চট্টগ্রামে পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস থামছেই না, বরং দিন দিন বেড়েই চলছে। যে সব পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বছরের পর বছর অবৈধ ভাবে হাজার হাজার মানুষ বসবাস করছে তার বেশির ভাগই সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের। তবে বেশ কিছু পাহাড় আছে সরকারি খাস।
সরেজমিনে চট্টগ্রামে মতিঝর্ণা এবং ফয়’স লেকের বিভিন্ন ঝিলের পাহাড়ের পাদদেশে গিয়ে দেখা গেছে, সেমি পাকা কিংবা টিন শেড–বেড়ার কাঁচা ঘর নয়; রীতিমত পাকা দালানে বছরের পর বছর আলিশান ভাবে বসবাস করছে অনেক পরিবার।
গতকাল মতিঝর্ণা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, চারদিকে গাছপাল ঘেরা সবুজ পাহাড়ের পাদদেশে ছয় তলা ফাউন্ডেশন দেয়া বিল্ডিংয়ের চার তলায় বসবাসের পাশাপাশি ভাড়াও দিয়েছেন অনেক পরিবারকে। শুধু এ রকম একটি বিল্ডিং নয়, এমন অনেক এক তলা–দ্বিতীয় তলা এবং তৃতীয় তলা বিল্ডিংয়ে বছরের পর রয়েছেন অবৈধ বসবাসকারীরা। নিজে পরিবার পরিজন নিয়ে থাকার পাশপাশি ভাড়াও দিয়েছেন অনেকে। এসব পাকা দালানের পাশাপাশি রয়েছে অসংখ্য সেমি পাকা এবং বেড়ার ও টিনশেড ঘর। বেড়ার ও টিনশেড ঘর গুলোতে শ্রমজীবী ভাসমান মানুষ ভাড়ায় থাকেন। জানা গেছে, বেশিরভাগ, সেমিপাকা, বেড়ার ও টিনশেড ঘর স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী এবং প্রভাবশালীরা নির্মাণ করে ভাড়া দিয়েছেন। আবার অনেক এলাকায় অবৈধ দখলদাররা জায়গা দখল করে দিয়েছেন। ভাড়াটিয়ারা ঘর তৈরি করে থাকেন। তাদেরকেও মাস শেষে ভাড়া দিতে হয়।
গত দুইদিন নগরীর মতিঝর্ণা, জিলাপীর পাহাড়, সিআরবি রেলওয়ে পাহাড়, বাটালীহিল পাহাড় এবং আকবর শাহ থানার ফয়’স লেক এলাকার ১, ২ ও ৩ নম্বর ঝিল সংলগ্ন পাহাড়ে পাহাড় গুলো ঘুরে দেখা গেছে অনেক এলাকায় পাহাড় কেটে আবার অনেক এলাকায় পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করেন শত শত মানুষ। তবে মতির্ঝণা এলাকায় অনেক পরিবার বিল্ডিং করে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে যুগ যুগ ধরে। এসব বিল্ডিংয়ে গ্যাস–বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ রয়েছে। সেমি পাকা এবং টিনশেড ঘর গুলোতেও বিদ্যুৎ এবং পানির সংযোগ রয়েছে। যেসব এলাকায় ওয়াসার পানির সংযোগ নেই সেখানে প্রভাবশালী অবৈধ দখলদার (এলাকায় বস্তির জমিদার নামে পরিচিত) গভীর নলকূপ বসিয়ে নিজস্ব পাইপ লাইন দিয়ে পানির সংযোগ দিয়েছে। মাস শেষে বাসা ভাড়ার সাথে পানির বিলও আদায় করে অবৈধ দখলদার জমিদার।
কোন পাহাড়ে কত বসবাস: আকবর শাহ থানার ফয়’স লেক এলাকার ১, ২ ও ৩ নম্বর ঝিল সংলগ্ন পাহাড়ে সবচেয়ে বেশি মানুষ ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করেন। সেখানে থাকেন প্রায় ৪ হাজার ৪৭৬ পরিবার। এ ছাড়া নগরীর মতিঝর্ণা ও বাটালী হিল পাহাড়ে বসবাস ৪৩১ পরিবারের। কৈবল্যাধাম হাউজিং এস্টেট সংলগ্ন পাহাড়ে ১৪৬ পরিবার, পলিটেকনিক হল্ট স্টেশন সংলগ্ন পাহাড়ের পাদদেশ ১২ পরিবার, ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় ফৌজি ফ্লাওয়ার মিল সংলগ্ন পাহাড়ের পাদদেশে পাঁচ পরিবার, ষোলশহর স্টেশন সংলগ্ন পাহাড়ের পাদদেশে ৭৪ পরিবার, পরিবেশ অধিদপ্তর সংলগ্ন পাহাড়ে ৪৬ পরিবার, লেকসিটি আবাসিক এলাকা সংলগ্ন বিজয় নগর পাহাড়ে ২৮৮ পরিবার, আমিন জুট মিলস কলোনি সংলগ্ন ট্যাঙ্কির পাহাড়ে ৬৫ পরিবার, উত্তর পাহাড়তলী মৌজার ১৫০ দাগের খাস খতিয়ানভুক্ত পাহাড়ে (জয়ন্তিকা আবাসিক সংলগ্ন) ২৮ পরিবার, বিএস ২১২ ও ২১৩ দাগের পাহাড়ে (মুরগি ফার্ম হয়ে গার্ডেন ভিউ সোসাইটি সংলগ্ন) ১২ পরিবার, আকবর শাহ বেলতলী পাহাড়ে ৮৯ পরিবার, পলিটেকনিক কলেজ সংলগ্ন পাহাড়ে ৪৩ পরিবার বসবাস করছে।
লালখানবাজার জামেয়াতুল উলুম মাদ্রাসা সংলগ্ন পাহাড়ে ৩২৩ পরিবার, হারুন খান সাহেবের পাহাড়ে ১৪৪ পরিবার, নাছিয়াঘোনা এলাকায় ১২ পরিবার, চিড়িয়াখানার পেছনের পাহাড়ে ২৮ পরিবার, মধুশাহ পাহাড়ে ২৯ পরিবার, জালালাবাদ সংলগ্ন পাহাড়ে পাঁচ পরিবার, নাগিন পাহাড়ে ২৫ পরিবার, ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট সংলগ্ন মীর মোহাম্মদ হাসানের পাহাড়ে ৩৮ পরিবার, এমআর সিদ্দিকীর পাহাড়ে ৪২ পরিবার, মিয়ার পাহাড়ে ৪৯ পরিবার, ভেড়া ফকিরের পাহাড়ে (রৌফাবাদ, অঙিজেন) ১১ পরিবার ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে বলে প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে জানা গেছে।
গত ২০ জুন চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে অনুষ্ঠিত পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির ২৮ তম সভায় চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মো. তোফায়েল ইসলাম
চট্টগ্রামে পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস ঠেকাতে এবং পাহাড় ধসে ক্ষয়ক্ষতি রোধে পাহাড়ে সব অবৈধ পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংযোগ আগামী ১৫ দিনের মধ্যে বিচ্ছিন্ন করার নির্দেশ দিয়েছেন। এদিকে পাহাড়ে কোনো অবৈধ গ্যাস আছে কিনা সেটি জানানোর জন্য কর্ণফুলী গ্যাস ডিসট্রিভিউশন লিমিটেডকে নির্দেশ দেন বিভাগীয় কমিশনার। এ ব্যাপারে ১৫ দিন পর পর তথ্য দেওয়ার জন্য নির্দেশনাও দেন তিনি।
চট্টগ্রামে প্রতিবছর কোনো না কোনো জায়গায় পাহাড় ধসের ঘটনায় ঘটে প্রাণহানি। গত ১৩ বছরে পাহাড় ধসে দুই শতাধিক মানুষের মৃত্যু হলেও থেমে নেই ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস।
নগর পরিকল্পনা বিদসহ বিশেষজ্ঞদের মতে, পাহাড়ে অবৈধ ঝুঁকিপূর্ণ ভাবে বসবাসকারীদের যদি স্থায়ী কোনও সমাধান না হয় তাহলে প্রাণহানি আরও বাড়বে। নগরীতে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে বসবাস করছে ২০ হাজারেরও বেশি মানুষ।