বন্ধ হওয়া ২৫টি পাটকল পুনরায় চালু করতে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের ১৫-২০ বছরের জন্য ভাড়ায় ইজারা দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। শুরুতে পরীক্ষামূলকভাবে ৫-৭টি পাটকল ইজারা দেওয়া হতে পারে। পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে ৯ সদস্যের একটি আন্তমন্ত্রণালয় ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করেছে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়। এ সংক্রান্ত একটি আদেশ জারি করেছে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়। আন্তঃমন্ত্রণালয় ওয়ার্কিং কমিটিতে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবকে (প্রশাসন) আহ্বায়ক করা হয়েছে। বিজেএমসি চেয়ারম্যান, সদস্য-সচিব ছাড়া এ কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রতিনিধি, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পাট), অর্থ বিভাগ, শিল্প মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধি এবং জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টারের (জেডিপিসি) নির্বাহী পরিচালক।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, বন্ধ পাটকল চালু করতে সরকার যে নীতি নিয়েছে, তাতে বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ না-ও দেখাতে পারেন, এমনটা বলছেন পাট খাতের উদ্যোক্তারা। তাঁদের বক্তব্য, মধ্যমেয়াদি ইজারা নিয়ে ৪০০-৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে চাইবেন না ব্যবসায়ীরা। কারণ, যেকোনো সময় সরকারের নীতি পরিবর্তন হলে ব্যবসায়ীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
সরকারের সিদ্ধান্ত হলো, প্রাথমিকভাবে পাটকল ১৫-২০ বছরের ইজারায় বেসরকারি উদ্যোক্তাদের দেওয়া হবে। উদ্যোক্তাদের পারফরম্যান্স ভালো হলে ইজারার মেয়াদ বাড়ানো হবে। শুরুতে ৫টি পাটকল চালুর পরিকল্পনা রয়েছে।
এখানে উল্লেখ্য, বেসরকারি পাটকল লাভের মুখ দেখলেও বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) পাটকলগুলো বছরের পর বছর লোকসান গুনছিল। লোকসানের বোঝা বইতে না পেরে ২৪ হাজার ৮৮৬ জন স্থায়ী শ্রমিককে স্বেচ্ছা অবসরে (গোল্ডেন হ্যান্ডশেক) পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করে ১ জুলাই পাটকল বন্ধ করে দেয় সরকার। বিজেএমসির আওতায় গত জুন পর্যন্ত ২৬টি পাটকলের মধ্যে চালু ছিল ২৫টি। এর মধ্যে ২২টি পাটকল ও ৩টি নন জুট কারখানা। ২০১৪-১৫ থেকে ২০১৮-১৯ পর্যন্ত পাঁচ অর্থবছরে বিজেএমসির এই পাটকলগুলোর লোকসানের পরিমাণ ২ হাজার ৯৩৩ কোটি টাকা। আর পুঞ্জীভূত লোকসান ১০ হাজার কোটি টাকা। সরকারের পাটকলগুলো ১৯৪৯ থেকে ১৯৬৭ সালের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন যেসব যন্ত্রপাতি বসানো হয়েছিল, তা দিয়েই চালানো হচ্ছিল। এ কারণে উৎপাদনশীলতা অর্ধেকে নামে। ২০০৯ সালে পাটকল লাভজনক করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও যন্ত্রপাতি আধুনিকায়ণে নজর দেওয়া হয়নি। তাতে এক টন পণ্য উৎপাদনে বেসরকারি মিলে যেখানে ২৫-২৮ জন শ্রমিক লাগে, সেখানে সরকারি মিলে প্রয়োজন হতো ৬৫-৭০ জন।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত তথ্যে জানা গেছে, সোনালি আঁশে সমৃদ্ধ অর্থনীতির স্বপ্নে স্বাধীনতার পরের বছর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ জুট মিলস কর্পোরেশন (বিজেএমসি) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। প্রতিষ্ঠাকালে বিজেএমসির আওতায় ৭৬টি পাটকল ছিল। কিন্তু ধারাবাহিক লোকসানের কারণে মিলসংখ্যা কমতে কমতে ২৫-এ ঠেকে। গত ১ জুলাই পাটকলগুলো বন্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠার ৪৮ বছরের মধ্যে ৪৪ বছরই লোকসানে ছিল বিজেএমসি। বর্তমানে সংস্থাটির পুঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণ ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। যদিও বেসরকারি খাতের অনেক পাটকল ঠিকই মুনাফা করতে পারছে। বন্ধ ঘোষণার কারণ হিসেবে সরকারের পক্ষে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের পাট শিল্পকে আবার কীভাবে প্রতিযোগিতায় আনা যায় এবং কীভাবে শক্তিশালী করা যায়, সে বিবেচনা থেকেই পাটকলগুলো বন্ধ করা হয়েছে। সেই কর্মপরিকল্পনার একটি সারাংশ প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে পাঠিয়েছিল বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়। সেই সারাংশে স্বাক্ষর করে কার্যক্রম বন্ধের বিষয়ে মত দিয়ে প্রধানমন্ত্রী পাটকলগুলো দ্রুত চালুর বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে নির্দেশও দিয়েছেন।
অর্থনীতিবিদরা বলেন, লোকসানের ভার বইতে না পেরেই সরকারকে পিপিপির কথা ভাবতে হয়েছে, আর মুক্ত বাজার অর্থনীতির বাস্তবতায় তা ‘যথাযথ’। আন্তর্জাতিক বাজার অনুযায়ী কিন্তু আমরা সরবরাহ দিতে পারছিলাম না। উৎপাদন খরচের সঙ্গে সমন্বয় করে মুনাফার বিষয়টিও আসে। সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে সরকারের পক্ষে যে দীর্ঘ ক্ষতি, তা আর বহন করা সম্ভব না আসলে। পাট খাতকে বাঁচাতে বেসরকারি খাতকেই এখন এগিয়ে আসতে হবে।