নগরীর হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজের পেছনে ঘন ঝোপঝাড়ের আড়ালে এক ‘রহস্যময়’ ভবন। অনেকেই একে বলেন ‘ভূতুড়ে বাড়ি’। কিন্তু ইতিহাস বলছে, এটি শুধুই কোনো পরিত্যক্ত ভবন নয়। এক সময়কার ‘দারুল আদালত’–চট্টগ্রামের প্রথম আদালত ভবন। আর স্থানীয়ভাবে পরিচিত ‘পর্তুগিজ ভবন’ নামে।
ভবনটি এখন ধ্বংসপ্রায়। ভিতরে ছড়িয়ে রয়েছে বিষধর সাপের গর্ত। চারপাশে ঝোপঝাড়। অথচ এই স্থান একসময় ছিল জনসমাগমে মুখর। ইতিহাসবিদদের মতে, ভবনটির বয়স প্রায় ৪০০ বছর। নির্মাণ করেছে পর্তুগিজরা, যারা চট্টগ্রামে বাণিজ্যের পাশাপাশি জলদস্যু কার্যক্রমেও জড়িত ছিল।
১৬শ শতকের শেষভাগ থেকে ১৭শ শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত পর্তুগিজরা চট্টগ্রাম অঞ্চলে সক্রিয়ভাবে বাণিজ্য পরিচালনা করত। তারা নির্মাণ করে নানা স্থাপনা–যার মধ্যে অন্যতম ছিল এই ভবনটি। কেউ বলেন ১৬৬৬ সালে, কেউ বা মত দেন ১৭৬১ সালে ভবনটি নির্মিত হয়। ভবনের নির্মাণকাল নিয়ে মতভেদ থাকলেও একটি বিষয়ে সবাই একমত: এটি ছিল শাসন, বিচার এবং আমোদ–প্রমোদের কেন্দ্র। বলা হয়ে থাকে, এই ভবনের নিচ দিয়ে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত একটি সুড়ঙ্গপথ ছিল। এই সুড়ঙ্গ দিয়েই লুট করা মালপত্র আনা হতো এবং শহর ছাড়ার সময় পর্তুগিজরা এই পথ ব্যবহার করত। সুড়ঙ্গপথটি আজ আর দৃশ্যমান নেই। তবে কথিত আছে শহর থেকে পলায়নের সময় তারা সুড়ঙ্গটি সিলগালা করে দেয়। এমনকি ভবনের নিচে গোপন কক্ষ ছিল, যেখানে মালপত্র ও অস্ত্র সংরক্ষিত থাকত। এই জায়গাতেই ছিল পর্তুগিজদের প্রমোদশালা, যেখানে প্রতি রাতে চলত নাচ, গান ও আমোদ–প্রমোদের আয়োজন। এই ভবনের প্রতিটি ইটে যেন লুকিয়ে আছে শতাব্দীর পুরনো ইতিহাস। ভবনটিতে রয়েছে মোট ২০টি কক্ষ। দোতলা ভবনটির প্রতিটিতেই রয়েছে একটি কেন্দ্রীয় কক্ষ, যার চারপাশে সাজানো অন্যান্য কক্ষগুলো। ভবনের তিনটি সিঁড়ির মধ্যে একটি ছিল পেঁচানো সিঁড়ি, যা মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় স্থাপত্যরীতির পরিচায়ক। দেয়ালগুলো মাত্র ১০ ইঞ্চি প্রস্থ, নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছে শুধুমাত্র ইট। কোথাও সিমেন্ট বা আধুনিক নির্মাণ উপকরণের ছোঁয়া নেই। ভবনের ছাদে রয়েছে দুটি ছোট গম্বুজ, যা থেকে এক সময় পাহারাদাররা গোটা চট্টগ্রাম শহর নজরে রাখতে পারত। ২০০৯ সালে মহসিন কলেজ কর্তৃপক্ষ ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের উদ্যোগে চালানো সমীক্ষায় বলা হয়, এই ভবনের নির্মাণশৈলী মোগল, ব্রিটিশ কিংবা আধুনিক কোনো আমলের সঙ্গেই মেলে না। সেই ভিত্তিতে এটিকে পর্তুগিজদের তৈরি স্থাপনা বলে চিহ্নিত করা হয়। ইতিহাসবিদদের মতে, পর্তুগিজদের চিহ্ন এই ভবনের গাঁথুনিতে স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। এটি ছিল তাদের একটি প্রশাসনিক দুর্গ এবং সামাজিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। ভবনটির পরবর্তী ইতিহাসও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। ১৮৩৫ সালে দানবীর হাজী মুহাম্মদ মহসিনের ওয়াকফ সম্পত্তি থেকে গঠিত হয় ‘মহসিন ফান্ড’। সেই ফান্ড থেকে ১৮৭৪ সালের ২০ জুলাই চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠা করা হয় প্রথম মাদ্রাসা–মোহসিনিয়া মাদ্রাসা।
১৮৭৯ সালে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ ৩০ হাজার টাকায় ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে ভবনসহ পুরো পাহাড়টি কিনে নেয়। পরবর্তীতে ১৯২৭ সালে মহসিন কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলে পর্তুগিজ ভবনটি কিছু সময়ের জন্য ছাত্রাবাস হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
২০০২ সালে কলেজ কর্তৃপক্ষ ভবনটিকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে এবং একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেওয়া হয়। বর্তমানে ভবনে প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এই ভবন শুধু একটি স্থাপত্য নয়, এটি একটি সময়ের প্রতিচ্ছবি। এটি চট্টগ্রামের উপনিবেশিক ইতিহাস, শিক্ষা আন্দোলন এবং ধর্মীয় সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ স্মারক। অথচ এই ভবনটির সংরক্ষণের জন্য নেই তেমন কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ। নেই কোনো পর্যটন পরিকল্পনা কিংবা গবেষণার আয়োজন।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভবনটিকে সংরক্ষণ করে তা ইতিহাস শিক্ষার কেন্দ্র, হেরিটেজ মিউজিয়াম বা পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। এতে যেমন তরুণ প্রজন্ম ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারবে, তেমনি স্থানীয় পর্যটন শিল্পেও যুক্ত হবে নতুন মাত্রা। চট্টগ্রামের মতো একটি বন্দরনগরীতে, যেখানে পর্যটন আর ইতিহাস পাশাপাশি গড়ে উঠতে পারে, সেখানে এমন একটি ঐতিহাসিক স্থাপনার এই অবহেলা দুঃখজনক। এটি শুধু একটি পরিত্যক্ত ভবন নয়, এটি একটি সময়ের দলিল, একটি জাতির অতীত যাত্রার অংশ। সময় এসেছে ভবনটির সংরক্ষণ ও গবেষণার উদ্যোগ গ্রহণের। না হলে ইতিহাসের এই জীবন্ত সাক্ষ্য অচিরেই হারিয়ে যাবে। এই ভবন যদি কোনো পশ্চিমা দেশে হতো, তবে তাতে রক্ষাকবচ দেওয়া হতো, সংরক্ষণে মোটা অংকের তহবিল বরাদ্দ হতো। অথচ আমরা তা করতে পারিনি। একজন তরুণ ইতিহাসবিদের মন্তব্য ছিল, এই ভবনটি একটি জীবন্ত দলিল। আমরা যদি এখনই এর সংরক্ষণের উদ্যোগ না নিই, তাহলে একদিন শুধু ছবির অ্যালবামেই থাকবে আমাদের ইতিহাস।
‘পর্তুগিজ ভবন’ যেন একটি হারিয়ে যেতে বসা অধ্যায়। চট্টগ্রামের বুকে দাঁড়িয়ে থাকা এই ভবন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়–ইতিহাস যত পুরনোই হোক, তা কখনো অপ্রাসঙ্গিক নয়। বরং যত্ন না করলে সেই ইতিহাস আমাদের হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। এখন সময়, ভবনটিকে নতুন করে আবিষ্কার করার। প্রয়োজন সরকারি উদ্যোগ, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ও স্থানীয় প্রশাসনের সম্মিলিত প্রয়াস। তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ইতিহাসের এই অমূল্য সম্পদকে শুধু বইয়ের পাতায় নয়, চোখের সামনেও দেখতে পাবে। মহসিন কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ প্রফেসর কামরুল ইসলাম জানান, ২০০২ সালে ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়। তখন থেকেই সকল একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়। ভবনে প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কথা হয় সাবেক এক শিক্ষার্থীর সঙ্গেও। তিনি বলেন, ৯০’র দশকে আমরা এই ভবনের পাশ দিয়ে যেতাম, একটা রোমাঞ্চ থাকত। ভিতরে ঢুকার সাহস হতো না, কিন্তু ভাবতাম ভবনের দেয়ালের ভেতর কত শত ইতিহাস চাপা পড়ে আছে।