বাংলাদেশ ছয় ঋতুর দেশ। সুজলা–সুফলা অপরূপ এ দেশের প্রকৃতি ছিল সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি। গাছে গাছে ছিল বিচিত্র ধরনের পাখি। পাখির কূজনে মুখরিত ছিল বাংলার গ্রাম্য প্রকৃতি। অরণ্য ছিল জীববৈচিত্র্যে ভরপুর। নদীমাতৃক এ দেশে জালের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল খাল–বিল, নদী–নালা আর অবিরাম বহমান ছিল বন–পাহাড়ের ঝর্নাধারা। নানা প্রজাতির মাছে ভরপুর ছিল দেশের নদী, খাল–বিল। বন্যপ্রাণী–বৃক্ষরাজিতে ভরপুর ছিল এদেশ।
মানুষের সঙ্গে এই প্রকৃতির সম্পর্ক অতি নিবিড়। কারণ প্রকৃতির কোলেই মানুষের বসবাস। তাই প্রকৃতির ক্ষতি হলে মানুষেরও ক্ষতি হয়। আমরা আজ নানাভাবেই প্রকৃতির ক্ষতি করে চলেছি। আজ প্রাকৃতিক পরিবেশ ভয়াবহ দূষণের শিকার। এতে চরম বৈরী হয়ে উঠছে আবহাওয়া। পরিণামে বাড়ছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়, বাড়ছে বৈশ্বিক উষ্ণতা। উষ্ণতার কারণে বরফ গলে যাচ্ছে হিমালয় এবং মেরু অঞ্চলের। এতে বাড়ছে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা। পরিণামে তলিয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর বিশাল নিন্মাঞ্চল। চট্টগ্রামের একটি বড় অংশও এর আওতাভুক্ত। পানি, বায়ু, শব্দদূষণ দিন দিন মাত্রা ছেড়ে যাচ্ছে। এতে হানা দিচ্ছে নানা রোগব্যাধি, ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। নষ্ট হচ্ছে খাদ্যশৃঙ্খল। বিনাশ হচ্ছে সভ্যতা। এ অবস্থা চলতে থাকলে মানব–অস্তিত্ব্ব বিপন্ন হয়ে পড়বে।
পরিবেশ আজ বড়ই বিপন্ন। পরিবেশ বিপন্ন হওয়ার ফলে দেখা দিচ্ছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়। মানবজীবনও হুমকিতে পড়েছে। পরিণামে জ্যামিতিক হারেই বাড়ছে পরিবেশ শরণার্থীর সংখ্যা।
পরিবেশ বিজ্ঞানী, পরিবেশবিদ এবং পরিবেশ দূষণের শিকার সচেতন জনগণের মতে, বৃক্ষ নিধন ছাড়াও প্রাণী বৈচিত্র্য রক্ষা না করা, রাসায়নিক সার ব্যবহার করা, কল–কারখানার বর্জ্য, পলিথিন ও পোড়া জ্বালানী, কালো ধোয়া, কীটপতঙ্গ ধ্বংস করা, বস্তির উদ্ভব, ঘনবসতি, ধূমপান, পানিতে মলমূত্র ও মৃত প্রাণীদেহ ফেলা, আর্সেনিক ও অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়ন, গাড়ীর হর্ণ ও মিলকারখানার শব্দ এবং অসচেতনতা ও শিক্ষার অভাব সর্বোপরি আইন অমান্য করা ও দেশপ্রেমের অভাবই পরিবেশ দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ হিসাবে কাজ করছে।
তাই সময় থাকতেই পরিবেশ সুরক্ষায় সম্মিলিত প্রচষ্টা গ্রহণ করতে হবে। পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধে জনসচেতনতা বাড়ানো গেলে, আইনের যথাযথ প্রয়োগ হলে এবং সকলেই যার যার অবস্থান থেকে পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধে কাজ করলে একটি বাসযোগ্য পৃথিবী গড়া সম্ভব।
আমাদের বেঁচে থাকার স্বার্থে বন্ধ করতে হবে পরিবেশ দূষণ। পরিবার থেকেই পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন শুরু করতে হবে। এর পর সমাজ ও রাষ্ট্রে এ আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে হবে। পরিবেশ রক্ষায় সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভূমিকা পালন করতে হবে।
বৃক্ষ নিধন, জলাভূমি ভরাট, পাহাড় কাটা, নদী দূষণ ও কৃষি জমিতে রাসায়নিকের যথেচ্ছ ব্যবহার বন্ধসহ পরিবেশ সুরক্ষায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি জোরদার করার মাধ্যমে দেশের সবুজ উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে, পরিবেশগত সুরক্ষা এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষায় গুরুত্ব দিতে হবে। প্রতিটি প্রকল্পের ক্ষেত্রে পরিবেশগত প্রভাব ভালভাবে নিরূপণ করে দূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
নিরাপদ বাসযোগ্য পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা জরুরি। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ও দূষণ রোধে প্রয়োজন সম্মিলিত প্রচেষ্টা।
পরিবেশ বিপর্যয়ের উল্লিখিত ক্ষতিকর দিকগুলো চিহ্নিত করে সেই সাথে ব্যাপক গণসচেতনতা বাড়াতে হবে। এ জন্যে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচতে হলে আমাদের এখনি যথাযথ পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। পরিবেশ উন্নয়ন ও দূষণ রোধে গণসচেতনতা আরো বৃদ্ধি করতে হবে। আর এই কাজে প্রশাসন ও গণমাধ্যম খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। আমাদের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন দূষণমুক্ত নিরাপদ পরিবেশ। পরিবেশ দূষণ ও দূষণরোধে নিজেদের সচেতনতা ও দায়িত্ববোধ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কোন একক ব্যক্তি বা সংগঠনের পক্ষে অনেক সমস্যা সমাধান করা সম্ভব নয়। এ জন্য প্রয়োজন ধারাবাহিক সম্মিলিত প্রচেষ্টা। এ ক্ষেত্রে প্রশাসন ও গণমাধ্যমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকা প্রয়োজন। পরিবেশের ক্ষতিকর বিষয় সম্পর্কে আমরা নিজেরা যখন সচেতন হবো, তখন অন্যদেরকে সচেতন করে তোলার মাধ্যমে আমাদের পরিবেশকে নিরাপদ এবং আগামী প্রজন্মের জন্য সুস্থ–সুন্দর ও বাসযোগ্য করে গড়ে তুলতে পারবো।