মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হিসাব পাল্টে গেছে। অন্যান্য বারের মতো সামরিক জান্তা মনে করেছিলেন, রাষ্ট্রক্ষমতা সহজে কব্জা করতে পারবেন।কিন্তু না,মিয়ানমারের জনগণ এবার তাঁদেরকে মেনে নেইনি। তাঁরা প্রতিবাদ-বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে। গড়ে তুলেছে প্রতিরোধ। ইতোমধ্যে মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে এখন পর্যন্ত ৫৪৩ জন বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন। তার মধ্যে একদিনেই (২৭ মার্চ) ১৪১ জন নিহত হন। স্থানীয় পর্যবেক্ষক সংস্থা দ্য অ্যাসিস্ট্যান্স অ্যাসোসিয়েশন ফর পলিটিক্যাল প্রিজনার্স (এএপিপি) এই তথ্য দিয়েছে। তারপরও প্রতিবাদকারীরা পিছু হটেনি। তাঁরা সর্বশেষ গেরিলা আঘাতের ডাক দিয়েছে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, মিয়ানমারের জনগণ সামরিক জান্তাকে সহজে মেনে নেবে না।
এদিকে মিয়ানমারে জান্তাবিরোধী বিক্ষোভে সহিংসতা ও কয়েক শ বেসামরিক মানুষের মৃত্যুর ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ। গত ১লা এপ্রিল জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ এই নিন্দা জানায়। বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়।
মিয়ানমারকে মূলত: সামরিক অভ্যুত্থান ও সামরিক শাসনের দেশ বললে ভুল হবে না । ৬০ বছরের বেশি সময় ধরে মিয়ানমারে ক্ষমতাসীন ছিল জান্তা সরকার। ১৯৪৮ সালে ব্রিটেন থেকে স্বাধীনতার পর বেশির ভাগ সময় সেনাশাসন চলেছে মিয়ানমারে। ১৯৬২ সালে বেসামরিক প্রশাসন বাতিল করেন জেনারেল ‘নে উইন’। পরের ২৬ বছর সরকার পরিচালনা করেন তিনি। ১৯৮৮ সালে অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও কর্তৃত্ববাদী শাসনের প্রতিবাদে ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে পদত্যাগ করেন তিনি। এর কয়েক সপ্তাহ পর দেশের সামরিক নেতাদের নতুন একটি দল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়। ২০১১ সালে জান্তা সরকারের নেতা জেনারেল থান সুয়ে পদত্যাগ করেন। দেশের সংবিধান মেনে অবসরপ্রাপ্ত জেনারেলদের সমন্বয়ে গঠিত সরকারের কাছে তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।
দেশটির সেনাবাহিনীর অভিযোগ, এবারের ভোটেও (৮ নভেম্বর’২০) ব্যাপক কারচুপি হয়েছে। যদিও এই নির্বাচনে অং সান সুচির দল জয়লাভ করে। সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং কিছুদিন আগে এক বক্তব্যে ‘মিয়ানমারের সংবিধান বাতিল’ করার হুঁশিয়ারি দেন। এরপরই উত্তেজনা চরমে ওঠে। গত জানুয়ারি’২১ এর শেষ সপ্তাহে ইয়াঙ্গুনের বাণিজ্যিক এলাকার রাস্তায়, রাজধানী নেপিডো ও অন্যান্য এলাকায় সেনাবাহিনীর ট্যাংক মোতায়েন করা হয়। নির্বাচনের ফলের বিরুদ্ধে সেনাসমর্থকেরা বিক্ষোভ করেন। এসবেরই ধারাবাহিকতায় গত ১লা ফেব্রুয়ারি’২১ তারিখে সেনা অভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটল।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে ২০০৮ সালে সাংবিধানিকভাবে দেশ পরিচালনার অংশীদার করা হয়েছে। সংসদে ২৫ শতাংশ আসন সেনাবাহিনীর জন্য বরাদ্দ আছে। এ ছাড়া প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্র ও সীমান্তবিষয়ক মন্ত্রী নিয়োগ দেওয়া হয় সেনাবাহিনী থেকে। ফলে সেনাবাহিনী একরকম ক্ষমতায়ই ছিল। মাঝে ক্ষমতা ভাগাভাগি করেছিল কিছুদিন। এখন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আবার ক্ষমতা নিজেরাই পুরোটা দখল করেছে।
প্রসঙ্গক্রমে বলা যেতে পারে যে, বিশ্বের এমন কোনো দেশ নেই যেখানে ‘জন অসন্তোষ বা ক্ষোভ নেই’। এই অসন্তোষকে পুঁজি করে সামরিক বাহিনী অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে নাগরিকদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে। মিলিটারি অধিনায়করা এখন নাগরিকদের সাথে নিয়ে অভ্যুত্থান ঘটায়। রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে সামরিক বাহিনীর নেপথ্যে থেকে বিক্ষুব্ধ নাগরিকদের রাজপথে নামিয়ে দেয়। বিক্ষোভে জনসাধারণের অংশগ্রহণ বাড়তে থাকে। এরপর মঞ্চে আবির্ভূত হয় সামরিক বাহিনী। দেশ ও জাতিকে রক্ষা করতে নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও (?) দায়িত্ব হাতে তুলে নেয় দেশপ্রেমিক (?) সামরিক বাহিনী। এটাই সামপ্রতিক সময়ে সিভিল-মিলিটারি ক্যুর নতুন চিত্র। কিন্তু মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী এবারে কোনো ভণিতা করেনি। সরাসরি প্রকাশ্যে ক্ষমতা দখল করেছে।
একটু পেছনে গেলে দেখা যাবে যে, ২০১০ সালে ‘ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি’ নির্বাচনে জয়লাভ করলেও আড়াল থেকে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করত সামরিক বাহিনী। ২০১৫ সালে অংসান সু চি’র পার্টি ‘ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি’ জয়লাভ করলেও দেশটি সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণেই ছিল। ওই সময় সামরিক বাহিনী রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বর্বর নির্যাতন করে বের করে দেয়। যাদের ঠাঁই দিয়েছে বাংলাদেশ। যা বাংলাদেশের জন্য বিরাট একটা বোঝা। অথচ সূ চি মায়ানমারের সামরিক বাহিনীর এমন বর্বর কাজের জোরালো বিরোধিতা করতে পারেনি। বরং তিনি কোনো কোনো ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর কর্মকাণ্ড সমর্থন করেছেন। টানাপোড়েনের এই পর্যায়ে কিছুদিন বিরতি দিয়ে আবারও ক্ষমতায় এখন মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী।
পৃথিবীর সামরিক শাসনের ইতিহাস নতুন নয়। যুগে যুগে অনেক দেশেই সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে ঢুকে গেছে। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশে সামরিক বাহিনী প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রক্ষমতায় ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে। কিন্তু বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্র সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ কাটিয়ে উঠতে পারলেও মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ব্যতিক্রম। এখান থেকে মিয়ানমার শিগগির বের হতে পারবে বলে মনে হয় না। কারণ, তাদের শাসনক্ষমতা অনেকটা প্রতিবেশী চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপরও নির্ভর করে।
অনেকেই সন্দেহ করছেন, মিয়ানমারের অভ্যুত্থানে চীনের ইন্ধন রয়েছে। মাত্র তিন সপ্তাহ আগে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রী মিয়ানমার সফর করেছেন। তিনি মিয়ানমারের সেনাপ্রধান ও সু চির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। চীনের হিসাব হলো, সু চির দল ফের ক্ষমতায় এলে এবং সরকারে চীনপন্থী সামরিক অফিসারদের প্রভাব হ্রাস পাবে, এতে চীন বেকায়দার পড়তে পারে।
আজকের পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থায় মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থান আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে খুব একটা প্রভাব ফেলবে না। তবে বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ঝুলে থাকবে, যা বাংলাদেশের জন্য অস্বস্তিকর বিষয় হবে। কারণ প্রায় ৮ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা নিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি এমনিতে বিশাল চাপে আছে। অন্যদিকে চীন নতুন নতুন বিনিয়োগের চেষ্টা করবে। অবশ্য মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যথারীতি উদ্বেগ করেছে। সু চিকে আটকের নিন্দা জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের চেষ্টায় জাতিসংঘ নিন্দা প্রস্তাব পাশ করলো। এদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নও নিন্দা জানিয়েছে। কিন্তু খুব বেশি কঠোর পদক্ষেপ নেবে বলে মনে হয় না। ওদিকে চীন সবাইকে শান্ত থাকার অনুরোধ জানিয়েছে। এতে করে কোন কোন দেশ লাভবান হলেও, দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতি হবে মিয়ানমার রাষ্ট্র ও তাদের অর্থনীতি। মিয়ানমারের গণতন্ত্র আরও দুর্বল হবে, প্রায় সাড়ে ৬ কোটি জনসংখ্যার ৬.৭৬ লক্ষ বর্গকিলোমিটার আয়তনের দেশ-মিয়ানমার কখনোই স্থিতিশীল ও শক্তিশালী দেশ হিসেবে দাঁড়াতে পারবে না।
এ যাত্রায় মিয়ানমারের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে আরো কয়েক হাজার আত্মাহুতি দিতে হবে। আজ হয়তো তাঁরা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে পারবে না। কিন্তু পাঁচ বা দশ বছর পর হলেও নিশ্চয় সেনাবাহিনীকে অবশ্যই পিছু হটতে হবে এবং গণতন্ত্রকে মুক্তি দিতে হবে ।
লেখক : কলামিস্ট ও সমাজকর্মী।