খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে সংঘাত–হামলার প্রতিবাদে তিন পার্বত্য জেলায় বিক্ষুব্ধ জুম্ম ছাত্র–জনতার ডাকা ৭২ ঘণ্টার অবরোধ কর্মসূচি শেষ হয়েছে। গতকাল সোমবার সন্ধ্যা ৬টায় এ কর্মসূচি সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ইউপিডিএফের খাগড়াছড়ি জেলা সংগঠক অংগ্য মারমা। অবরোধ শেষ হওয়ার পর রাঙামাটি শহরে সিএনজি টেক্সি চলাচল শুরু হয়েছে। ছেড়ে যাচ্ছে দূরপাল্লার যানও। খাগড়াছড়িতেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। এদিকে দীঘিনালায় সহিংসতার ৫ দিন পর মামলা হয়েছে।
খাগড়াছড়িতে অবরোধ শেষ : খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি জানান, গতকাল বিকালে রাঙামাটির সাজেকে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে অবরোধ সমর্থনকারী ছাত্র–জনতা। সমাবেশ থেকে অবরোধের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করে ইউপিডিএফের খাগড়াছড়ি জেলা সংগঠক অংগ্য মারমা বলেন, সন্ধ্যা ছয়টা থেকে অবরোধ কর্মসূচি সমাপ্তি করা হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যে বিক্ষুব্ধ জুম্ম ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে ইমেইল বার্তায় প্রেস বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হবে এবং পরবর্তী কর্মসূচি দেওয়া হবে। খাগড়াছড়ির দীঘিনালা ও রাঙামাটিতে সহিংসতায় ৪ জন নিহতের ঘটনায় ঢাকায় শুক্রবার বিক্ষুব্ধ জুম্ম ছাত্র–জনতার বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে তিন পার্বত্য জেলায় ৭২ ঘণ্টার অবরোধ কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হয়। এতে সর্বাত্মক সমর্থন দেয় আঞ্চলিক সংগঠন ইউপিডিএফ। অবরোধে খাগড়াছড়ির সাথে রাঙামাটি, ঢাকা ও চট্টগ্রামের দূরপাল্লার যাত্রীবাহী ও পণ্যবাহী যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
সহিংসতার ৫ দিন পর মামলা : খাগড়াছড়ির দীঘিনালা বাস স্টেশন সংলগ্ন লারমা স্কয়ারে সহিংসতার ঘটনায় মামলা করেছে পুলিশ। গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন দীঘিনালা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নুরুল হক। সহিংসতার ৫ দিন পর গতকাল দীঘিনালা থানা পুলিশের উপপরিদর্শক নুর উদ্দিন বাদী হয়ে মামলা ফৌজদারি আইনে মামলাটি দায়ের করেন।
মামলার এজাহারে ‘বেআইনি জনতা দলবদ্ধ হয়ে মারাত্মক অস্ত্র–শস্ত্র সজ্জিত হয়ে দাঙ্গা সংঘটন, হত্যার উদ্দেশ্য মারধর, ক্ষতিসাধন, অগ্নিকাণ্ড ও হত্যা করার অপরাধ’ উল্লেখ করা হয়। এজাহারে ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিসাধন হয় বলে উল্লেখ করা হয়।
দীঘিনালা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি নুরুল হক বলেন, সংঘর্ষের ঘটনায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। সংঘর্ষ ও বাজারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ভিডিও ফুটেজ দেখে শনাক্ত করে আসামিদের আটক করা হবে।
বুধবার খাগড়াছড়িতে মামুন নামে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল বের করে দীঘিনালা ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থীরা। বিক্ষোভ মিছিলটি লারমা স্কয়ারের দিকে যাওয়ার সময় সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। এক পর্যায়ে লারমা স্কয়ারে দোকানপাট ও বসত বাড়িতে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এতে সংঘাত খাগড়াছড়ি জেলা সদর ও রাঙামাটিতে ছড়িয়ে পড়ে।
রাঙামাটির সড়কে–বাজারে জনসমাগম বাড়ছে : রাঙামাটি প্রতিনিধি জানান, রোববার রাতে অনির্দিষ্টকালের জন্য ডাকা পরিবহন ধর্মঘট প্রত্যাহারের পর গতকাল সকাল থেকে রাঙামাটি শহরে সিএনজিচালিত টেঙি চলাচল শুরু হয়েছে। শহরের একমাত্র অভ্যন্তরীণ যানবাহন টেঙি সচল হওয়ায় মানুষ যাতায়াত করতে পারছে। তবে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে গতকাল সড়কে টেঙি ও যাত্রীর উপস্থিতি কম ছিল।
তবে ধর্মঘট প্রত্যাহার হলেও ৭২ ঘণ্টার জন্য ডাকা সড়ক ও নৌপথ অবরোধের কারণে গতকাল দিনে দূরপাল্লার যানবাহন ও কাপ্তাই হ্রদে নৌ–যান চলাচল ছিল বন্ধ। অবরোধের শেষ দিনে রাঙামাটি থেকে বান্দরবান–খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে দূরপাল্লার কোনো বাস ছেড়ে যায়নি। আন্তঃজেলা সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় বিপাকে পড়েছেন অনেকে। ৩ দিনের অবরোধ শেষ হলেও নতুন কোনো কর্মসূচি আসেনি। এতে করে আজ মঙ্গলবার থেকে আন্তঃজেলা যানবাহন চলাচল শুরু হবে। গতকাল রাতেই রাঙামাটি থেকে ঢাকামুখী যাত্রীবাস ছেড়েছে।
এর আগে শুক্রবার সকালে রাঙামাটি শহরে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পর দুপুরে শহরে ১৪৪ ধারা জারি করেছিল জেলা প্রশাসন। রাতে যানবাহন হামলা, ভাঙচুর ও শ্রমিকদের মারধরের প্রতিবাদে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট ডেকেছিল রাঙামাটি পরিবহন শ্রমিক ও মালিকদের সংগঠনসমূহ। রোববার ১৪৪ ধারা ও পরিবহন ধর্মঘট প্রত্যাহারের পর গতকাল শেষ হলো অবরোধ কর্মসূচি।
এদিকে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে রাঙামাটির শহরের পরিস্থিতি। গতকাল সকাল থেকে শহরের প্রাণকেন্দ্র বনরূপা বাজার বসেছে। বাজারে পাহাড়ি–বাঙালি ব্যবসায়ী ও ক্রেতা–বিক্রেতাদের দেখা গেছে। তবে অন্যান্য সময়ের তুলনায় উপস্থিতি ছিল অনেকটা কম। বিকালে কল্যাণপুরে সড়কের পাশে ও আসামবস্তিতে বাজার বসেছে। সেখানে পাহাড়িদের বাজারে বেচাকেনা করতে দেখা গেছে। শহরের বিভিন্ন মোড়ে, গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আইন–শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন রয়েছে। শুক্রবারের সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্ত ধ্বংসস্তূপগুলো বেশিরভাগই সেভাবে আছে।
রাঙামাটি–চট্টগ্রাম মোটর মালিক সমিতির সভাপতি ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ–চলাচল যাত্রী পরিবহন সংস্থার রাঙামাটি জোন চেয়ারম্যান মো. মঈন উদ্দিন সেলিম বলেন, মঙ্গলবার (আজ) সকাল থেকে রাঙামাটি–চট্টগ্রামসহ খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের সঙ্গে দূরপাল্লার যাত্রীবাহী বাস চলাচল করবে। সকাল থেকে কাপ্তাই হ্রদেও লঞ্চ চলাচল করবে।
রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন খান বলেন, রোববার রাতে পরিবহন মালিক–শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে পরিবহন ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয়েছে। সোমবার রাত থেকেই ঢাকার উদ্দেশ্যে বাস ছেড়ে যাচ্ছে। সকাল থেকে বান্দরবান–খাগড়াছড়ির সঙ্গেও যাত্রীবাহী বাস চলবে। রাঙামাটি শহরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসছে। রাস্তাঘাট ও হাটবাজারে মানুষের সমাগম বেড়েছে।