বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে ৪০ জন শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়! পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর এই নীরব মহামারীর ভয়াবহতা বোঝাতে এ তথ্যটুকুই যথেষ্ট। পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর প্রধান কারণ হলো– বাংলাদেশের গ্রাম অঞ্চলগুলোতে পুকুর, নদ–নদী, জলাশয়, ডোবার আধিক্য। সবচেয়ে বিপজ্জনক হলো বাড়ি সংলগ্ন পুকুরগুলো। পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নজর এড়িয়ে খেলতে গিয়ে অরক্ষিত পুকুরে ডুবে শিশু মৃত্যুর দুঃখজনক পরিণতি ঘটে। এসব দুর্ঘটনা সাধারণত সকাল থেকে দুপুরের মধ্যে বেশি হয়। কারণ এসময় মায়েরা সংসারের নানা কাজে ব্যস্ত থাকেন, পুরুষ অভিভাবকরা কাজের জন্য বাড়ির বাইরে থাকেন এবং পরিবারের বড় শিশুরা স্কুলে থাকে। পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর অন্যান্য কারণের মধ্যে অভিভাবকদের অসর্তকতা, শিশুদের প্রতি নজরদারি না থাকা, দেখভাল করার লোকের অভাব, তাৎক্ষণিক প্রাথমিক চিকিৎসা সর্ম্পকে জ্ঞান না থাকা, বড় বাচ্চাদের ক্ষেত্রে সাঁতার না জানা, জীবিত উদ্ধারের পর দেরিতে হাসপাতালে আনা প্রভৃতি অন্যতম। সাধারণত ৫ বছরের কম বয়সী শিশুরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে। কারণ এ বয়সের শিশুদের সাঁতার শেখানো যায় না এবং নিজেদের বিপদ বা নিরাপত্তা সর্ম্পকে তাদের কোন ধারণা থাকে না। পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর এ হার চট্টগ্রাম জেলায় সবচেয়ে বেশি।
অথচ একটু সচেতন হলে প্রতিরোধযোগ্য এ দুর্ঘটনার হার অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই মৃত্যু প্রতিরোধে কয়েকটি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা বলেছে। এগুলোর মধ্যে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপন, পাঁচ বছরের অধিক বয়সী শিশুদের সাঁতার শেখানো ও প্রাথমিক চিকিৎসা অন্যতম। সারা দেশব্যাপী প্রাক– প্রাথমিক শ্রেণি কার্যক্রমে বেশিসংখ্যক শিশুর অন্তর্ভুক্তি পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর হার কমাতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। হেলথ অ্যান্ড ইনজুরি সার্ভের তথ্য মতে, দেশে শিশু মৃত্যুর ৬০ শতাংশই ঘটে সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টার মধ্যে। তাই এসময় যদি শিশুদের নিরাপদ আশ্রয়ে রাখা যায়, তাহলে শিশু মৃত্যু অনেকটা রোধ করা যায়। দিবাযত্ন কেন্দ্রে অবস্থানের সময় শিশুদের জন্য তাদের বয়স উপযোগী খেলাধুলা, বিনোদনমূলক বিভিন্ন কিছুর উপস্থাপন কিংবা প্রাক প্রাথমিকের নানা–শিক্ষা দেয়া যেতে পারে। ৫ বছরের অধিক বয়সী শিশুদের অবশ্যই সাঁতার শেখানোর উদ্যোগ নিতে হবে। এই দক্ষতা আজীবন কাজে লাগবে। পুকুরের চারপাশে যতটুকু সম্ভব নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করা হলে তা শিশুদের নিরাপত্তা বাড়াবে। কেউ ডুবলেও তাকে উদ্ধারের পরপর তার শ্বাস ও হার্ট চালু করার যেসব প্রাথমিক উদ্যোগ আছে সেগুলো মানুষকে শেখানো বা প্রশিক্ষণ দেয়া খুবই জরুরি। কেননা হাসপাতালে নিয়ে আসার আগে অনেক শিশু মারা যায়। তাই যারা উদ্ধার করেন তাদের যদি প্রাথমিক জ্ঞান থাকে, তাহলে অনেক শিশু বেঁচে যাবে।
বিভিন্ন দুর্ঘটনা প্রতিরোধে যেরূপ প্রচার–প্রচারণা ও উদ্যোগ দেখা যায়, পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু প্রতিরোধে সে ধরনের পদক্ষেপ পর্যাপ্ত নয়। অথচ পানিতে ডুবে প্রতিবছর হাজার হাজার শিশু মারা যাচ্ছে। গবেষণার দেখা গেছে যেসব উপজেলায় দিবাযত্ন কেন্দ্র রয়েছে, সেখানে পানিতে ডুবে যওয়ার ঘটনা প্রায় ৮৫ শতাংশ কমে গেছে।
তাই দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপনসহ সরকারের নানা উদ্যোগের পাশাপাশি অভিভাবকদের সচেতনতা, প্রতিরোধমূলক উদ্যোগ ও বাস্তবায়ন পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর হার অনেকাংশে কমিয়ে আনতে পারে। হাজার হাজার সম্ভাবনাময় অবুঝ প্রাণের এমন করুণ পরিণতি কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। মানুষ সচেতন না হলে কোনো পদক্ষেপই যথেষ্ট নয়।