গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, বৈশ্বিক অভিবাসীর উৎস তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। কর্মসংস্থানের জন্য প্রতি বছর বিদেশ পাড়ি দিচ্ছেন গড়ে অন্তত ১০ লাখ মানুষ। উন্নততর কর্মসংস্থান ও জীবিকার খোঁজে বিদেশ পাড়ি দিতে আগ্রহীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এ সুযোগের ফায়দা নিতে গড়ে উঠেছে সক্রিয় সিন্ডিকেট। দালাল চক্রকে কাজে লাগিয়ে সংঘটিত হচ্ছে অবৈধ পথে কর্মী পাঠানো, মানব পাচারের মতো অপরাধ। অনেক ক্ষেত্রে এসব অপরাধ ঘটছে রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে। পাচার হওয়া কর্মীরা বিদেশে গিয়ে শ্রমশোষণ, নির্যাতন এমনকি অপহরণ ও হত্যারও শিকার হচ্ছেন। এতে বিপত্তিতে পড়ছে বাংলাদেশের শ্রমশক্তি রফতানি খাত। অভিযোগ আছে, মানব পাচার সিন্ডিকেট সব সরকারের আমলেই রেহাই পেয়ে যায়।
মানব পাচার ও অবৈধ অভিবাসন রোধে প্রায়ই বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেয়া বন্ধের ঘোষণা দিচ্ছে জনশক্তি আমদানিকারক দেশগুলো। বিএমইটির তথ্য অনুযায়ী, গত ১২ বছরে ওমান, বাহরাইন, ইরাক, লিবিয়া, সুদান, মালয়েশিয়া, মিসর, রোমানিয়া, ব্রুনাই ও মালদ্বীপে বাংলাদেশের শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে গেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের শ্রমবাজার আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ না হলেও গত বছর জুলাই থেকেই ভিসা ইস্যু বন্ধ করে দিয়েছে দেশটি। একই সময়ে মালদ্বীপের পক্ষ থেকেও বাংলাদেশী কর্মীদের জন্য ভিসা দেয়া বন্ধ করে দেয়া হয়। দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার বড় শ্রমবাজার মালয়েশিয়াও নিয়মিত বিরতিতে বাংলাদেশী কর্মীদের জন্য ভিসা গ্রহণের পথ রুদ্ধ করে দেয়। মানব পাচারের অভিযোগে সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরবের বাংলাদেশীদের জন্য ওমরাহ ভিসা দেয়া বন্ধ করারও নজির রয়েছে। ২০১৭ সালে একইভাবে ভিসা বন্ধের ঘোষণা দেয় বাহরাইন। বারবার অবৈধ অভিবাসন ও মানব পাচারের অভিযোগে এসব দেশে নিয়মিতভাবেই বৈধ ভিসা নিয়ে যাওয়া ব্যক্তিদেরও হয়রানিতে পড়তে হচ্ছে। কোনো কোনো দেশে বিমানবন্দরে কর্তৃপক্ষের দুর্ব্যবহার ও হেনস্তার শিকার হওয়ার অভিযোগও পাওয়া যায়।
মানব পাচারের মতো জঘন্য অপরাধের ঘটনায় অপরাধীদের শাস্তি বেশির ভাগ সময় হয় না, হলেও তাতে দীর্ঘসূত্রতা লক্ষ করা যায়। পাচার রোধে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে এক বিশ্লেষক বলেন, আমি অনেক বছর ধরে সচেতনতা তৈরিতে কাজ করছি। কিন্তু এটা অন্তহীন একটা প্রক্রিয়া। এখনো মা–বাবা ও পরিবারকে সচেতন করা দরকার বিপদগুলো কোথায় হতে পারে। পাচার কখনো থেমে নেই, আগে একভাবে হতো, এখন অন্যভাবে হচ্ছে। ভালো একটা জীবনের স্বপ্নে অনেক কিছু বুঝতে না পেরে তারা পাচারকারীদের ফাঁদে পড়ে। অভিভাবকেরা লাভের কথা ভেবে ঝুঁকিগুলো বিবেচনা করে না। তাদের বোঝাতে হবে, এর পরিবর্তে তাকে লেখাপড়া শিখিয়ে দক্ষ করে তুললে সে এর চেয়ে অনেক গুণ ফিরিয়ে দিতে পারবে। তাদের জন্য অনেকগুলো অপশন তৈরি করে অভিভাবকদের সে সম্পর্কে সচেতন করতে হবে।
মানব পাচার যে কত বড় মানবাধিকার লঙ্ঘন, তা আমাদের দৃঢ়ভাবে উপলব্ধি করতে হবে, ধারণ করতে হবে। শক্তিশালী অনেক সামাজিক রীতিনীতি আছে, যা আমাদের চ্যালেঞ্জ করতে হবে। এখানে কাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক কিছু বিষয়ও রয়েছে। আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও শক্তিশালী করে দায়বদ্ধতার আওতায় আনতে হবে। পাচারের বিরুদ্ধে সরকারের পাশাপাশি আমাদের সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা জরুরি।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, দেশে মানব পাচার আইনের যথাযথ প্রয়োগ হয় না। আইন–শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সবার মধ্যে সচেতনতাও কম। আইনের প্রয়োগ বাড়ানো দরকার। মামলার চূড়ান্ত পর্যায়ে আসে কম। মানব পাচার একটি আন্তর্জাতিক চক্র। বাংলাদেশ একা কাজ করলে হবে না। যেসব রুট জানা যায়, সেসব দেশে বর্ডার ফোর্স, ইন্টেলিজেন্ট ও ইন্টারপোলের সমন্বয়ে কাজ করতে হবে। রুটগুলো চিহ্নিত করতে বিভিন্ন দূতাবাস, গবেষকের মাধ্যমে আরো তৎপরতা দরকার। যদি দৃষ্টান্তমূলকভাবে কয়েকটি ব্যবস্থা নেয়া যায় তাহলে অন্যরাও সচেতন হবে। জিরো টলারেন্স অবস্থান নিতে হবে। গোয়েন্দা সংস্থাও চাইলে মানব পাচারের সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করতে পারে। তাদের অনেকেরই ঢাকায় অনলাইন কিংবা সাইনবোর্ড অথবা অন্য কোনো স্টাবলিশমেন্ট আছে। সাইবার সিকিউরিটি ও ইন্টেলিজেন্স বাহিনী তাদের শনাক্ত করতে পারবে।