ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত চিরন্তন, শাশ্বত জীবন বিধান। ইসলামে যেমন রয়েছে নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত নামক মৌলিক জীবন বিধান–তেমনি রয়েছে শিক্ষা ব্যবস্থা, অর্থ ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা, রাষ্ট্র ব্যবস্থার মতন মানব জীবনের প্রাত্যহিক জীবন ধারনের সবটুকু উপকরণ। আর আল্লাহতায়ালা এই জীবন ব্যবস্থা পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন সূরা মায়েদার একটি আয়াতের মাধ্যমে, ‘আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীন পরিপূর্ণ করে দিলাম, আর তোমাদের উপর আমার নেয়ামতও পুরো করে দিলাম, তোমাদের জন্য জীবন বিধান হিসাবে আমি ইসলামকেই পছন্দ করলাম’–সূরা– মায়েদা–২। নারীর সতীত্ব রক্ষার জন্য পর্দা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান। পর্দা না থাকলে নারীর সৌন্দর্য ভূলন্ঠিত হয়। এটি প্রয়োগের মাধ্যমে সমাজের ফেতনা–ফাসাদ অনেকাংশে কমে যায়, ধর্মীয় ভাবধারা সৃষ্টি হয়। সর্বোপরি আল্লাহতায়ালার একটি ফরজ বিধান প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি মূলত শুধুমাত্র নারীর সম্ভ্রম রক্ষার জন্য তৈরি হয়নি, বরঞ্চ সামাজিক কলুষতা ও অশ্লীলতা বন্ধ করার একটি অন্যতম উপায় হিসাবে আল্লাহ তায়ালা বিধানটি নাযিল করেছেন। নারীঘটিত ঘটনা প্রবাহ অধিকাংশই সংঘটিত হয় নারীর পর্দা লঙ্গনের মাধ্যমে। আর এটি হল নারীদের সতীত্ব ও ইজ্জত আবরুর অন্যতম রক্ষাকবচ। নারীদের উপর পর্দার এই বিধান কোন ধরনের অবিচার কিংবা বৈষম্য সৃষ্টির জন্য করা হয়নি। বরং তাদের পবিত্রতা ও সতীত্ব রক্ষার্থে এই বিধানের পূর্ণ অনুসরণ অনিবার্য করা হয়েছে। সূরা আহযাবের ৩৩ নং আয়াতে এই বিষয়টি স্পষ্ট করে দিয়েছেন, ‘আল্লাহতায়ালা এই সব কিছুর মাধ্যমে নবী পরিবার (তথা) তোমাদের মাঝ থেকে (সব ধরনের) অপবিত্রতা দূর করে দিবেন এবং তিনি (তোমাদের) ভালো করে পাক সাফ করে দিতে চান’। পর্দার বিধান ইসলামী শরীয়াহ’র পক্ষ থেকে সমাজব্যবস্থা এবং বিশেষতঃ উম্মতের নারীদের জন্য অনেক বড় ইহসান। ইসলামী শরিয়তের পূর্ণাঙ্গতা ও সর্বকালের অমোঘ বিধান হওয়ার এক দূর্ভেদ্য দলিল পর্দার বিধান। মানবিক সমাজকে পবিত্র এবং কুসংস্কারমুক্ত রাখতে পর্দার বিধানের কোন বিকল্প নেই। তরুণ প্রজন্মকে ভয়ানক ফেতনা থেকে ও নারী জাতির নিরাপদ ও নিরাপত্তার জন্য পর্দার বিধানের পরিপূর্ণ অনুসরণ এখন যুগের দাবি। পর্দা মূলত একটি ফার্সি শব্দ। এটির আরবি প্রতিশব্দ হিজাব অর্থাৎ বাংলা অর্থ দাঁড়ায়– আবৃত করা, ঢেকে রাখা, আবরণ, আচ্ছাদন, বস্ত্রাদি দ্বারা সৌন্দর্য ঢেকে নেওয়া, গোপন করা ইত্যাদি। ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায়, নারী– পুরুষ উভয়ের চারিত্রিক পবিত্রতা অর্জনের নিমিত্তে উভয়ের মাঝে শরিয়ত কর্তৃক নির্ধারিত যে আবরণ রয়েছে তাকে পর্দা বলা হয়। অপরদিকে নারীদের বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীন সৌন্দর্য পরপুরুষের দৃষ্টি থেকে আড়ালে রাখার যে বিশেষ ব্যবস্থা ইসলাম প্রণয়ন করেছে, তাকে পর্দা বলা হয়। আগেই বলা হয়েছে নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাতের মতই এটি ইসলামের সু–স্পষ্ট একটি ফরজ বিধান। মহান রাব্বুল আ’লামিন এই বিধানকে প্রবর্তন করেছেন সমগ্র মানবজাতির কল্যাণের জন্য। সূরা আহযাবের ৫৩ নং আয়াতে আল্লাহতায়ালার স্পষ্ট ঘোষণা, ‘যখন তোমরা তাদের নিকট কিছু চাইবে, তখন পর্দার আড়াল থেকে চাইবে, এটি তোমাদের ও তাদের অন্তরকে পাক সাফ রাখার জন্য অধিকতর উপযোগী’। এই বিধানকে নিজের উপর পরিপূর্ণভাবে সমর্পিত রাখা ঈমানের দাবি। এই বিধানকে হালকা মনে করা কিংবা অমান্য করা কিংবা এই বিধানের বিরোধীতা করা– এসবের অধিকার কারো নেই। এই প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা ও তাঁর রাসূল (সাঃ) কোন ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন, তখন কোন মুমিন পুরুষ ও কোন মুমিন নারীর তাদের সেই ব্যাপারে কোন রকমের এখতিয়ার থাকবে না (যে, তারা তাতে কোন রদবদল করবে)’। পর্দার গুরুত্ব সম্পর্কে মহান আল্লাহতায়ালার ঘোষণা, ‘হে নবী তুমি তোমার স্ত্রী, মেয়ে ও সাধারণ মুমিন নারীদের বল, তারা যেন তাদের নিজেদের উপর তাদের চাদরের কিয়দংশ টেনে দেয়, এতে করে তাদের পরিচয় চেনা সহজ হবে এবং তাদের কোন রকম উত্যক্ত করা হবে না, আল্লাহতায়ালা ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু’। এই আয়াতে পর্দার সঙ্গে চলাফেরা করার গুরুত্ব উল্লেখ করা হয়েছে যে, পর্দার সহিত চলাফেরা করলে সবাই বুঝতে পারবে তারা শরীফ ও চরিত্রবতী নারী। ফলে পর্দানশীল নারীদেরকে কেউ উত্যক্ত করার সাহস করবে না। সূরা আন নূর এর ৩১ নং আয়াতে মুমিন নারীদেরকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তুমি মুমিন নারীদেরকে বল, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নিম্নগামী করে রাখে এবং নিজেদের লজ্জাস্থানসমূহের হেফাজত করে, তারা যেন তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে বেড়ায়’। পর্দাহীনভাবে যারা চলাফেরা করে অর্থাৎ যারা পর্দার বিধানকে থোড়াই কেয়ার করে, বর্তমান সমাজে তারাই ইভটিজিং ও ধর্ষণসহ বিভিন্ন অসামাজিক হুমকির সম্মুখীন হয় এবং রাস্তাঘাটে চরমভাবে নির্যাতিত ও বেইজ্জত হয়। সেজন্যে নারীর সতীত্ব রক্ষার্থে বর্তমান সমাজে পর্দার গুরুত্ব অপরিসীম। হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল (সাঃ) বলেন– নারী পর্দাবৃত থাকার বস্তু। যখন যে পর্দাহীন হয়ে বের হয় তখন শয়তান তার দিকে চোখ তুলে তাকায় (তিরমিজি–১১৭৩)। অন্য এক হাদীসে হযরত আলী (রাঃ) বর্ণনা করেন, একদা তিনি রাসূল (সাঃ) এর নিকটে ছিলেন, তখন নবী করিম (সাঃ) সাহাবীদের উদ্দেশ্যে বললেন– ‘মহিলাদের জন্য সর্বোত্তম বিষয় কোনটি? তারা চুপ হয়ে গেলেন। অতপর আমি ফিরে এসে হযরত ফাতেমা (রাঃ)কে জিজ্ঞেস করলাম, মহিলাদের জন্য সর্বোত্তম বিষয় কোনটি? তিনি বললেন, কোন পরপুরুষ তাকে দেখবে না (অর্থাৎ নারী পর্দাবৃত থাকবে)। এরপর আমি ঐ বিষয়টি নবী করিম (সাঃ) এর নিকট উল্লেখ করলাম। তিনি বললেন, নিশ্চয়ই ফাতেমা আমার অংশ, সে সত্য বলেছে (মুসনাদুল বাজজার – ৫২৬)’। এতে করে পর্দার গুরুত্ব বিকশিত হয়। এছাড়া পর্দা পালনের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি মহান আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয় ও সম্মানিত হতে পারে। হাদিস শরিফে বলা হয়েছে, আল্লাহতায়ালা পর্দানশীনদের ভালবাসেন। সূরা হুজরাতের ১৩ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহর কাছে তোমাদের মাঝে সর্বাধিক মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি হচ্ছে সে, যে আল্লাহতায়ালাকে বেশি ভয় করে’। প্রকৃত অর্থে তাকওয়াসম্পন্ন বা মুত্তাকী হল ঐ ব্যক্তি যে আল্লাহর নির্দেশসমূহ মেনে চলে আর পর্দা হচ্ছে আল্লাহতায়ালার সু–স্পষ্ট নির্দেশ। যেহেতু এই পর্দা আল্লাহর পক্ষ থেকে মানবজাতির জন্য অত্যাবশ্যকীয় নির্দেশ, সেহেতু পর্দা পালনের মাধ্যমে ব্যক্তি আল্লাহর নিকট অধিক সম্মানিত ও মর্যাদাসম্পন্ন হতে পারে। গভীরভাবে চিন্তা করলে আমরা বুঝতে পারি, পর্দার বিধান অনুসরণের মাধ্যমে নারী ও পুরুষের নৈতিক চরিত্রের পরিপূর্ণ হেফাজত হয়। পারিবারিক ব্যবস্থা সুরক্ষিত হয়। এই পর্দা অনুসরণের মাধ্যমে সমাজে পরকীয়াবিহীন পবিত্র জীবন সু–সংগঠিত হয় এবং অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা তাদের মধ্য থেকে চিরতরে বিদায় নেয়। সেজন্যই দুনিয়া ও আখেরাতে পর্দার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। পর্দাহীনতার কারণে সমাজে অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা, অসৎকর্ম ও ব্যভিচারের মতন ভয়ংকর পাপের সৃষ্টি হয়। এরই ফলে ইভটিজিং ধর্ষণ, খুন খারাবি ইত্যাদি সমস্যাসমূহ প্রকট আকার ধারণ করে, সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়, জনজীবন বিপর্যস্ত হয়, পারিবারিক জীবন ধসে পড়ে। পর্দার বিধান সমাজে চালু না থাকার কারণে পরকীয়া ও চরিত্রহীনতার চরম পরাকাষ্টা সমাজে পরিলক্ষিত হয়, স্বামী–স্ত্রীর মধ্যে অবিশ্বাসের মাত্রা চরমভাবে পেয়ে বসে, পারিবারিক অশান্তি ও বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। তাদের ব্যাপারে নবী করিম (সাঃ) বলেন, ‘তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট তারাই যারা পর্দাহীনভাবে চলাফেরা করে’ (বায়হাকি–১৩২৫৬)।
লেখক: সভাপতি–রাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি),
রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতাল