উদ্বেগজনকভাবে পরিবেশ দূষণের কবলে পড়েছে নগরী। শুধু চট্টগ্রাম নগর নয়, দেশের প্রায় সব বড় বড় শহরগুলোর অবস্থাও প্রায় একই রকম। করোনা মহামারির সময়ে সাধারণ মানুষ এবং যানবাহনের চলাচল কমে যাওয়ার কারণে বিভিন্ন ধরনের যানবাহন থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া এবং ধূলি ধূসরিত রাস্তাগুলো থেকে উৎসারিত ধূলি কমে গিয়েছিল। ফলে সামগ্রিকভাবে পরিবেশ ও শব্দদূষণ যথেষ্ট কমে গিয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আবারও মানুষের জীবনযাত্রা এবং যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক পর্যায়ে চলে আসার কারণে নতুন করে উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে গেছে পরিবেশ, বায়ু এবং শব্দদূষণ।
‘কালো ধোঁয়ায় ভরদুপুরে অন্ধকার, বাড়ছে শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগ, স্বাস্থ্যঝুঁকি’ শীর্ষক সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে গত ২৫ জুলাই দৈনিক আজাদীতে। এতে বলা হয়েছে, ভয়াবহ রকমের পরিবেশ বিপর্যয় ঘটছে নাসিরাবাদ শিল্প এলাকায়। নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী থানাধীন নাসিরাবাদ শিল্প এলাকায় কলকারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়ায় ভরদুপুরে রাতের মতো অন্ধকার হয়ে যায় পুরো এলাকা। এলাকার হাজার হাজার মানুষের জীবনযাত্রা এক অবর্ণনীয় দুর্ভোগে পড়েছে। সূত্র জানিয়েছে, এক সময় নাসিরাবাদ শিল্প এলাকা শহর থেকে কিছুটা দূরে ছিল। ওই সময় এলাকাটিতে বিভিন্ন ধরনের শিল্প কারখানা গড়ে উঠে। এছাড়া টেক্সটাইল, ওয়াশিং কারখানা, বিভিন্ন কেমিক্যালসহ বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনকারী কারখানা রয়েছে। একাধিক রিুরোলিং এবং স্টিল মিলসহ বিভিন্ন ধরনের ক্যামিকেল কারখানাগুলো থেকে রাতে দিনে ভয়াবহ আকারে কালো ধোঁয়া বের হওয়ার ঘটনা ঘটছে। পুরনো প্রযুক্তির এসব কারখানায় ধোঁয়া ফিল্টারিং এর কোনো ব্যবস্থা নেই। এতে করে স্টিলমিলে স্ক্র্যাপ গলানোর সময় ধোঁয়ার সঙ্গে কার্বন, আয়রন, অ্যালুমিনিয়ামসহ বিভিন্ন পার্টিকেল নিঃসরণ হয়। কালো ধোঁয়ার সাথে এসব মানুষের নাক, মুখ দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করছে। দেশে ধোঁয়া ফিল্টারিং করার প্রযুক্তি রয়েছে। ধোঁয়া থেকে বিভিন্ন মেটাল কণাসমূহ বের করে আলাদা করে চীনসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানিরও সুযোগ রয়েছে। কিন্তু ফিল্টারিং খরচ বাঁচাতে নাসিরাবাদ শিল্প এলাকার অধিকাংশ কারখানা এসব ধোঁয়া আকাশে ছেড়ে দিচ্ছে। আকাশে ছেড়ে দেয়ার ক্ষেত্রেও কোনো নিয়ম নীতি মানা হচ্ছে না। যার যেভাবে খুশি সেভাবে ধোঁয়া নির্গমনের ফলে পুরো এলাকাটি অন্ধকার হয়ে থাকে। যা এলাকার হাজার হাজার মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ৩৩ লাখ মানুষ মারা যায় বায়ু দূষণের কারণে। এর মধ্যে ৭৫ শতাংশ মৃত্যুই ঘটে হার্ট অ্যাটাক থেকে আর বাকি ২৫ শতাংশ ফুসফুস রোগে মারা যায়। বায়ু দূষণের মাত্রা এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি। দূষণের শীর্ষে আছে ভারতের দিল্লি। ঠিক তার পরের অবস্থানেই রয়েছে বাংলাদেশ। হেলথ ইফেক্টস ইন্সটিটিউটের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে বছরে ১ লাখ ২২ হাজার ৪০০ মানুষ মারা যায় শুধু বায়ু দূষণের কারণে। সর্বত্র গাড়ির ধোঁয়া, না হয় কলকারখানার ধোঁয়া। তবে এসবের চেয়েও বেশি দূষণ করছে নগরের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা ইটভাটাগুলো। ফলে যেদিক থেকেই বায়ু প্রবাহিত হোক, দূষিত বায়ু প্রবেশ করছে শহরে। এ যেন দূষণের মেলা চলছে বাতাসে!
পরিবেশবিদরা বলেন, সামগ্রিক কল্যাণ নিশ্চিত করতে হলে উন্নয়ন ও পরিবেশ সুরক্ষায় ভারসাম্য রক্ষা করেই আমাদের চলতে হবে। পরিবেশকে এড়ানোর সুযোগ নেই। আর্থসামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে পরিবেশ ও প্রতিবেশগত উদ্বেগ বিশ্বব্যাপী অন্যতম জটিল ফ্যাক্টর হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সঙ্গত কারণে পরিবেশ–উন্নয়ন সম্পর্কটি তাই প্রায় সব আন্তর্জাতিক ফোরামে আলোচিত হচ্ছে। এমনকি জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যেও পরিবেশ সংরক্ষণকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ওই বৈশ্বিক লক্ষ্য পূরণে বাংলাদেশও অঙ্গীকারাবদ্ধ। আশার কথা, পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধে সকলেই সোচ্চার হয়ে উঠছেন। তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন আইন। তবে শুধু আইন প্রণয়ন করলেই পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে না। সেজন্যে জনসাধারণকে পরিবেশ দূষণ বিষয়ে যে সচেতন হতে হবে, সেটি বলাই বাহুল্য।
নাসিরাবাদ নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী থানাধীন একটি শিল্প এলাকা। ফলে এখানে কলকারখানা থাকবেই। ধোঁয়াও নির্গত হবে। কিন্তু তার পরিমাণ কতটুকু! এলাকায় ধোঁয়ার পরিমাণ এতো বেশি যে মানুষের জীবনযাত্রায় সৃষ্টি করছে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। এর থেকে রেহাই পেতে হবে। পরিবেশ অধিদপ্তরকে চালাতে হবে অভিযান। সীমাহীন ধোঁয়া ছাড়ছে যেসব কারখানা, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।