মীরসরাই উপজেলা একটি বৈচিত্র্যময় জনপদ। একদিকে পাহাড়ি অভয়ারণ্য, অপর দিকে সমুদ্র উপকূল। কৃষিপ্রধান এ অঞ্চলে যুক্ত হয়েছে অর্থনৈতিক শিল্পাঞ্চল। আদিম ও আধুনিক সংকলনের সম্ভার বলা চলে। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হলো আধুনিকতার পাশাপাশি আদিম প্রকৃতি বিলুপ্তির পথে চলতে শুরু করেছে আরো আগেই। এখন অবশিষ্টাংশও যেন বিলীন হবার অপেক্ষায়। মীরসরাই উপজেলার পাহাড়গুলোতে একসময় যেমন ছিল গভীর বন, তেমনি ছিল নানান ফল ফলাদির সমাহার। কাউফল, ত্রিফলা, আমড়া, জলপাই, কামরাঙ্গা, কলা, আম, জাম, কাউ থেকে শুরু করে শত রকমের ফল খেয়ে জীবন ধারণ করতো বনের হরিণ, বানর থেকে শুরু করে নানান প্রজাতির পশুপাখিরা। বন মোরগ, লজ্জাবতি বানর থেকে হরিণ, শুকরের দল দেখা যেত এই বনে। কিন্তু এখন এসব প্রাণীকূল খাবারের সংকটে বিলীন প্রায়। বনে নেই কোনো বণ্য প্রাণী, বন বিভাগ নানান বাণিজ্যিক গাছ আর নিজেদের সুবিধা নিয়েই ব্যস্ত। ভাবছে না কেউ বন্যপ্রাণীদের খাবারের সংস্থানের কথা।
উপজেলার খইয়াছড়া ইউনিয়নের নাপিত্তাছড়া ত্রিপুরাপাড়ার বাসিন্দা কৃষক সুমন ত্রিপুরা জানান, সম্প্রতি তার ক্ষেতের ফসল, বাগানের সবজি, ফলমূল ধ্বংসের পাশাপাশি ঘরে ঢুকে ভাতও খেয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের কিছু বানরের দল। তিনি বলেন, এমনকি আমার ঘরের চালায় এখন বানর দলের বসতি। ফল–ফসল খেয়ে তো ক্ষতি করেই, মাঝেমধ্যে ঘরে ঢুকে ভাত খেয়ে চলে যায়। বাচ্চাদের হাতের খাবার কেড়ে নিয়ে যায় প্রায়ই। তাড়াতে গেলে উল্টো তেড়ে আসে মানুষের দিকে। ওদের যন্ত্রণায় এখন বাড়িতে থাকাই দায়।
পাহাড়ে খাদ্যসংকটে পড়ে এভাবেই বসতবাড়িতে ঢুকে পড়ছে বানর। গভীর বন ছেড়ে লোকালয়ে এসে ধান, কলা, পেঁপেসহ বিভিন্ন ফল খেয়ে যাচ্ছে বানরের পাল। এতে ক্ষতির মুখে পড়ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। বন বিভাগ বলছে, শীতের শেষের দিকে পাহাড়ের গাছে পাতা ও ফুল–ফল কমে যাওয়ায় বানরের খাদ্যসংকট তৈরি হয়। তাই বানর খাবারের খোঁজে লোকালয়ে চলে আসে।
পাহাড়ি এলাকার বাসিন্দারা জানান, চার–পাঁচ মাস ধরে বানরের উৎপাত বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে হামলাকারী বানরের সংখ্যা। আগে বসতবাড়ি এলাকায় ঝাঁকে ৮–১০টি বানর দেখা গেলেও এখন ঝাঁকগুলোতে ছোটবড় মিলিয়ে ৫০–১০০টি পর্যন্ত বানর দেখা যায়।
মীরসরাই সদর সংলগ্ন গোভানিয়া বিটের সামাজিক বনায়নকারী এই প্রতিবেদককে বলেন, আমার কয়েক একর বাগানের কলা, আমড়া সহ নানান ফল বানরের দল এসে এসে খেয়ে যাচ্ছে। তাতে দুঃখ নেই বরং আমি বানরদের জন্য পাউরুটি, কলা, খিরা–সহ নানা ফল বাজার থেকে কিনে এনে রেখে দিই। কিন্তু ওরা সেগুলো খাচ্ছে না, গাছ থেকেই খাবে। আবার হয়তো ভেজাল আছে কিনা সন্দেহও করছে। তাই ওদের জন্য পর্যান্ত খাবারের গাছগাছালি প্রয়োজন।
উপজেলার সাইবেনিখিল ত্রিপুরাপাড়ার বাসিন্দা ও পাড়াপ্রধান উষা ত্রিপুরা বলেন, আগে গভীর বনে থাকলেও এখন প্রায়ই বাড়িতে চলে আসছে বানর। বাড়ির আশপাশে লাগানো গাছের কলা, পেঁপেসহ বিভিন্ন ফল খেয়ে যাচ্ছে তারা। বানর বন ছেড়ে বাড়িতে হানা দেওয়ার বিষয়টি আমাদের চিন্তায় ফেলেছে। তবে এটা উদ্বেগের চেয়ে ও বেশি চিন্তার বিষয় ওদের পর্যাপ্ত খাবারের জন্য বিলুপ্ত ও ধ্বংস হওয়া ফলফলাদির বাগান সৃজন করা।
এই বিষয়ে চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের করেরহাট রেঞ্জের কর্মকর্তা তারিকুর রহমান বলেন, শীতের শেষ দিকে পাহাড়গুলোতে পাতা ও ফুল–ফল কমে আসায় বানরের খাদ্যসংকট তৈরি হয়। এতে অনেক সময় দল বেধে বানর বন ছেড়ে পাশের বসতবাড়ি ও ক্ষেতখামারে চলে আসে। গাছে নতুন পাতা গজালে এসব বানর আবার পাহাড়ের গভীর বনে ফিরে যাবে।