পার্বত্য শান্তিচুক্তির ২৭ বছর আজ

পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না হওয়ায় আ. লীগকে দুষছে আঞ্চলিক সংগঠনগুলো

সমির মল্লিক ও প্রান্ত রনি | সোমবার , ২ ডিসেম্বর, ২০২৪ at ১০:১৬ পূর্বাহ্ণ

আজ ২ ডিসেম্বর। পাহাড়ের চলমান সংঘাত থামাতে ১৯৯৭ সালের এই দিনে জনসংহতি সমিতির সাথে চুক্তি করে তৎকালীন সরকার। চুক্তির পর ২৭ বছর পেরিয়ে গেলেও পাহাড়ে সংঘাত কমেনি। চুক্তির পরবর্তী সময়ে পাহাড়ে নতুন করে তিনটি আঞ্চলিক সংগঠনের সৃষ্টি হয়েছে। চুক্তি পরবর্তী টানা ১৬ বছরসহ ২০ বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেও শান্তির চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করেনি বলে অভিযোগ আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর। এজন্য আওয়ামী লীগের সদিচ্ছাকে দুষছেন তারা।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি কেন্দ্রীয় কমিটির তথ্য ও প্রচার বিভাগের প্রধান জুপিটার চাকমা বলেন, চুক্তি সম্পাদনের পর ২৭ বছর অতিক্রান্ত হচ্ছে। তারপরও চুক্তি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন না হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান হয়নি। ফলে পাহাড়ে এখনো অশান্ত পরিস্থিতি বিরাজ করছে। তিনি বলেন, বিগত সরকারের আমলে শান্তিচুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ আমরা দেখিনি। চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ২৫টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে। ১৮টি ধারা আংশিক, ২৯টি ধারা সম্পূর্ণ অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়েছে বলে জানান তিনি। জুপিটার চাকমা বলেন, বর্তমান সরকারের কাছে চুক্তির আংশিক ও অবাস্তবায়িত ধারাগুলোর সম্পূর্ণ বাস্তবায়নের দাবি জানাচ্ছি। এদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, শান্তিচুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ২৫টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে। ১৮টি ধারা আংশিক, ২৯টি ধারা সম্পূর্ণ অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়েছে। ২০১৭ সালে পাহাড়ে সবশেষ আঞ্চলিক সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক)। সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি শ্যামল কান্তি চাকমা বলেন, সবার আশা ছিল শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে, চুক্তি বাস্তবায়ন হবে। শেখ হাসিনা সরকার চুক্তি বাস্তবায়নের কথা বললেও তারা বিভিন্ন কলাকৌশলে চুক্তিটা বাস্তবায়ন করেনি। তাদের সদিচ্ছার অভাব ছিল। বিভিন্ন প্রভাবশালী নেতার কারণে চুক্তিটি বাস্তবায়নটি হয়নি।

চুক্তি অসম্পূর্ণ ও তা বাস্তবায়নের জন্য বিগত সময়ে কার্যকর আন্দোলন গড়ে উঠেনি বলে অভিযোগ প্রসীত খীসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফের। তবে চুক্তি বাস্তবায়নে জনসংহতি সমিতি বা জেএসএস কোনো আন্দোলন করলে তাতে সামিল হবে বলে জানিয়েছে ইউপিডিএফের মুখপাত্র অংগ্য মারমা।

অন্যদিকে বিএনপির দাবি, শান্তিচুক্তির মধ্য দিয়ে পাহাড়ে বৈষম্য এবং বিভেদ বাড়ানোর পাশাপাশি পাহাড়িদের মধ্যে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত বাড়িয়েছে। চুক্তির পর পাহাড়ে অস্ত্রের ব্যবহার বেড়েছে।

চুক্তি বাতিলের দাবি জানিয়ে খাগড়াছড়ি জেলা বিএনপির সভাপতি ওয়াদুদ ভূঁইয়া বলেন, শেখ হাসিনা শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার লোভে বৈষম্য সৃষ্টিকারী শান্তিচুক্তি করেছিলেন। বাঙালিরা যেমন বৈষম্যের শিকার হয়েছিল তেমনি পাহাড়িদের মধ্যে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত বেড়েছে। বিএনপির শাসনামলে কোনো আঞ্চলিক সংগঠনের সৃষ্টি হয়নি। শেখ হাসিনা পাহাড়ে বিভক্তি তৈরি করতে আঞ্চলিক সংগঠন সৃষ্টি করেছেন। আমরা অন্তর্বর্তী সরকারকে অনুরোধ করব যাতে হাসিনার আমলে স্বাক্ষরিত বিভিন্ন কালো চুক্তির মতো শান্তিচুক্তিও বাতিল করা হয়।

চুক্তি নিয়ে ভাঙন, এক জনসংহতি সমিতি ভেঙে ৪ দল : জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) সঙ্গে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর শান্তিচুক্তি সই করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। সে সময় জনসংহতি সমিতির একটি পক্ষ এই চুক্তির বিরোধিতা করে। সরকারের সঙ্গে জনসংহতি সমিতির চুক্তি সইয়ের পর ১৯৯৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর চুক্তিবিরোধী অবস্থান নিয়ে পাহাড়ে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে প্রসিত খীসার নেতৃত্বে গঠিত হয় ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ইউপিডিএফ পাহাড়ে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানিয়ে আসছে।

এরপর ২০১০ সালে আবারও সন্তু লারমার জনসংহতি সমিতি ভেঙে আত্মপ্রকাশ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা)। সংগঠনের প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি ছিলেন সুধাসিন্ধু খীসা ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নেন তাতিন্দ্র লাল চাকমা ওরফে পেলে। প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই জনসংহতি সমিতির সঙ্গে জনসংহতি সমিতির (এমএন লারমা) রাজনৈতিক বৈরিতা থাকলেও চুক্তি বাস্তবায়নের পক্ষে কথা বলেছে দলটি।

এরপর ২০১৭ সালের ১৫ নভেম্বর খাগড়াছড়িতে এক সংবাদ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)। মূলত প্রসিত খীসার নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে সাবেক ইউপিডিএফ নেতা তপন জ্যোতি চাকমার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠা হয় ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)। ইউপিডিএফ চুক্তির বিরোধিতা করে প্রতিষ্ঠা হলেও ইউপিডিএফ ভেঙে গঠিত ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের দাবি করছে। পার্বত্য চুক্তি নিয়ে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতি ভেঙে চার দল হয়েও শেষ পর্যন্ত সব দলই এখন চুক্তির পক্ষে কথা বলছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধখেতাবপ্রাপ্ত ও বীর মুক্তিযোদ্ধা সেনাসদস্যদের সংবর্ধনা
পরবর্তী নিবন্ধপার্বত্য অঞ্চলকে পাশ কাটিয়ে উন্নয়ন সম্ভব নয় : প্রধান উপদেষ্টা