রাঙামাটিতে দেখা মিলেছে গোলাপী রঙের হস্তী শাবক। বাংলাদেশে এই ঘটনা এবার প্রথম বলে মত দিয়েছেন প্রাণী গবেষকেরা। গত ১৩ জুন রাঙামাটির বরকল উপজেলায় কাপ্তাই লেকে একটি হাতির দল সাঁতরে উঠার ভিডিও ধারণ করে স্থানীয় বাসিন্দা ও ইআরটি (এলিফ্যান্ড রেসপন্স টিম) সদস্য মো. জাহাঙ্গীর। ভিডিওটি দেখার পরই গোলাপী রঙের হাতি শাবক ও পুরো হাতি টিমের ছবি তোলার উদ্দ্যেশে রওনা হলাম বরকলের উদ্দেশে। আষাঢ়ের বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সকালে পৌঁছে যাই হাতি বিচরণের নিকটবর্তী এলাকায়। কিছু সময় খোঁজার পর পাহাড়ের চূড়ায় হাতির দলটির সন্ধান পাওয়া যায়। হাতি যাতে আমাদের উপস্থিতি টের না পায় সেজন্য বেশ দূর থেকে ছবি তোলার চেষ্টা করা হয়। আট সদস্যের হাতির মধ্যে পাহাড়ের চূড়ায় তিনটি হাতি ঘুমন্ত অবস্থায়, অদূরে আরেক জায়গায় বিশ্রামরত শাবকসহ বাকি ৫টি। প্রায় এক ঘণ্টার বিশ্রাম শেষে হাতির দল একসাথে বিচরণ করতে বের হল। পুরো দলের ছবি তোলা হয়। সবচেয়ে ছোট সদস্য গোলাপী হাতি শাবক। বয়স দেড় থেকে দুই মাস। মা হাতির ঘা ঘেঁষে সে হাঁটছে। মা হাতি দাঁড়ালে শাবকটি হাতির পেটের নিচে আশ্রয় নেয়। মা হাতিটি ছায়ার মতো করে গোলাপী হাতি শাবক আগলে রাখছে। সাঁতরে লেক পার হচ্ছে বা পাহাড় উঠানামা করছে। এর আগে ২০২৩ সালে রাঙামাটির লংগদুতে হাতির বাচ্চা দেখেছি। তবে সেটি ছিল অন্য বাচ্চাদের মতো কালচে এবং সারা শরীর লোমে আবৃত। এটি একেবারের ভিন্ন। সাঁতরে লেক পার হওয়ার সময় শাবকটির শরীর ভিজে আরো গোলাপী হয়ে উঠে।
বন্যপ্রাণী গবেষক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণী বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান বলেন, সম্প্রতি রাঙামাটি এলাকায় একটি হাতির বাচ্চা দেখা যায়। হয়তো এই বছরেই জন্ম নিয়েছে। হাতির বাচ্চাটির রং স্বাভাবিক নয়, কিছুটা গোলাপী। চামড়ায় যে রঞ্জক পদার্থ থাকা দরকার যদি সেটি স্বাভাবিক, না হয় ফ্যাকাশে বা গোলাপি রঙের হয়। এই বাচ্চাটিও সেরকম। আমার জানা মতে বাংলাদেশে এই রঙের হাতি দেখা যায়নি। তবে আমাদের পার্শ্ববর্তী মিয়ানমার এবং থাইল্যান্ডে কিছু পোষা হাতি আছে যেগুলো এই ধরনের। বন্য অবস্থায় এমনকি পোষা কোনো অবস্থাতে বাংলাদেশে এই রঙের হাতি দেখা যায়নি।
দীর্ঘদিন ধরে রাঙামাটির বরকল ও লংগদুতে হাতি ও মানুষের মধ্যে দ্বন্দ্ব নিরসনে কাজ করছে ইআরটি বা এলিফ্যান্ড রেসপন্স টিম। বর্তমানে তিনটি টিমে মোট সদস্য সংখ্যা ৪৬ জন। ইআরটি সদস্য মো. জাহাঙ্গীরই প্রথম এই গোলাপী রঙের হাতিটি দেখতে পায়। তিনি সেটি তার মুঠোফোনে ধারণ করেন। তিনি জানান, আমরা প্রায় সময় এখানে হাতি দেখি। ১৩ জুন দেখতে পাই ৮টি হাতির দল এক সাথে সাঁতরে লেক পার হচ্ছে। ভিডিও স্বাভাবিকভাবে ধারণ করি। পুরো টিমের হাতির ভিডিও ধারণ করার পর সেটি কাছালংমুখ বনশুল্ক পরীক্ষণ ফাঁড়ি স্টেশন কর্মকর্তা মোহাম্মদ শরীফুল ইসলাম স্যারকে পাঠায়। মূলত নতুন হাতির শাবক জন্ম নিয়েছে সেটি ধারণ করতেই ভিডিও করি। কিন্তু পরে গোলাপী রঙের হাতির বিশেষত্ব বুঝতে পারি। এই বাচ্চাটি অন্য বাচ্চা থেকে আলাদা তা জানতে পারি।
কাছালংমুখ বনশুল্ক পরীক্ষণ ফাঁড়ি স্টেশন কর্মকর্তা মোহাম্মদ শরীফুল ইসলাম বলেন, বরকলের এসব এলাকায় হাতি সুরক্ষায় ইআরটি টিম গঠনের সুফল আমরা পাচ্ছি। কয়েক বছর পর নতুন শাবক জন্ম নিচ্ছে। গোলাপী শাবকটি বয়স দুই মাস হবে। ঐটার কাছাকাছি বয়সে আরো একটি শাবক রয়েছে। একটি কিশোর হাতি আছে এবং ৫টি বয়স্ক হাতিসহ শুধু এই টিমের সদস্য সংখ্যা ৮। এর বাইরে লংগদুতে হাতি রয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের আওতাধীন রাঙামাটির বরকল ও লংগদু এলাকায় দিন দিন বাড়ছে হাতির সংখ্যা। পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের সদ্য সাবেক বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম বলেন, নতুন গোলাপী রঙের শাবকসহ এই অঞ্চলের হাতির সংখ্যা এখন প্রায় ১৪। এটি খবুই ইতিবাচক একটা দিক। দেশের অন্যান্য অঞ্চলে মানুষের দ্বারা হাতি আক্রান্ত হলেও এসব এলাকায় তেমনটি ঘটে না। হাতির মানুষের ক্ষতি করলে বন বিভাগ ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে। ফলে মানুষ হাতিকে আক্রমণ করছে না।
বন্যপ্রাণী গবেষক অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান বলেন, হাতি একটি বিশ্বব্যাপী বিপন্ন প্রাণী। আমরা সৌভাগ্যবান বিপন্ন প্রাণীটি বাংলাদেশেও আছে। তবে খুব ভালো অবস্থায় নেই। হাতি যে জায়গায় রয়েছে সেখানে মানুষের সাথে তার দ্বন্দ্ব বিদ্যামান। কারণ যেহেতু হাতি অনেক বড় প্রাণী। তার খাবারের প্রয়োজন পড়ে। সে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। অনেক ক্ষেত্রে মানুষের বসতবাড়ি, ফসলের ক্ষেত, বাগান ক্ষতিগ্রস্ত করে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যদি শেরপুর বা অন্য অঞ্চলের সাথে রাঙামাটির তুলনা করি এখানে জনবসতি অনেকটা কম। পাহাড়ে পর্যাপ্ত খাবার আছে। কাপ্তাই লেক যেহেতু সব জায়গায় ঢুকে গেছে পানিও পাওয়া যায়। হাতির জন্য আদর্শ জায়গা রাঙামাটি। তবে আবাসস্থলের তুলনায় এখানে হাতির সংখ্যা কম। আমরা যদি স্থানীয়দের সম্পৃক্ত করতে পারি মানুষ ও হাতির দ্বন্দ্ব কমিয়ে আনতে পারি তাহলে এখানে দীর্ঘ মেয়াদে হাতি টিকিয়ে রাখা যাবে। তিনি আরো বলেন, হাতি ঘুরে বেড়ায়, সে ছোট একটা জায়গায় সীমাবদ্ধ থাকে না। তার বিচরণ ক্ষেত্রগুলোতে যদি বন জঙ্গল জন্মানোর সুযোগ দিই, স্থানীয় উদ্ভিদ প্রজাতি যদি রোপণ করা হয় সেক্ষেত্রে হাতি সহজেই খাবার পাবে।