চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ‘অপরাজনৈতিক’ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। তিনি বলেন, আমাদের অনেক ইনস্টিটিউট চলছে, যেখানে সরকারের অনেক বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। শুধুমাত্র অপরাজনীতির কারণে সেখানে সত্যিকার অর্থে জবাবদিহিতার অনেক সমস্যা আছে। আমরা জানি চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অবস্থাও খুব খারাপ। সেখানে দলাদলি, ছাত্রদের মধ্যে নেতৃত্ব ইত্যাদি দেয়ার জন্য অপরাজনৈতিক একটা অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। যারা সেখানে রাজনীতি করেন, বাইরে থেকে যারা সহযোগিতা করেন বা মুরুব্বি হিসেবে দিকনির্দেশনা দেন তাদেরকে বলব, এই সন্তানদের (ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী) ভবিষ্যৎ অন্ধকার করার কাজ যেন আমরা না করি। পলিটেকনিক ইনস্টিটিউগুলোকে এই ধরনের কাজ করা থেকে বিরত রাখা উচিত। তিনি গতকাল শুক্রবার সকালে ইউসেপ বাংলাদেশ এর ৫০ বছর পূর্তি উৎসব অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন। ইউসেপ চট্টগ্রাম রিজিওনের অন্তর্ভুক্ত কালুরঘাটস্থ এ কে খান ইউসেপ টিভিইটি কমপ্লেক্সে অনুষ্ঠিত দিনব্যাপী এ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ইউসেপ বাংলাদেশের বোর্ড অব গভর্নরস এর সাবেক চেয়ারপার্সন ও এ কে খান ফাউন্ডেশন এর ট্রাস্টি সেক্রেটারি সালাউদ্দিন কাশেম খান। স্বাগত বক্তব্য রাখেন ইউসেপ বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. মো. আবদুল করিম। বিশেষ অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম–৮ আসনের সংসদ সদস্য আবদুচ ছালাম, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক ড. নাজনীন কাওসার চৌধুরী, ইউসেপ বাংলাদেশের এসোসিয়েশন মেম্বার ও দৈনিক আজাদীর পরিচালনা সম্পাদক ওয়াহিদ মালেক, এ কে খান এন্ড কোম্পানির চেয়ারম্যান এ এম জিয়াউদ্দিন খান, বিভাগীয় সমাজসেবা পরিচালক কাজী নাজিমুল ইসলাম ও বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের পরিচালক ড. ইন্দ্রানী ধর।
মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থাকে মূল ধারার শিক্ষা ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। কারণ তার স্বপ্ন ছিল জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তর করা। জনসংখ্যা যখন দক্ষ হয় তখন সেখানে বিনিয়োগ হয়। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্ন আজ তার কন্যার নেতৃত্বে বাস্তবায়নে আমরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। আমাদের অনেক প্রতিবন্ধকতা আছে। অনেক জায়গা থেকে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা হচ্ছে যাতে কারিগরি বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে আমরা জনগণের মাঝে জনপ্রিয় করতে না পারি। অনেক প্রভাবশালী, কতিপয় শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাও বলছেন, কেন দরকার এটা। আমাদের সাধারণ শিক্ষা পদ্ধতির মধ্যে যখন আমরা এনেছি তখন বলছে, শুধুমাত্র শ্রমিক বানানোর জন্য কারিকুলাম তৈরি করা হয়েছে। তিনি বলেন, সনদ নির্ভরতা থেকে বের হয়ে এসে দক্ষতা নির্ভরতায় আমরা যেতে চাই। দক্ষতার মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার অন্যতম প্রক্রিয়া এটি।
তিনি বলেন, বেশিরভাগ শিক্ষার্থী সাধারণ শিক্ষামুখী। বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর ৭০ শতাংশ বেকারত্বের মুখে পড়ছে। এখানে বেকারত্ব বলতে শতভাগ যে তারা কর্মহীন তা নয়। যার ৩০ হাজার টাকা আয় করার কথা সে এখন ১৩ হাজার টাকায় চাকরি করছে। সেটাকে তো বেকারত্বই বলা যায়। এখানে তো আমার দক্ষতা যোগ্যতাকে যথাযথ কাজে লাগাতে পারছি না। সেটা একধরনের আন্ডার এমপ্লয়মেন্ট। যেটা আন–এমপ্লয়মেন্ট এর মতই। আমার সন্তান যদি দক্ষ হত, সাথে বিএ এমএ পাশ করত তাহলে তার কোনো সমস্যা ছিল না।
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, বাবা–মাকে বলব, আপনারা নিজের সন্তানের দিকে তাকিয়ে ও পরবর্তী প্রজন্মের কথা চিন্তা করে তাদের দক্ষতানির্ভর শিক্ষা দিন। বেসরকারি খাতে আমাদের অনেক পলিটেকনিক্যাল ভোকেশনাল এডুকেশন সৃষ্টি হয়েছে। আপনার সন্তানকে সেখানে ভর্তি করান। সেখানে অনেক শর্ট কোর্স আছে। দক্ষতা সম্পর্কিত কোনো কোর্স করলে আপনার সন্তান কখনোই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। বরং তার কাজের ক্ষেত্র ও পরিধি অনেক বৃদ্ধি পাবে। শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ডিগ্রি নিয়ে তার পক্ষে বাংলাদেশের মত অর্থনীতিতে কর্মসংস্থান করা খুব কঠিন। সার্ভিস সেক্টর আমাদের এত বড় নয়।
নওফেল বলেন, সাধারণ শিক্ষা সেটা আছেই। কিন্তু সেখান থেকে কর্মসংস্থান করা এবং দেশে বিনিয়োগ আনা সম্ভব নয়। বিদেশে গিয়েও আয় রোজগার বৃদ্ধি করা সম্ভব নয়। সুনির্দিষ্ট দক্ষতা ছাড়া চাকরিদাতা কাউকে চাকরি দিতে চাইবেন না। সেটা ফ্যাক্টরি বা অফিস সম্পর্কিত দক্ষতা হতে পারে। সুতরাং দক্ষতার জায়গায় আমাদের সচেষ্ট হতে হবে।
কারিগরি শিক্ষায় গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, বিএ, এমএ পাশ করলে বোধহয় চাকরি পাওয়া যাবে, সমাজে এমন মানসিকতা সৃষ্টি হয়েছে। সরকারি চাকরির সংখ্যা খুব সীমিত। বেসরকারি খাতে সার্ভিস সেক্টরেও চাকরি খুব সীমিত। সেই চাকরি করার জন্য যে ডিগ্রি পাশ করতে হয় সেটা যে কোনো বয়সে করা যায়। সরকারি চাকরিতে ঢোকার জন্য ৩০ বছর বয়স পর্যন্ত সময় থাকে। কিন্তু তার আগে যদি আমরা দক্ষতামূলক কোনো প্রশিক্ষণ নিই তাহলে যে কোনো জায়গায় কর্মদাতা আমাকে অগ্রাধিকার দেবে। কিন্তু আমরা যদি বসে থাকি কখন বিএ এমএ পাশ করার পর কেরানির চাকরি নেব, সেটা করলে নিজের আয়ও বৃদ্ধি পাবে না, সমাজও লাভবান হবে না এবং দেশও লাভবান হবে না।
তিনি বলেন, আমরা চাচ্ছি কারিগরি শিক্ষা সম্প্রসারণ করতে। এখানে টিচারের ক্রাইসিস আছে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য অনেক ইনস্টিটিউট করা হয়েছে। এখানে সুশাসন একটা বড় ফ্যাক্টর। কিছুদিন আগে আপনারা দেখেছেন, কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে কি হচ্ছিল। সার্টিফিকেট জালিয়াতি হচ্ছিল, সেগুলো আমরা ধরেছি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে অনেককে আমরা ধরেছি, আরো ধরছি। আরব আমিরাতে আমাদের দেশ থেকে সার্টিফিকেট নিয়ে চলে গিয়েছে। ব্যক্তি নিজেকে বলে ইলেকট্রিশিয়ান, আদতে তার ক্লিনারের দক্ষতাও নেই। কিন্তু সার্টিফিকেট ঠিক আছে।
ড. মো. আবদুল করিম যুদ্ধবিদ্ধস্ত বাংলাদেশে সুবিধাবঞ্চিত পথ–শিশুদের কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তাদের শোভন কর্ম–সংস্থানে মানব হিতৈষী লিন্ডসে এ্যালান চেইনীর উদ্যোগকে দূরদর্শী ও সময়োপযোগী বলে আখ্যায়িত করেন। এসময় তিনি ইউসেপের প্রতিষ্ঠা ও এর বিকাশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পৃষ্ঠপোষকতার কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণে কারিগরি শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই মর্মে মন্তব্য করেন।
আবদুচ ছালাম বলেন, ইউসেপ বাংলাদেশ এদেশে হাজারো তরুণ স্বপ্নবাজের স্বপ্ন–সারথি হয়ে নিরন্তর কাজ করে চলেছে। ইউসেপ বাংলাদেশ কেবল হাতেখড়িতে প্রশিক্ষণ দেয় না, চাকরিরও ব্যবস্থা করেন। ইউসেপ থেকে বের হয়ে চাকরি পায়নি এমন কাউকে পাওয়া যাবে না।
সালাহউদ্দিন কাশেম খান বলেন, কোয়ালিটি এডুকেশন নিশ্চিত করতে হবে। টেকনিক্যাল স্কিল বাড়াতে হবে।
ওয়াহিদ মালেক বলেন, জাতির পিতার আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে লিন্ডসে এ্যালান চেইনী ১৯৭২ সালে নতুন বাংলাদেশের যুব সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ইউসেপ প্রতিষ্ঠা করে। বর্তমানে সাতটি জেলার বিভাগীয় শহরে ইউসেপ এর কার্যক্রম চলছে। প্রতিবছর ৩৫ হাজার শিক্ষার্থী ইউসেপ থেকে কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করে বিভিন্ন পর্যায়ে দেশকে এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। তিনি বলেন, সমাজে আমরা যারা একটু ভালো অবস্থানে আছি তারা যদি চারপাশে সুবিধাবঞ্চিতদের মাঝে হাত বাড়িয়ে দিই, তাদের এগিয়ে যেতে যদি সাহায্য করি তবেই একটি সুুন্দর, সুস্থ বাসযোগ্য বাংলাদেশ আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য রেখে যেতে পারব।
ড. নাজনীন কাওসার চৌধুরী বলেন, আমাদের অর্থনীতিতে ইউসেপ ভূমিকা রাখছে। সেটা দেখে আমি খুব আনন্দিত।
মো. আকরাম হোসেনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ইউসেপ নিয়োগকর্তা কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইউসুফ, এসএম আবু তৈয়ব, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এ এফ এম ফেরদৌস, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর কাজী নুরুল আমিন মামুন, ইউসেপ বাংলাদেশের উপ–পরিচালক প্রকৌশলী জয় প্রকাশ বড়ুয়া, ইউসেপ চট্টগ্রাম অঞ্চলের আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক মাসুদ আলম খান।