পরিবেশ অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসনকে তৎপর হতে হবে

| সোমবার , ২৬ মে, ২০২৫ at ৮:০৯ পূর্বাহ্ণ

বর্ষা এলেই পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের সরানোর তোড়জোড় চলে। বাড়ে আতংক। ২৪ মে দৈনিক আজাদীতে এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বর্ষা এলে চট্টগ্রামে স্থানীয় বসবাসকারী এবং নানান শ্রেণীপেশার মানুষের পাহাড় ধস নিয়ে উদ্বেগউৎকণ্ঠা বাড়ে। প্রতি বছর নগরীতে পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের উচ্ছেদ কার্যক্রম চলমান থাকলেও কিন্তু বসবাস বন্ধ হয় না। পাহাড়ে বসবাস করা বেশিরভাগ মানুষই নিম্ন আয়ের। সেখানে বসবাসের জন্য নির্বিচারে পাহাড় কাটা হচ্ছে। ফলে বৃষ্টি হলেই মাটি ধসে দুর্ঘটনা ঘটছে। এরপর কিছু সময়ের জন্য প্রশাসনের তৎপরতা চোখে পড়ে। সময় যত গড়ায় তৎপরতাও থেমে যায়।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের হালনাগাদ তালিকা অনুসারে নগরীতে সরকারিবেসরকারি ২৬টি পাহাড়ে এখন অবৈধ স্থাপনার সংখ্যা ৬ হাজার ৫৫৮টি। এর মধ্যে সরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও বিভাগের মালিকানাধীন ১৬টি পাহাড়ে বসবাস করছে ছয় হাজার ১৭৫টি পরিবার। আর ব্যক্তি মালিকানাধীন ১০টি পাহাড়ে বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা ৩৮৩টি। নগরীর বায়েজিদ লিংক রোড ও সলিমপুর, আকবর শাহ, অক্সিজেন, রৌফাবাদ, লালখান বাজার মতিঝর্ণা, ফয়’স লেক এলাকায় অবৈধ বসতি রয়েছে। চট্টগ্রাম নগরীতে সবচেয়ে বেশি অবৈধ পরিবারের বসবাস ফয়’স লেক এলাকার ১, ২ ও ৩ নম্বর ঝিল পাহাড়ে। এখানে মোট চার হাজার ৪৭৬টি পরিবার থাকে। ওই পাহাড়ের মালিকও বাংলাদেশ রেলওয়ে। এটিসহ বাংলাদেশ রেলওয়ের মালিকানাধীন সাতটি পাহাড়ে অবৈধ বসতি আছে। এর মধ্যে মতিঝর্না ও বাটালি হিল এলাকায় বসবাস ৪৩১টি পরিবারের। লেকসিটি আবাসিক এলাকাসংলগ্ন বিজয়নগর পাহাড়ে বসবাস ২৮৮টি পরিবারের।

স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, শুধুমাত্র নগরীর মতিঝর্ণা, টাংকির পাহাড়বাটালি হিলটাইগারপাস হয়ে এসব এলাকায় ২০ থেকে ৩০ হাজারের বেশি লোক বসবাস করে।

সরেজমিনে মতিঝর্ণা এলাকায় পাহাড়ে গিয়ে দেখা গেছে, অনেকগুলো ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় ঘেঁষে বিল্ডিং গড়ে উঠেছে। আবার অনেকগুলো পাহাড়ের উঁচুঢালু জায়গায় চরম ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় ৪৫ তলা বিল্ডিং পর্যন্ত উঠে গেছে। একেকটি বিল্ডিংয়ে চরম ঝুঁকি নিয়ে ১০ থেকে ১৫ পরিবার বসবাস করছে। অনেকগুলো বিল্ডিংয়ের উপরে টিনের ছাউনি দিয়েও বাসা তৈরি করে ভাড়াও দেয়া হয়েছে। পরিবেশ আন্দোলন কর্মীরা বলছেন, স্থানীয় রাজনৈতিক দলের নেতাদের ছত্রছায়ায় বছরের পর বছর এসব পাহাড়ে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন এরা। এছাড়াও পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন না করাসহ সমন্বিত উদ্যোগ না থাকায় পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের একেবারে উচ্ছেদ করা যাচ্ছে বলে জানান পরিবেশ আন্দোলনের নেতারা।

প্রথম যেকাজটি করা দরকার, সেটি হলো পাহাড়গুলোকে রক্ষা করতে হবে। দিন দিন পাহাড় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। চট্টগ্রামের পাহাড় কাটা নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিদ্যা ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক এস এম সিরাজুল হক একটি বেসরকারি সংস্থার হয়ে ২০১১ সালে ‘হিল কাটিং ইন অ্যান্ড অ্যারাউন্ড চিটাগং সিটি’ শীর্ষক এক গবেষণা করেন। এতে বলা হয়, বেশির ভাগ পাহাড় কাটা হয় পাহাড়তলী, খুলশী, বায়েজিদ, লালখান বাজার মতিঝরনা, ষোলশহর এবং ফয়’স লেকে। ১৯৭৬ থেকে ৩২ বছরে চট্টগ্রাম নগর ও আশপাশের ৮৮টি পাহাড় সম্পূর্ণ এবং ৯৫টি আংশিক কেটে ফেলা হয় বলে গবেষণায় উল্লেখ করেন। ১৯৭৬ সালে নগরের পাঁচ থানা এলাকায় মোট পাহাড় ছিল ৩২ দশমিক ৩৭ বর্গকিলোমিটার। ২০০৮ সালে তা কমে হয় ১৪ দশমিক ০২ বর্গকিলোমিটার। এ সময়ে ১৮ দশমিক ৩৪৪ বর্গকিলোমিটার পাহাড় কাটা হয়। এটা মোট পাহাড়ের প্রায় ৫৭ শতাংশ। নগরের বায়েজিদ, খুলশী, পাঁচলাইশ, কোতোয়ালি ও পাহাড়তলী থানা এলাকায় এসব পাহাড় কাটা হয়। সবচেয়ে বেশি ৭৪ শতাংশ কাটা পড়ে পাঁচলাইশে।

এদিকে ২০১৫ সালে ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব ন্যাচারাল অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সেসে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপর এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ‘এনভায়রনমেন্টাল ডিগরিডেশান থ্রো হিল কাটিং ইন চিটাগং ডিসট্রিক্ট অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণা কর্মটি হয় ২০০৫ সালে। এর নেতৃত্বে ছিলেন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক এম এ সাত্তার। এই প্রতিবেদনে বলা হয়, চট্টগ্রাম নগরের খুলশীতে সর্বোচ্চ ৬৩ দশমিক ৬ শতাংশ এবং শহরতলির চৌধুরীহাট এলাকায় সর্বনিম্ন ২০ শতাংশ পাহাড় কাটা হয়। ৫ থেকে ২০ বছরের মধ্যে এসব পাহাড় কাটা হয়। নগর ও আশপাশের ২০০ পাহাড়ের মধ্যে প্রায় ১০০টি কেটে বিভিন্ন আবাসিক এলাকা গড়ে উঠেছে বলে গবেষণায় বলা হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, পাহাড়গ্রাসী লোভাতুর দখলদারদের মোকাবিলা করতে হবে শক্ত হাতে। কেননা পাহাড়খেকোদুর্নীতিবাজদের শিকড় গভীর ও শক্তিশালী । এ সমাজে তাঁদের অবস্থান বড় মজবুত। এই জন্যই সচেতন মানুষ, সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসংগঠন যতই উচ্চকণ্ঠ থাকুক না কেন, প্রতিদিন রাতের আঁধারে, প্রকাশ্য দিনের আলোয় নানাভাবে, নানা জায়গায় পাহাড় কাটা চলছেই। এ জন্য প্রশাসন তথা সরকারকে শক্ত হতে হবে। পাহাড় কাটার কারণে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়। পরিবেশ অধিদপ্তর ও চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন একটু তৎপর হলে পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষা করা সম্ভব।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে