চট্টগ্রামে প্রতিবছর কোনো না কোনো জায়গায় পাহাড় ধসের ঘটনায় ঘটে প্রাণহানি। গত ১৩ বছরে পাহাড় ধসে দুই শতাধিক মানুষের মৃত্যু হলেও থেমে নেই ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস। টানা ভারী বৃষ্টিতেও পাহাড়ে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে অনেক পরিবার। তাদের সরানো হয় শুধু বর্ষা মৌসুমে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, যদি স্থায়ী কোনও সমাধান না হয় তাহলে প্রাণহানি আরও বাড়বে। নগরীতে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে বসবাস করছে ২০ হাজারেরও বেশি মানুষ। তাদেরকে সেখানে বসবাসের সুযোগ করে দিচ্ছে কিছু চিহ্নিত সন্ত্রাসী। আগে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। অপরিকল্পিত নগরীতে কোনো পরিকল্পনা নেই। যদি পরিকল্পনা থাকতো তাহলে তাদের কোথাও স্থায়ীভাবে সরিয়ে নেওয়া যেত। পাহাড়ধস বন্ধে বেশ কিছু পাহাড় সংরক্ষণ করে দেখা যেতে পারে বলে অভিজ্ঞমহল মত প্রকাশ করেছেন। তাঁরা বলেন, পাহাড়গুলো আমাদের সম্পদ, প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য। প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকা যায় না! ধারাবাহিকভাবে পাহাড়ের ক্ষতি করে চললে পাহাড়ও একসময় তার প্রতিশোধ নেবে। পাহাড়কে নিজেদের স্বার্থে কোনো গোষ্ঠী বা চক্র যেন ব্যবহার করতে না পারে, সেদিকে নজর দিতে হবে।
সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী পাহাড় রক্ষায় সাহসী পদক্ষেপ প্রত্যাশা করেন বলে তিনি মত প্রকাশ করেছেন। গত ১১ জুন নগরের পর্যটন মোটেল সৈকতের সাঙ্গু হলে অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম মহানগরের পাহাড় কাটা রোধে মতবিনিময় সভায় তিনি এ অভিমত প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, পাহাড় কাটলে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা অসম্ভব। তাই পাহাড় কাটা বন্ধের কোনো বিকল্প নেই। আজ থেকে আর একটি পাহাড়ও কাটতে দেয়া যাবে না। যারাই পাহাড় কাটবে তাদের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে ব্যবস্থা নিতে হবে। সম্মিলিত সমন্বয় করা হবে। ৯৯৯–এর মতো পরিবেশ সুরক্ষায় যেন সবাই সাথে সাথে তথ্য দিয়ে ফল পায় সেটা আমাদের করতে হবে। দ্রুততার সাথেই আমরা চট্টগ্রামে একটি কমিটি করব, যাতে আর একটিও পাহাড়ে কোপ না পড়ে। তিনি বলেন, পাহাড়কে হত্যা করছে দখলকারীরা। ৫০ হাজার, এক লক্ষ টাকা জরিমানা তাদের জন্য নয়। মামলায় এমন হতে হবে, পাহাড়খেকোদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রাখতে হবে।
সভা থেকে পাহাড় রক্ষায় নানা সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, পাহাড় কাটা রোধে ২০০৭ সালের উচ্চ পর্যায়ের কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন, পাহাড়গুলোর বর্তমান অবস্থা বর্ণনা করে একটি জরিপ পরিচালনা, পাহাড় কাটা রোধে একটি হটলাইন চালু করা, আর কোনো উন্নয়ন প্রকল্পে পাহাড় না কাটা, পাহাড় কেটে বাড়ি বা স্থাপনার কোনো পরিকল্পনায় সিডিএ অনুমোদন দেবে না মর্মে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয়া, আইনশৃঙ্খলায় নিয়োজিত বিভিন্ন বাহিনী কর্তৃক বিভিন্ন পাহাড়ে স্থাপনা নির্মাণ অনতিবিলম্বে বন্ধ করা, পাহাড় কাটা রোধে ও পাহাড়ের সুরক্ষায় সমন্বয় সেল বা আলাদা ইনফোর্সমেন্ট সেল বা টিম গঠন, পাহাড় রয়েছে এমন সকল ওয়ার্ডের জনগণকে সচেতন ও সংগঠিত করা এবং পাহাড়, খাল, ছড়া রয়েছে এসব জায়গায় বিদ্যুৎ, পানিসহ অন্যান্য নাগরিক সুবিধা বন্ধ করা।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্রচলিত যেসব আইন আছে সেসব আইনে যে শাস্তির বিধান বর্ণিত আছে তা আরও বৃদ্ধি করে এর সুপ্রয়োগ জোরদার করতে হবে। পাহাড় দখলকারীদের উচ্ছেদ করতে হলে যতটুকু জনবল বন বিভাগের থাকা উচিত সেসব বৃদ্ধিতেও সরকারকে মনোযোগ দিতে হবে। জলবায়ুু পরিবর্তানের বিরূপ প্রভাবের হাত থেকে ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে পাহাড় ও গাছ কাটা বন্ধে পদক্ষেপ নিতে হবে। বর্ষায় কোনো না কোনো সময় ভারি বর্ষণ হবেই। তবে তার সঙ্গে পাহাড় কাটা, বনের গাছপালা কেটে ফেলার ঘটনা যোগ হলেই এর খেসারত চরমভাবে দিতে হবে আমাদের। পাহাড়ে আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ, ঝুঁকিপূর্ণ বসতি স্থাপন নিষিদ্ধ করে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করলে কিছুটা হলেও পাহাড় কাটা রোধ করা যাবে। বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা নিতে হবে। পাহাড় ধ্বংসের কুফল সবাইকে বোঝাতে হবে। চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন অঞ্চলে বেআইনিভাবে পাহাড় কাটা রোধে এবং পাহাড়ে বসবাসকারীদের সুরক্ষায় সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।