বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব, জেলা প্রশাসক, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) চেয়ারম্যানসহ ১০ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে নতুন করে আর কোনো পাহাড় না কাটতে লিগ্যাল নোটিশ দিয়েছে। সম্প্রতি বেলার পক্ষ থেকে পাঠানো নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে, চট্টগ্রাম মহানগরীসহ এ বিভাগের চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি জেলার সব পাহাড় কাটা বন্ধে ২০১১ সালে বেলা একটি জনস্বার্থমূলক মামলা দায়ের করে। মামলার চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১২ সালের ১৯ মার্চ আদালত উল্লিখিত জেলাগুলোর সব পাহাড় কাটা বন্ধে প্রয়োজনীয় ও যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে আদালত উল্লিখিত এলাকায় পাহাড় কেটে কোনো আবাসন প্রকল্প বা ইটভাটা স্থাপন করা হয়ে থাকলে তা ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেন। পাশাপাশি বন উজাড় বন্ধ করতে এবং পাহাড়ি প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্যের আধার অক্ষুণ্ন রাখতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন।
আদালতের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে পাহাড় কাটা অব্যাহত থাকলে বেলা পাহাড় কাটা বন্ধে প্রয়োজনীয় আদেশ চেয়ে হাই কোর্ট বিভাগে আবেদন দাখিল করে। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি এ বিভাগের সব পাহাড়ের তালিকা (দাগ, খতিয়ানসহ) এবং পাহাড়গুলোর বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রস্তুত ও তা আদালতে জমা দেওয়া এবং আদালত কর্তৃক ২০১২ সালের ১৯ মার্চে প্রদত্ত রায়ের আলোকে পাহাড় কাটা রোধে সরকারি সংস্থাগুলো কী কী ব্যবস্থা নিয়েছে সে বিষয়ে ৩ মাসের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে চট্টগ্রাম বিভাগের সর্বশেষ বিদ্যমান পাহাড়গুলোকে আরও ক্ষতি, ধ্বংস ও কাটা পড়া থেকে রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ, পাহাড় কাটা বিষয়ে আদালতের যে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, তা প্রতিটি পাহাড়ে প্রদর্শন করা এবং ইতোমধ্যে কাটা হয়েছে এমন পাহাড়গুলোতে দেশীয় প্রজাতির বৃক্ষরোপণ এবং রিটেইনিং ওয়াল স্থাপনের মাধ্যমে সুরক্ষিত রাখার নির্দেশ দেন আদালত।
এদিকে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও পাহাড় কাটা বন্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। তিনি বললেন, ‘কোনো অবস্থাতেই পাহাড় কাটা যাবে না’। পঞ্চমবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেয়ায় শেখ হাসিনাকে গণভবনে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানানোর সময় সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীকে এসব কথা বলেন। তিনি পাহাড় কাটা বন্ধে কঠোর অবস্থানে থাকতে মেয়রকে নির্দেশ দেন।
আসলে থেমে নেই পাহাড় কাটা। অবিরাম চলছে পাহাড় কাটার যজ্ঞ। পাহাড় কেটে ছোট্ট পরিসরেই গড়ে তোলা হচ্ছে বসতি। অবৈধভাবে গড়ে উঠছে একের পর এক ঘর। এবিষয়ে প্রভাবশালীদের পাশাপাশি পরিবেশ অধিদফতরের লোকজনও কম দায়ী নয় বলে অভিযোগ পরিবেশকর্মীদের। তাঁদের অভিযোগ, রাতে–দিনে কাটা হচ্ছে পাহাড়। আগে লুকোচুরি করে পাহাড় কাটা হলেও এখন প্রকাশ্যে কেটে ফেলা হচ্ছে। পাহাড়খেকোদের বেপরোয়া কর্মকাণ্ডে শঙ্কিত সাধারণ মানুষ। বিশেষ করে পাহাড়খেকোরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাওয়ায় চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো সাবাড় হওয়ার শঙ্কা দিনে দিনে প্রকট হয়ে উঠছে। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির এক সভায় সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেছিলেন, পাহাড় বেষ্টিত চট্টগ্রামে একশ্রেণির প্রভাবশালী রাতের অন্ধকারে পাহাড় কেটে বসতবাড়ি করছে। জলাশয় ভরাট এবং পাহাড় কাটা রোধে সংশ্লিষ্ট সকল ডিপার্টমেন্টকে কঠোর ভূমিকা রাখতে হবে।
এছাড়া সবুজ আন্দোলনের কর্মীরা চট্টগ্রামের পাহাড় কাটা রোধে প্রয়োজন নাগরিকদের সমন্বিত উদ্যোগ জরুরি বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁরা বলেন, দেশ স্বাধীনের পর থেকে সমাজের স্বার্থান্বেষী মানুষ আর সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পে বিলুপ্ত হয়েছে চট্টগ্রামের প্রায় ১৩০টির অধিক পাহাড়। আধুনিক সভ্যতার আধুনিকায়নে চট্টগ্রামের পরিবেশ যেন এক গুমোট বাঁধা নৈরাজ্যের সাক্ষী। ঐতিহাসিক চট্টগ্রাম উন্নয়নের মহাসড়কে থাকলেও পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে তা এখন মৃত্যু ফাঁদে পরিণত হয়েছে। এজন্য দরকার সমন্বিত উদ্যোগ। তাঁরা বলেন, চট্টগ্রামের পাহাড় রক্ষায় সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা না থাকায় জেলা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর, সিডিএ সিটি কর্পোরেশন যার যার মত করে বিভিন্ন সময়ে অভিযান শুরু করে জরিমানার প্রক্রিয়া চালিয়ে আসলেও ফলশ্রুতিতে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি।