুল পরিমাণ মাটির স্তুপ নীচে গড়িয়ে আসলে তাকে এক ধরনের ভূমিধস বা পাহাড় ধস হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ভূমি বা পাহাড় ধসের প্রধান কারণ হচ্ছে পাহাড় বা পর্বতের ঢালু গাত্রে মাটির অস্থিতিশীল অবস্থা।

পাহাড় ধসের প্রাকৃতিক কারণ হলো ভূমি মধ্যস্থ পানির চাপ। নির্বিচারে গাছপালা কাটা বা আগুনে পুড়ে পাহাড় বা পর্বতে মারাত্মক বিপর্যয়ের ফলে পাহাড় ধস ঘটে থাকে। তাছাড়া নদী বা সমুদ্রের ঢেউয়ের ফলে তীরের মাটি স্থিতিশীলতা হারিয়ে সাগরে বিলীন হলে ভূমিধস ঘটে থাকে। অত্যধিক বৃষ্টিপাত বা বরফ গলার কারণে মাটি নরম হয়েও ভূমিধস ঘটাতে পারে। ভূমিকম্পের ফলে প্রচন্ড আঘাতে মাটি হালকা ও অস্থিতিশীল হয়ে ভূমিধস ঘটাতে পারে। ভূমিকম্প বা অঅগ্নুৎপাতের কারণে মাটি তরলীভূত হয়ে ভূমিধসের উৎপত্তি ঘটায়। মানুষের অদূরদর্শিতাসম্পন্ন কর্মকাণ্ডের প্রভাবেও ভূমিধস ঘটে থাকে।

পরিবেশ বিপর্যয়ের মারাত্মক একটি কারণ হলো পাহাড় ধস। সাম্প্রতিক সময়ে পাহাড় ধসের ভয়াবহ চিত্রটি বাংলাদেশে ভয় ও আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন স্থানে ভীতিকর ধস জনিত ঘটনা পরিবেশবিদ, সরকার ও জনগণের মাঝে ভীষণ উদ্বিগ্নতার কারণ হয়ে বিরাজমান। সকল মহলের কাছে উদ্বেগের কারণ হলো পরিবেশ রক্ষায় আমাদের কতটুকু সতর্ক হওয়া উচিত এবং ধসজনিত বিপর্যয় মোকাবিলায় আমাদের করণীয় বিষয়গুলো কেমন হওয়া প্রয়োজন। পাহাড় ধস মূলত প্রাকৃতিক নিয়মে ঘটে থাকলেও অসচেতনতা ও অদূরদর্শিতামূলক মানবসৃষ্ট কারণেও পাহাড় ধস ঘটে থাকে। নির্বিচারে বনানী ধ্বংসের কারণে রোদ বৃষ্টি ও মানুষের অপরিকল্পিত, অভাবিত কর্মকাণ্ডের ফলে পাহাড়ের মাটি শিথিল হয়ে ধস সৃষ্টি করে থাকে। পাহাড়ী ঢলে পানি নির্গমন পথ অবরুদ্ধ হওয়ার কারণেও পাহাড় ধস সংঘটিত হয়ে থাকে। অনেক সময় অগভীর মাটির অভ্যন্তরে গভীর মূল জাতীয় বৃক্ষ রোপণ করলে সেক্ষেত্রে শক্ত মাটি বা শিলা খন্ড শিথিল হয়ে ধস সৃষ্টি করে থাকে। অনিয়ন্ত্রিতভাবে পাহাড় কেটে মাটি অপসারণের ফলে পাহাড় ধস ঘটে থাকে। অবকাঠামো নির্মাণ, চাষাবাদ এবং বন সৃজন জাতীয় কর্মসূচিতে মাটিতে পানির প্রবেশযোগ্যতার পরিমাণ অপ্রতুল হওয়ার কারণেও পাহাড় ধস ঘটে থাকে।

বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম, রাঙ্গমাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, কঙবাজার এবং উত্তর ও উত্তর পূর্বাঞ্চলের নেত্রকোনা ও সিলেট এলাকায় অনেক পাহাড় রয়েছে। বৃহত্তর চট্টগ্রামের ১৫,৮০৯ বর্গমাইল এলাকাজুড়ে বিস্তৃত পাহাড়ি এলাকায় মূলত পাহাড় ধস ব্যাপক হারে ঘটে থাকে। এসব পাহাড়ের যেসব অংশজুড়ে মানব বসতি বেশি কিংবা মানুষের পদচারণা বেশি সেসব এলাকায় ধস যেন বছরের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। বর্ষা মৌসুমে প্রতিবছর এসব পাহাড়ি জনপদে পাহাড় ধসের কারণে ব্যাপকভাবে ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়, মানুষের প্রাণহানি ও সম্পদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকে। বান্দরবানর লামা উপজেলার ঝুঁকিপূর্ণ গ্রামগুলোর মধ্যে আজিজনগরের চিউনিপাড়া, পাইঢং, তেমুনিয়া, গজালিয়া, ফাঁসিয়াখালি ও রূপসিপাড়া, আলীকদম উপজেলার রূপপাতা, পোয়ামহরী, আমতলী বাবুপাড়া পাহাড় ধসের সর্বাধিক ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। কঙবাজারের অন্যতম ধসপ্রবন এলাকায় পাহাড়চূড়া পাহাড় ডাল এবং পাহাড়ের পাদদেশে প্রায় ৬০,০০০ পরিবার পাহাড় ধসের ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে। এছাড়া রামু, মহেশখালী, টেকনাফ, চকরিয়া, পেকুয়ার বিশাল পাহাড়ি এলাকায় প্রায় দেড় লক্ষাধিক মানুষ বর্ষা মৌসুমে ধস আতঙ্কে জীবন অতিবাহিত করছে। অন্যদিকে চট্টগ্রাম মহানগরীর জালালাবাদ পাহাড়, হামজারবাগ পাহাড়, গোলপাহাড়, কৈবল্যধাম পাহাড়, বার্মাকলোনী পাহাড় এবং হিলভিউ পাহাড়ের আশেপাশের লোকজন সবসময়ই পাহাড় ধস আতঙ্কে দিন কাটায়।

১৯৯৬ থেকে ২০১২ পর্যন্ত পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী জানা যায় শুধুমাত্র চট্টগ্রাম, কঙবাজার ও বান্দরবানে প্রায় ৩৫৬ জন লোকের প্রাণহানি ঘটে পাহাড় ধসে। এইচ ব্রমারএর ঝড়রষ ঝপরবহপব জবংবধৎপয জবংড়ঁৎপব এর শ্রেণি বিভাগ অনুযায়ী বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের মৃত্তিকা বাদামি পাহাড়ি মাটির অন্তর্ভুক্ত। এখানে ভূমির উপরিভাগে পলি দোআঁশ এবং নিচের দিকে ক্রমশ বেলে মৃত্তিকা দেখা যায়। এই মৃত্তিকা এতদ অঞ্চলে ভূমি ক্ষয়ের অন্যতম একটি কারণ। প্রচন্ড তাপে পাহাড় গুলোতে ছোট ছোট ফাটলের সৃষ্টি হয়। পাহাড়ে পানি নিষ্কাশনের সুযোগ না থাকায় বৃষ্টির পানির সঙ্গে ফাটলে ক্ষয়ী ভূত পদার্থগুলো স্ব বেগে নিন্মঢালে চাপ সৃষ্টি করে এবং প্রবল বৃষ্টিপাতের পানি এসব ফাটলে ঢুকে বড় ধরনের পাহাড় ধস সৃষ্টি করে।

মানুষের অপরিকল্পিত কর্মকাণ্ড পাহাড় ধস সমস্যাটাকে দিনদিন জটিল করে তুলছে। পাহাড়ের ঢালে ঝুঁকিপূর্ণ ভাবে বসত বাড়ি নির্মাণ, বসবাসের জন্য জঙ্গল নিধন, পাহাড় ধ্বংসকারী দুষ্কর্ম্মে লিপ্ত জনগণ এবং স্থানীয় প্রভাবশালী মহল কর্তৃক নির্বিচারে বৃক্ষ নিধনের ফলে পাহাড় আবরণহীন হয়ে পড়ছে যারফলে পাহাড় ধসের ঝুঁকি দিনদিন বেড়েই চলেছে। পাহাড় কর্তন বাংলাদেশে পাহাড় ধসের অন্যতম একটি কারণ। গত তিন দশকে চট্টগ্রামে প্রায় তিন শতাধিক পাহাড় কাটা হয়েছে। বেপরোয়া ভাবে পাহাড় কাটা হচ্ছে পার্বত্য জেলা গুলোয় এবং কঙবাজারে। প্রশাসনকে ফাঁকি দিয়ে কিংবা অবৈধ অনুমোদন নিয়ে বিশেষ মহল ইঁট ভাটা তৈরি কিংবা প্লট নির্মাণের লক্ষে নির্বিচারে পাহাড় কেটে যাচ্ছে যারফলে অপ্রতিরোধ্য পাহাড় ধস ঘটে যাচ্ছে।

পাহাড় ধস রোধে জনগণ, সরকার ও সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং বিভাগের কর্মকর্তাদেরকে অত্যন্ত সচেতনতার সাথে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

) পাহাড়কে ছিন্নমূল জনসাধারণের পুনর্বাসন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা উচিত নয়। ২) পাহাড়ের চূড়ায় বা ঢালে যেসব ছিন্নমূল জনতা অবৈধভাবে বসবাস করছে তাদেরকে নিরাপত্তার স্বার্থে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে হবে। ৩) ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ি এলাকা চিহ্নিত করে বৈধভাবে বসবাসকারী লোকদেরকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে হবে। ৪) যেকোনো অজুহাতে নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন ও পাহাড় কাটা বন্ধ করতে হবে। ৫) প্রাকৃতিক বনভূমি সংরক্ষণ করতে হবে। ৬) পাহাড় কাটা বন্ধ করার লক্ষে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে এবং পরিবেশ বিদদের আরো ক্রিয় করে তুলতে হবে। ৭) এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ এর ৬ ধারার সঠিক নীতিমালার বাস্তবায়ন করতে হবে। ৮) ধস প্রবণ পাহাড়ি এলাকায় পর্যাপ্ত সংখ্যক বৃক্ষ রোপণ করতে হবে। কারণ বৃক্ষ মাটির সহনশীলতা বৃদ্ধি ও ধ্বস প্রতিরোধে যথেষ্ট ভূমিকা রাখে। বৃক্ষের পাতা, ডালপালা বৃষ্টিপাতের সরাসরি আঘাত থেকে মাটিকে রক্ষা করে যারফলে ভূমি ক্ষয় কম হওয়ার কারণে ভূমি ধস কমে আসে। ৯) পাহাড়ে বনাঞ্চল সৃষ্টি এবং সংরক্ষণের লক্ষে বনবিভাগকে যথাযথ দায়িত্ব পালনে উদ্বুদ্ধ করা প্রয়োজন। ১০) পাহাড়ের ওপর জুমচাষ কমিয়ে তুলনামূলক ভাবে সমতল ভূমিতে জনগণকে চাষাবাদে আগ্রহী করে তুলতে হবে। ১১) জুম চাষে আগাছা নাশক ওষুধ ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। ১২) ধ্‌স প্রবণ এলাকায় কৃষিকাজের চাপ কমিয়ে আনতে হবে। ১৩) ভূমিকম্প প্রতিরোধে তাল ও সুপারি গাছ লাগানোর ব্যাপারে জনগণকে সচেতন করতে হবে। ১৪)পরিবেশ আইন মেনে চলতে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। ১৫) ধ্‌স প্রবণ স্থানে ভূমি রক্ষাকারী দেওয়াল প্রতিষ্ঠার লক্ষে জিয়ো টেঙটাইল প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভূমি ক্ষয় রোধ করে ভূমি ধ্বস প্রতিরোধে সংশ্লিষ্ট সকলকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

ভূমিধস প্রতিরোধে করণীয় বিষয়গুলো সম্পর্কে সবার মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করতে পারলে পাহাড় ধস রোধ করা যাবে যারফলে পরিবেশ, প্রকৃতিও রক্ষা পারে। পাহাড়, বনানী রক্ষা করে পাহাড় ধস প্রতিরোধে জনগণকে সচেষ্ট হতে হবে।

লেখক: শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, প্রাক্তন অধ্যক্ষ রাংগুনিয়া সরকারি কলেজ ও বর্তমানে রেক্টর বনফুল আদিবাসী গ্রীন হার্ট কলেজ, মিরপুর, ঢাকা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্টার্টআপ: বিনিয়োগ না, বঞ্চনার আধুনিক কৌশল
পরবর্তী নিবন্ধসরস্বতী সংগীতালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী