দুর্নীতিকে এক নম্বর শত্রু বলে উল্লেখ করেছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মাননীয় ফেলো ও অর্থনীতির শ্বেতপত্র প্রস্তুতি কমিটির সভাপতি ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। গত বুধবার সকালে রাজশাহীর একটি হোটেলে দেশের বিদ্যমান অর্থনৈতিক অবস্থার শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির জনশুনানি অনুষ্ঠানে তিনি বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, ‘আগামীতে দেশের যেকোনো সমস্যা নিরসনের জন্য যদি আমরা দুর্নীতি দূর করতে না পারি, তাহলে অনেক সম্ভাবনাই কার্যকরী হবে না। এই দুর্নীতি বন্ধ করার বড় বিষয় হচ্ছে যেমন করেই হোক পাচার হয়ে যাওয়া টাকা ফেরত আনতে হবে। দেশের ভেতরে যাঁরা দুর্নীতি করেছেন তাঁদের শাস্তি অবশ্যই হতে হবে। দৃশ্যমান শাস্তি না হলে আগামী দিনে যে নীতিগত মূল্যবোধভিত্তিক নজরদারির কথা বলছি, সেটা দুর্বল হয়ে যাবে। কাজেই দুর্নীতি আমাদের এক নম্বর শত্রু।’ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরো বলেন, ‘আমরা দেখেছি বিগত সময়ে সচিবরা কিভাবে ব্যবসায়ী হয়ে গেলেন। ব্যবসায়ীরা কেমন করে রাজনীতিবিদ হয়ে গেলেন। অনেকে মনে করেন, শুধু ব্যবসায়ীরাই রাজনীতিবিদ হননি, রাজনীতিবিদরাও ব্যবসায়ী হয়ে গেছেন।’ এর আগে রাজশাহীবাসীর স্থানীয় অর্থনৈতিক অনিয়ম, দুর্নীতি ও সার্বিক অবস্থার কথা শোনে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি। এ জনশুনানিতে নাগরিকরা মেগাপ্রকল্প, ফ্লাইওভার, জলাবদ্ধতা, দ্রব্যমূল্যের লাগামহীনতা, সিডিএ–ওয়াসার মতো সংস্থার নানা অনিয়ম–দুর্নীতির কথা তুলে ধরেন।
পাচার হয়ে যাওয়া টাকা ফেরত আনার ব্যাপারে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য গুরুত্ব দিয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসও শুরু থেকে বলে এসেছেন বিগত বছরগুলোতে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনা অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানিয়েছে, ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার হচ্ছে, শেখ হাসিনার ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনামলে বিদেশে পাচার হওয়া শতকোটি ডলার দেশে ফিরিয়ে আনা। অন্যদিকে, অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদও বিদেশে অর্থ পাচারকারীদের কঠোর বার্তা দিয়েছেন। তিনি অর্থ পাচারে জড়িতদের নামের তালিকা তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন। এছাড়া পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরত আনতে সংশ্লিষ্ট দেশের আইন পর্যালোচনার পাশাপাশি বিদ্যমান আইনগুলো খতিয়ে দেখতেও বলেছেন তিনি। দেশে যাতে নতুন করে কালো টাকার জন্ম না হয়, সে ব্যাপারেও পদক্ষেপ নিতে বলেছেন অর্থ উপদেষ্টা। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, সমপ্রতি অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এসব নির্দেশনা দেন তিনি। আবার, প্রথম কার্যদিবসে অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা ঘোষণা করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেছেন, অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তিনি আরও বলেছেন, যারা টাকা পাচারের সঙ্গে জড়িত, সুনির্দিষ্ট অনুসন্ধানের মাধ্যমে তাদের বের করতে হবে। এছাড়া তাদের অনিয়মে যারা সহায়তা করেছে, তাদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে।
অর্থ পাচার নিয়ে অতীতে অনেক আলোচনা হলেও বাস্তবে পাচার রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। শুধু তাই নয়, রক্ষক হয়ে ভক্ষকের ভূমিকা পালনের খবরও বেরিয়েছে। পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যে জানা গেছে, বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) অর্থ পাচার ঠেকানোর দায়িত্বে থাকলেও উলটো সংস্থারটিরই ঊর্ধ্বতন কতিপয় সদস্য পাচারকারীদের সহায়তা করেছে। সংস্থাটির এক সদ্য পদত্যাগী বলেছেন, অর্থ পাচারের সবকটি দরজা দুর্নীতিবাজদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ায় দেশ থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থ পাচার হয়ে গেছে। রাজনৈতিক পালাবদলের এ প্রেক্ষাপটে কেউ যাতে অর্থ তুলে নিয়ে পালিয়ে যেতে না পারে, তা প্রতিরোধে সন্দেহভাজনদের ব্যাংক হিসাব জব্দকরণসহ বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
আসলে দেশে থেকে বিদেশে অর্থ পাচার হওয়ার বিষয়টি নতুন নয়। বিগত অনেক বছর ধরেই তা চলছে এবং দিন দিন আশংকাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কোনোভাবেই অর্থ পাচার যেমন বন্ধ করা যাচ্ছে না, তেমনি পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনারও কোনো প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে না। বিশ্লেষকরা বলছেন, দুর্নীতি ও অর্থ পাচার সংক্রান্ত অপরাধগুলো বিশ্বের যেসব দেশে সাফল্যের সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে; দেখা যাচ্ছে, সেখানে দুদকের মতো দুর্নীতিবিরোধী রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোই মূল ভূমিকা পালন করেছে। সামগ্রিক অবস্থা পর্যালোচনা করে অর্থনীতিবিদরা বলেন, পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে প্রশাসনিক কঠিন উদ্যোগ নিতে হবে।