যোগাযোগ, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ সর্বক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা একসময়ের অজপাড়া গাঁ হিসেবে পরিচিত কক্সবাজারের পেকুয়ার সমুদ্র উপকূলের মগনামা মিনি শহরে পরিণত হতে চলেছে। আগামী কয়েক বছরে এই মগনামাসহ আশপাশে গড়ে উঠবে শিল্প–কারখানাও। না চাইতেই এখানে গড়ে উঠছে নৌ–বাহিনী পরিচালিত আধুনিক মানের বিদ্যালয়, হাসপাতাল, মসজিদসহ উন্নয়নমুখী নানা স্থাপনা।
বিশেষ করে মগনামা–কুতুবদিয়া চ্যানেলের সমুদ্র উপকূলের মগনামা বেড়িবাঁধটি যে এতদিন ভঙ্গুর অবস্থায় ছিল, সেই অবস্থা এখন আর নেই। সেই বেড়িবাঁধ এখন শক্ত, টেকসইভাবে আরসিসি সড়কে রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে। উন্নয়নের এসব মহাকর্মযজ্ঞ সম্পাদিত হচ্ছে মগনামায় স্থাপিত দেশের প্রথম বানৌজা শেখ হাসিনা সাবমেরিন নৌ–ঘাঁটিকে ঘিরে। স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য– এতে করে নতুন একটি প্রজন্ম জানবেই না, এই মগনামা আগে কী ছিল। হয়তো পুরোনো জীবনচক্র ঘেঁটে জানবে, এখানকার মানুষ কিভাবে সমুদ্রের ভয়াবহ গর্জন ও প্রতিনিয়ত জ্বলোচ্ছ্বাসের সঙ্গে রীতিমতো যুদ্ধ করে জীবন পার করেছেন।
দেশের প্রথম নির্মিত সাবমেরিন নৌ–ঘাঁটিটি গত ২০ মার্চ কমিশনিং লাভের মধ্য দিয়ে নৌবাহিনীতে আনুষ্ঠানিকভাবে অপারেশনাল কার্যক্রম শুরু করে। এদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে সাবমেরিন নৌ–ঘাঁটির শুভ উদ্বোধন করেন। এর আগে ২০১৭ সালের ১২ মার্চ প্রধানমন্ত্রী মগনামা ইউনিয়নে ডুবোজাহাজ ঘাঁটির ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। সরেজমিন দেখা গেছে, মগনামায় বানৌজা শেখ হাসিনা সাবমেরিন নৌ–ঘাঁটির কাজ জোরেশোরে এগিয়ে যাচ্ছে। এই ঘাঁটিকে ঘিরে সমুদ্রের ভাঙনের কবল থেকে রক্ষায় নির্মাণ করা হচ্ছে স্থায়ী বাঁধ। কাদামাটির সড়ক পাকা হচ্ছে। বিদ্যালয়, হাসপাতাল, মসজিদ হচ্ছে। এমন সব অবকাঠামোর উন্নয়নে বদলে যাচ্ছে এলাকা এবং মানুষের জীবনচিত্র।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বানৌজা শেখ হাসিনা নৌ–ঘাঁটিতে যাওয়ার চকরিয়ার বরইতলী থেকে মগনামা পর্যন্ত প্রায় ২৫ কিলোমিটারের সড়কটির উন্নয়নকাজ চলছে পুরোদমে। এই সড়কটি এখন নতুন রূপ পেয়েছে ‘বানৌজা শেখ হাসিনা সড়ক’ নামে। সড়কটিকে কেন্দ্র করে উভয় পাশে নতুন নতুন স্থাপনা করছেন স্থানীয় অনেক ব্যবসায়ী। এই সড়কের শেষপ্রান্তে মগনামা গেলেই শোনা যায় সমুদ্রের গর্জন। এই অংশে সড়কের দুই পাশে একের পর এক লবণের ঘের। যেখানে কাজ করছেন চাষিরা। কিছুদূর গেলেই কাঁকপাড়া বেড়িবাঁধ। সেই বেড়িবাঁধ ধরে আধা কিলোমিটার পরই বানৌজা শেখ হাসিনা সাবমেরিন নৌঘাঁটি। প্রায় ৭০০ একর জায়গায় নির্মিত হয়েছে সাবমেরিন ঘাঁটির প্রধান কার্যালয়।
নৌবাহিনী সূত্র জানায়, বানৌজা শেখ হাসিনা নৌঘাটির কার্যক্রম শুরু হওয়াতে এরই মধ্যে এলাকার মানুষ সুফল পেতে শুরু করেছে। কাঁকপাড়া বেড়িবাঁধ নির্মাণসহ ঘাঁটিতে ১৮শ ছাত্রছাত্রীর জন্য বিএন স্কুল, অ্যাংকরেজ স্কুল, একসঙ্গে এক হাজার মুসল্লি নামাজ আদায়ে সক্ষম এরকম মসজিদ ও হাসপাতাল নির্মাণ করা হবে। এর মাধ্যমে এখানকার সমাজব্যবস্থার ব্যাপক পরিবর্তনের সঙ্গে প্রান্তিক জনপদে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগবে। একইভাবে জাতীয়ভাবে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও তথ্য–প্রযুক্তিবিষয়ক উন্নয়ন, নিরাপত্তা ব্যবস্থা, দুর্যোগ প্রাক–প্রস্তুতি, বাণিজ্যিক জাহাজের জরুরি বার্থিং সুবিধা ও ব্লু–ইকোনমি কর্মকাণ্ড বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে।
মগনামা ইউনিয়নের আফজলিয়াপাড়ার বাসিন্দা লবণ চাষি শামীম আহমেদ বলেন, একবার যদি বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকত পুরো লবণের ঘের ধ্বংস হয়ে যেত। পরিবার নিয়ে তখন অনেক বিপদে পড়তে হতো। এখন স্থায়ী বাঁধ আর বড় রাস্তা হওয়াতে আমাদের খাবার পানির সংকটও আগের মতো নেই। স্থানীয় বাসিন্দা সাংবাদিক গিয়াস উদ্দিন বলেন, অন্যান্য দুর্ভোগের কথা বাদই দিলাম। শুধুমাত্র এক কলসি খাবারের পানি আনার জন্য যেতে হতো অনেক দূরে। সেই পথ হতো একেবারে কাদামাটির। এজন্য এক কলসি খাবারের পানি আনার বিপরীতে পা ধোয়ার জন্য লাগতো কয়েক কলসি পুকুরের পানি। কাদামাটির সড়ক দিয়ে যাওয়ার সময় কী যে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হতো তা ভুক্তভোগী না হলে কেউ অনুধাবন করতে পারবেন না। শতবছরের অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ সেই দুর্ভোগচিত্র এখন আর নেই।
মগনামা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. ইউনুস চৌধুরী বলেন, বছরের সিংহভাগ সময়ই সামুদ্রিক জোয়ারের পানির সাথে যুদ্ধ করেই টিকে থাকতেন মগনামা ছাড়িয়ে আশপাশের কয়েকটি ইউনিয়নের মানুষ। বিশেষ করে সমুদ্র উপকূলের কাঁকপাড়া বেড়িবাঁধ অংশ (বর্তমানে সাবমেরিন ঘাটির প্রধান কার্যালয়) সবসময় ভেঙেই থাকতো। এতে ওই পয়েন্ট দিয়ে সামুদ্রিক জোয়ারের পানি হু হু করে ঢুকে লবণ মাঠ, ফসলি জমি, মানুষের বসতবাড়ি, গ্রামীণ অবকাঠামো তলিয়ে গিয়ে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হত।
জানতে চাইলে কঙবাজার–১ আসনের সংসদ সদস্য ও চকরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাফর আলম দৈনিক আজাদীকে বলেন, সাবমেরিন নৌঘাটি স্থাপনের মধ্য দিয়ে শতবছরের দুঃখ দূর হয়েছে এখানকার মানুষের। এই সাবমেরিন নৌ ঘাটিকে ঘিরে এখানে আধুনিক হাসপাতাল, স্কুল, মসজিদসহ আধুনিক নানা স্থাপনা তৈরি হচ্ছে। যার সুফল এখানকার মানুষ পাবে। এজন্য উপকূলীয় এই জনপদের মানুষ বেশ খুশি।