পর্যটকশূন্য সেন্টমার্টিনে স্থবির ব্যবসা-বাণিজ্য

সঙ্কটে স্থানীয় বাসিন্দারা

শাহেদ মিজান, কক্সবাজার | শনিবার , ২২ নভেম্বর, ২০২৫ at ৫:৩৭ পূর্বাহ্ণ

গত ১ নভেম্বর দেশের অন্যতম দর্শনীয় স্থান সেন্টমার্টিন পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে সরকার। সেই সাথে পর্যটকবাহী জাহাজগুলোকেও চলাচলে অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু ২২ দিন অতিবাহিত হলেও চলাচল করেনি কোনো জাহাজ। যার কারণে সেন্টমার্টিনে ঘুরতে যেতে পারেনি কোনো পর্যটক। জাহাজ মালিকরা জানিয়েছেন, মূলত রাত্রিযাপনে অনুমতি না থাকায় পর্যটকদের সাড়া না পেয়ে জাহাজ চলাচল শুরু হয়নি।

পর্যটনের এই ভরমৌসুমেও পর্যটক না যাওয়ায় চালু হয়নি সেন্টমার্টিনের পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসাগুলো। স্থবির হয়ে আছে হোটেলমোটেল, রেস্টুরেন্ট, দোকানপাট, পরিবহনসহ সব সেক্টর। কর্মহীন হয়ে পড়েছে পর্যটন শিল্পের সাথে জড়িত লোকজন। ফলে এই দ্বীপের অর্থনীতির পরিস্থিতি মারাত্মক ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে। হতাশা, অনিশ্চয়তা আর অভাবঅনটনে হাহাকার করছে বাসিন্দারা। সরকারি বিধিনিষেধের বেড়াজালে পড়ে প্রবাল দ্বীপটিতে পর্যটকশূন্য, নীরব ও নিঃসঙ্গ পরিস্থিতি বিরাজ করছে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, অতীতে প্রতি বছর ১ অক্টোবর থেকে সেন্টমার্টিনগামী পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল শুরু হয়। কিন্তু গত তিন বছর ধরে এই নিয়ম বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। ২০২৪ সালে সরকারি নিষেধাজ্ঞা আর পর্যটন সংশ্লিষ্টদের আন্দোলন সংগ্রাম মিলে ডিসেম্বর থেকে জাহাজ চলাচল শুরু করে এবং ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মাত্র দৈনিক মাত্র দুই হাজার পর্যটক গমণের অনুমতি দেয় সরকার। কিন্তু ডিসেম্বর ও জানুয়ারি এই দুই মাসে রাত্রিযাপন সীমাবদ্ধ করা হয়।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, গত মৌসুমের স্বল্প সময় এবং সীমিত পর্যটন ব্যবসা দিয়ে লাভ তো দূরের কথা পুঁজিও তুলতে পারেনি পর্যটন ব্যবসায়ীরা। অন্যদিকে পর্যটন শিল্পে জড়িত ভ্যানচালক, বিভিন্ন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীসহ অন্যান্যরা প্রত্যাশিত আয়ের অর্ধেকও আয় করতে পারেনি। এতে গত ৯ মাস ধরে চরম অভাবঅনটনে দিন পার করেছে অনেক স্থানীয় বাসিন্দা।

সেন্টমার্টিনের হোটেল ব্যবসায়ী নেতা আবদুল মালেক বলেন, দ্বীপে দুই শতাধিক হোটেল, মোটেল ও রেস্টুরেন্ট রয়েছে। কিন্তু পর্যটক না থাকায় সবকিছু বন্ধ রয়েছে। হোটেলমোটেলগুলো এখন প্রায় খালি পড়ে আছে। বুকিং নেই, কর্মচারীরা বেকার বসে আছে। লোকসানের বোঝা টানতে টানতে আমরা ব্যবসায়ীরা দিশেহারা হয়ে পড়েছি।

পর্যটনকেন্দ্রিক বিভিন্ন ক্ষুদ্র ব্যবসা করে সংসার চালান অনেকে। তারা এখন বড় দুঃসময় পার করছে। স্থানীয় বাজারের দোকানদার মোহাম্মদ জুবাইর বলেন, পর্যটন মৌসুমকে ঘিরে ব্যবসায়ীরা নতুন করে প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। সব দোকানে মালামাল তুলেছে। নতুন করে বাড়তি কর্মচারী নিয়োগ করেছে। কিন্তু পর্যটক না আসায় সব কিছু স্থবির হয়ে পড়ে আছে। এতে হিমশিম খেতে হচ্ছে মালিকদের। স্থানীয় বাসিন্দা ভ্যানচালক শাসমুল আলম বলেন, গত বছর মাত্র দুই মাস পর্যটন মৌসুম পেয়েছিলাম। ওই সময়ের আয় দিয়েই তিনচার মাস সংসার চলেছে। তারপর থেকে আয়ের সব পথ বন্ধ। এখন পুরো পরিবার নিয়ে দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করছি।

সেন্টমার্টিন হোটেলরেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সভাপতি এম এ রহিম জিহাদী বলেন, সরকারের নির্দেশনায় নভেম্বর থেকে পর্যটকরা দ্বীপে যেতে পারবেন, কিন্তু রাতে থাকতে পারবেন না। এতে আগ্রহ হারাচ্ছেন পর্যটকরা। আবার জাহাজ না চলায় ভ্রমণই অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ফলে দ্বীপের প্রায় সব মানুষ এখন অনাহারেঅর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে। তিনি বলেন, পর্যটন নির্ভর অর্থনীতির ওপর টিকে থাকা সেন্টমার্টিনে এখন এক ভয়াবহ মানবিক সংকট তৈরি হয়েছে। দ্বীপের ৮০ শতাংশ মানুষ সরাসরি বা পরোক্ষভাবে পর্যটনের সঙ্গে জড়িত। তাই সংকটটা প্রকট হয়েছে।

সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ফয়েজুল ইসলাম বলেন, মানুষের আয় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকেই দ্বীপ ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন, যারা আছেন তারাও কষ্টে দিন পার করছেন। যদি দ্রুত জাহাজ চলাচল শুরু না হয়, তাহলে বড় মানবিক বিপর্যয় দেখা দেবে।

এদিকে, সাতটি পর্যটকবাহী জাহাজ প্রস্তুত রয়েছে কক্সবাজার শহরের নুনিয়ারছড়ার অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) ঘাটে। সবকিছু ঠিকটাক থাকলে ১ ডিসেম্বর থেকে জাহাজ চলাচল করবে।

এ ব্যাপারে সি ক্রুজ অপারেটর ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (স্কোয়াব) সাধারণ সম্পাদক হোসাইন ইসলাম বাহাদুর বলেন, রাত্রিযাপনের সুযোগ না থাকায় চলতি মাসে পর্যটক সংকটের ফলে জাহাজ চলাচল সম্ভব হচ্ছে না। আমরা সবধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম জাহাজ ছাড়ার, কিন্তু দিনে এসে দিনে ফিরে যাওয়ার বাধ্যবাধকতায় পর্যটকদের অনাগ্রহ দেখা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের লোকসানের মুখে পড়তে হচ্ছে, ফলে আমরা এ মাসে সেন্টমার্টিন যাত্রা পরিচালনায় বিরত থেকেছি।

তিনি আরও বলেন, ডিসেম্বরজানুয়ারিতে রাত্রিযাপনের সুযোগ থাকায় ১ ডিসেম্বর থেকে কক্সবাজারসেন্টমার্টিন রুটে জাহাজ স্বাভাবিকভাবে চলাচল করবে। পর্যটন শিল্পের স্বার্থে বিধিনিষেধ শিথিল হলে সেন্টমার্টিনের বাসিন্দাদের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা লাভবান হবেন। এক্ষেত্রে সরকারের সদয় দৃষ্টি প্রত্যাশা করছি।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট শাহিদুল আলম বলেন, নভেম্বর থেকে জাহাজগুলোকে অনুমোদন প্রক্রিয়া শুরু হয়। কিন্তু তখন অনুমোদন নেয়নি মালিকপক্ষ। তবে পরে তারা অনুমোদন নিয়েছেন। ইতোমধ্যে সাতটি জাহাজ অনুমোদন দেয়া হয়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবৈদ্যুতিক শক দিয়ে কাপ্তাই লেকে মাছ শিকার
পরবর্তী নিবন্ধমাংস কিনতে এসে মুহূর্তেই হলেন লাশ