আজ ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস। প্রতিবছর এই দিনে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও এই দিবসটিকে পালন করা হয়। মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক অতি নিবিড়। কারণ প্রকৃতির কোলেই মানুষের বসবাস। তাই প্রকৃতির ক্ষতি হলে মানুষেরও ক্ষতি হয়। আমরা আজ নানাভাবেই প্রকৃতির ক্ষতি করে চলেছি। আজ প্রাকৃতিক পরিবেশ ভয়াবহ দূষণের শিকার। এতে চরম বৈরী হয়ে উঠছে আবহাওয়া। পরিণামে বাড়ছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়, বাড়ছে বৈশ্বিক উষ্ণতা। উষ্ণতার কারণে বরফ গলে যাচ্ছে হিমালয় এবং মেরু অঞ্চলের। এতে বাড়ছে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা। পরিণামে তলিয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর বিশাল নিন্মাঞ্চল। চট্টগ্রামের একটি বড় অংশও এর আওতাভুক্ত। পানি, বায়ু, শব্দদূষণ দিন দিন মাত্রা ছেড়ে যাচ্ছে। এতে হানা দিচ্ছে নানা রোগব্যাধি, ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। নষ্ট হচ্ছে খাদ্যশৃঙ্খল। বিনাশ হচ্ছে সভ্যতা। এ অবস্থা চলতে থাকলে মানব–অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়বে।
পরিবেশ বিজ্ঞানী, পরিবেশবিদ এবং পরিবেশ দূষণের শিকার সচেতন জনগণের মতে, বৃক্ষ নিধন ছাড়াও প্রাণী বৈচিত্র্য রক্ষা না করা, রাসায়নিক সার ব্যবহার করা, কল–কারখানার বর্জ্য, পলিথিন ও পোড়া জ্বালানি, কালো ধোয়া, কীটপতঙ্গ ধ্বংস করা, বস্তির উদ্ভব, ঘনবসতি, ধূমপান, পানিতে মলমূত্র ও মৃত প্রাণীদেহ ফেলা, আর্সেনিক ও অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়ন, গাড়ির হর্ণ ও মিলকারখানার শব্দ এবং অসচেতনতা ও শিক্ষার অভাব সর্বোপরি আইন অমান্য করা ও দেশপ্রেমের অভাবই পরিবেশ দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ হিসাবে কাজ করছে। তাই সময় থাকতেই পরিবেশ সুরক্ষায় সম্মিলিত প্রচষ্টা গ্রহণ করতে হবে। পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধে জনসচেতনতা বাড়ানো গেলে, আইনের যথাযথ প্রয়োগ হলে এবং সকলেই যার যার অবস্থান থেকে পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধে কাজ করলে একটি বাসযোগ্য পৃথিবী গড়া সম্ভব।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, পরিবেশ সুরক্ষার জন্য একটি দেশের আয়তনের শতকরা ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা অপরিহার্য। কিন্তু বাংলাদেশে বর্তমানে বনভূমির পরিমাণ মোট ভূমির ১৪.১% উন্নীত হয়েছে (মাঠ জরিপ ২০১৮ সাল)। ২০১৪ সালে বাংলাদেশে বনভূমির পরিমাণ ছিল ১২.৮% (জাতিসংঘ প্রতিবেদন) । বাংলাদেশে ২০৩০ সালের মধ্যে বনভূমির পরিমাণ ১৬% করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার। বাংলাদেশের ৬৪% বনের আশপাশের জনগোষ্ঠী বনজ সম্পদের ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশে বনজ সম্পদ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ব্যবহার করে ১০ কোটি ৮০ লাখ মানুষ। দেশে বনজ সম্পদ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে (২০১৭–১৮ অর্থবছরে) ৮৫৪ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের সম্পদ।
আমাদের বেঁচে থাকার স্বার্থে বন্ধ করতে হবে পরিবেশ দূষণ। পরিবার থেকেই পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন শুরু করতে হবে। এর পর সমাজ ও রাষ্ট্রে এ আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে হবে। পরিবেশ রক্ষায় সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভূমিকা পালন করতে হবে।
বৃক্ষ নিধন, জলাভূমি ভরাট, পাহাড় কাটা, নদী দূষণ ও কৃষি জমিতে রাসায়নিকের যথেচ্ছ ব্যবহার বন্ধসহ পরিবেশ সুরক্ষায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি জোরদার করার মাধ্যমে দেশের সবুজ উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে, পরিবেশগত সুরক্ষা এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষায় গুরুত্ব দিতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘পানিদূষণ পরিবেশদূষণের পেছনে একটি অন্যতম প্রধান কারণ। বাংলাদেশে নানাভাবে পানিদূষণ হয়ে থাকে। তন্মধ্যে শিল্পকারখানা মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। কলকারখানার বর্জ্য পানিতে প্রত্যক্ষভাবে ফেলা পানিদূষণের পেছনে মারাত্মকভাবে দায়ী। কারখানার রাসায়নিক পদার্থ, ভারী ধাতু, তেল ও রঞ্জক পানিতে মিশে পানি দূষিত করে থাকে। এছাড়াও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার অভাব, অপরিকল্পিত ও অপরিচ্ছন্ন শহরাঞ্চল, কঠিন বর্জ্য পানিতে ফেলা, যানবাহনের তেল ও রাসায়নিক পানিতে মিশে যাওয়া, তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের ফলে পানিদূষণ, আর্সেনিক দূষণ, জলাভূমি ভরাট, পানি ব্যবহারের অসচেতনতা, নদীতে চলমান যানের ময়লা–আবর্জনা পানিতে ফেলা, নদীর পাশে তৈরি হওয়া বাজারের সব বর্জ্য নদীতে ফেলাসহ ইত্যাদি কারণে মারাত্মকভাবে পানিদূষণ হয়ে থাকে। এছাড়াও পানিদূষণের কারণে জীববৈচিত্র্য হ্রাস, জলজ প্রাণীর বিলুপ্তি, কৃষি উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা, পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হওয়াসহ আরো নানা ক্ষতি হয়।’
তাই দেশের প্রতিটি প্রকল্পের ক্ষেত্রে পরিবেশগত প্রভাব ভালভাবে নিরূপণ করে দূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। নিরাপদ বাসযোগ্য পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা জরুরি। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ও দূষণ রোধে প্রয়োজন সম্মিলিত প্রচেষ্টা।