পরিবর্তনের ধারায় জাগতিক নিয়ম ও জীবন বহমান। পরিবার, সমাজ, রাস্ট্র এবং বৈশ্বিক পরিবেশে সৃষ্টিশীল অগ্রগতির লক্ষ্যে পরিবর্তন আসবে চিরন্তন রীতিতে। পরিবারের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় শৈশব থেকে আমরা পিতামাতার শাসন স্নেহে বড় হয়েছি, এ ধারাও চিরস্থায়ী কিছু ছিলনা। তারপর আমার সন্তানরা একই নিয়মে আমার স্নেহ, শাসন, সাহচর্যে বেড়ে উঠেছে। সময় হলে একইভাবে আমার সব নিয়ন্ত্রণ কর্তৃত্ব একসময় অপরিহার্য বলে মনে হবেনা? কাজেই পরিবর্তন হওয়া অস্বাভাবিক কিছু না বরং প্রাত্যহিক ঘটে যাওয়া বিষয় সমূহের অংশবিশেষ। সবসময় পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী হলেও সৃজনশীল ধারায় প্রবাহিত থাকলে যেকোনো পরিবর্তন ব্যক্তিজীবন, সামাজিক জীবন ও রাস্ট্রীয় জীবনকে সুন্দর ও স্বাচ্ছন্দ্য ময় করে তুলে। আর এমনসব পরিবর্তন জনজীবনে অর্থবহ হবে শুধুমাত্র জনগণের সুশৃঙ্খল আচরণ, মননশীল অভিব্যক্তি, সহনশীল ধৈর্য ও উদার দৃষ্টিভঙ্গির সুষ্ঠু প্রকাশের মধ্য দিয়ে। সহনশীলতা গুণটি অসন্তোষ, ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে সবার মাঝে ভ্রাতৃত্ব বোধ, পরমতসহিষ্ণুতা ও সমপ্রীতির এক অত্যুজ্জ্বল সুসম্পর্ক স্থাপনে অনবদ্য অবদান রাখতে পারে। প্রেম মৈত্রীর স্বর্ণোজ্বল ছোঁয়ায় অভিন্ন চেতনায় ধর্মনিরপেক্ষ মানবতা বোধ মানুষের মন–প্রাণ উজ্জীবিত করে। মানবতা বোধকে অগ্রবর্তী করে দেশাত্ব বোধে উদ্দীপিত হয়ে দেশকে এগিয়ে নিতে নতুন প্রজন্ম মহৎ অবদান রাখতে পারে।
প্রতিকূল যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে সহনশীলতা এক অনুপম আদর্শ। বিক্ষুব্ধ যেকোনো পরিবেশে, শক্তি থাকা সত্ত্বেও প্রতিশোধ গ্রহণ না করে ধৈর্য ধারণ করাই হলো সহনশীলতা। ঔপন্যাসিক বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কপালকুণ্ডলা উপন্যাসে নায়ক নব কুমারের উক্তি মতে “তুমি অধম, তাই বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন?” জাতি –দেশের যেকোনো ক্রান্তিলগ্নে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার প্রয়োজন অনস্বীকার্য। ইবনে আব্বাস (রা🙂 বলেছেন “ক্রোধের বশবর্তী হয়ে মানুষ অন্যায় জুলুমের প্রতিশোধ গ্রহণ না করে যদি ক্ষমা করে দেন তখন আল্লাহতালা তার বা তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন“। সহনশীলতার পুরস্কার প্রসঙ্গে আল্লাহতালা পবিত্র সুরা জুমার’র ১০ নম্বর আয়াতে বলেছেন “সহনশীল ব্যক্তিদেরকে তাদের প্রতিদান কোনো হিসাব ছাড়াই দেওয়া হবে “। মহানবী (সা🙂 বলেছেন “সহনশীলতার প্রতিদান জান্নাত ছাড়া আর কিছু নয়“। ইমাম গাজ্জালী (রহ) বলেছিলেন, “ঈমানের পরে বিবেকের দাবী হলো মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করা, প্রত্যেক সৎ এবং অসৎ লোকের প্রতি অনুকম্পা প্রদর্শন করা, সবার সাথে হাসিমুখে কথাবার্তা এবং বিনয়ের সাথে কথা বলা”। বিদ্রোহী কবি নজরুল বিক্ষুব্ধ যেকোনো পরিবেশে দ্বিধাদ্বন্দ্ব, অনৈক্যের বিপরীতে সাম্যবাদী চেতনাকে সমুন্নত করার লক্ষ্যে সমস্ত দ্বন্দ্বের উর্ধ্বে উঠে মানবতার উচ্চাদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে মানব কল্যাণ এবং দেশ সেবায় নিবেদিত থাকতে উদাত্ত আহবান জানিয়েছেন। কবি তাঁর ‘সাম্যবাদী’ কবিতায় মানবতার দীপ্তোজ্জ্বল চেতনায় উজ্জীবিত হতে উদাত্ত আহবান জানিয়েছেন: ‘গাহি সাম্যের গান,যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা–ব্যবধান/ যেখানে মিশেছে হিন্দু–বৌদ্ধ–মুসলিম–ক্রীশ্চান’। কিন্তু আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও বৈশ্বিক কাজে হিংসা, বিদ্বেষ, লোভ, ক্ষোভ, রাগ ভুলে গিয়ে মনের ঔদার্য নিয়ে সহনশীল মনোভাব দেখিয়ে আমরা কি একে অপরের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে পারিনা? ত্যাগের আদর্শে উজ্জীবীত হয়ে পরমতসহিষ্ণুতার নীতিবোধকে মনে ধারণ করে অন্যের উপকার করতে কিংবা মানবতার সেবায় নিবেদিত থাকতে আমরা মোটেও সচেষ্ট থাকি না। এ–র পেছনে রয়েছে স্বার্থপর মানুষের লোভ– হিংসা–মোহ যা মানবিক গুণাবলি অর্জনের পথে অন্তরায় হয়ে থাকে। মানুষ সম্পদ অর্জন, ব্যবহার এবং রক্ষায় ন্যূনতম সংযম দেখাতে ব্যর্থ। আমাদের অনেকের মাঝে দেশপ্রেম, দেশের প্রতি মমত্ববোধ, পরমতসহিষ্ণুতা, শান্তিপ্রতিষ্ঠায় এবং প্রগতিতে আস্থা ও বিশ্বাস নেই বললেই চলে। “মানুষ মানুষের জন্য , জীবন জীবনের জন্য “-এসব আপ্তবাক্য যুক্তিহীন, মূল্যহীন হয়ে পড়েছে। তাইতো সামাজিক, রাষ্ট্রীয় এবং বৈশ্বিক অঙ্গনে দেখা দিয়েছে দুর্বিনীত অসন্তোষ ও অস্থিতিশীলতা। অনেকে সর্বজনীন স্বার্থকে পদদলিত করে ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থের কাজে মরিয়া হয়ে উঠে। হিংসা–বিদ্বেষ, লোভে মোহগ্রস্ত থাকে বিধায় আলোর জগৎ, সভ্যতার জগৎ বিনির্মানের লক্ষ্যে ন্যায়নীতির পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে উন্নত জীবনবোধ সৃজনে তাদের শক্তি সাহস ম্রিয়মাণ। দুর্নীতি, অন্যায়, নির্যাতন, নিপীড়ন মানবতার ইতিহাসে বিষফোঁড়া হলেও অশুভ শক্তিতে ভর করে তাদের পথচলা কিন্তু অপ্রতিরোধ্য। এরা সাময়িকভাবে এতই দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী যে সমাজ ব্যবস্থা, রাষ্ট্র যন্ত্র বা বিশ্ব বিবেক তাদের কাছে পরাভব মানতে বাধ্য। তারা নির্দ্বিধায় অন্যের স্বার্থ, রাষ্ট্রের স্বার্থ লুঠে নিয়ে নিজেদেরকে বিত্তশালী করে তুলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। এদের কাছে গরীব নিঃস্ব, হতদরিদ্র ও মধ্যবিত্ত লোকদের অসহায় কান্না–নিদারুণ বোবাকান্না। তারা গরীব দু:খীর কথা ভাববে কি করে?
দুর্নীতি এবং অসাধুতার মাধ্যমে যারা প্রতিষ্ঠা লাভ করে তাদের ব্যক্তিস্বার্থের কাছে সমাজ, জনগণ এবং রাষ্ট্রের স্বার্থ অত্যন্ত নগণ্য। তাদের দৃষ্টি সুদূরপ্রসারী নয়। তারা ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে না। অন্যায়, জুলুম ও অত্যাচারের অপ্রতিরোধ্য শক্তিতে তারা অপ্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার কারণে সমাজ, রাষ্ট্র এবং বৈশ্বিক অগ্রগামিতায় সচরাচর তারা উদাসীন থাকে। সমাজ প্রগতির কথা ভাবে না বলে সমাজ রাষ্ট্রের প্রগতি পিছিয়ে পড়ছে, ইতিহাস ঐতিহ্য হোঁচট খাচ্ছে, সংস্কৃতি –সভ্যতা ম্লান হয়ে থমকে দাঁড়াচ্ছে। বস্তুত সবাইকে দলমত নির্বিশেষে রাষ্ট্র্রীয় অগ্রগতি, শিক্ষা সাহিত্য, শিল্প সংস্কৃতির অগ্রগতি ও দেশের উন্নয়নের কথা ভাবতে হবে। অন্যথায় সকল অগ্রগতির স্বপ্ন বিপরীত স্রোতে মিশে জনজীবনের শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে আমাদের পিঠ বারবার ঠেকবে গিয়ে হতাশার গহীন গহ্বরে। ‘ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়’ কথাটি বেমালুম ভুলে গিয়ে অনেকেই নীতি নৈতিকতার আদর্শিক মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলে। কথায় আছে বাঘের শক্তি বার বছর। বাঘ যেমন শক্তি হারায় ঠিক তেমনি মানুষের শক্তি কখনো চিরস্থায়ী হয় না। ইতিহাস পর্যালোচনা করতে গিয়ে আমরা অনেক সংস্কৃতি ও সভ্যতার উত্থান পতনের কথা জেনেছি। বেবীলনীয় সাম্রাজ্য এবং সভ্যতার কথা ইতিহাসের সাক্ষ্য হয়ে থাকলেও ঐতিহ্য আজ টিকে নেই। সেরকম রোমান সাম্রাজ্য ও সভ্যতা দোর্দণ্ড প্রতাপে গড়ে উঠেছিল। এ সাম্রাজ্যের উত্থান পতনেও যথেষ্ট সময় লেগেছিল। তাইতো প্রবাদ হয়ে আছে “জড়সব ধিং হড়ঃ নঁরষঃ রহ ধ ফধু“. সভ্যতা কিছুটা পরিলক্ষিত হলেও সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব অনেক আগেই বিলুপ্ত হয়েছিল। পরাক্রমশালী বৃটিশদের এশিয়া আফ্রিকায় কলোনি বিস্তারের কাহিনি আমাদের কম বেশি জানা আছে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে রাষ্ট্রপুঞ্জের অনেক দেশকে অনেকের পক্ষে বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণের ইতিহাসও আমাদের জানা আছে। সবশেষে সভ্যতার কথা বাদ দিলেও সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। দিনে দিনে শাসন ক্ষমতা সঙ্কুচিত হওয়ায় বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা লাভের প্রেক্ষাপটে বৃটিশ সাম্রাজ্যের শেষ সূর্যও অস্তমিত হয়েছিল।
বর্তমান বিশ্বে অনেক দেশ নিজেদেরকে অত্যন্ত পরাক্রমশালী ভেবে মানুষে মানুষে, জাতিতে জাতিতে এবং দেশে দেশে হিংসা বিদ্বেষের মাধ্যমে বিভেদ ও আগ্রাসনের দমননীতি চালিয়ে যাচ্ছে। অর্থ–বিত্ত এবং ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে এসব ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টিকারীদের মনে কবে শুভবুদ্ধির উদয় ঘটবে যাতে নির্যাতন, নিপীড়ন ও জাতিগত দাঙ্গা বন্ধ হয়ে সমপ্রীতি, সহযোগিতা, সৌভ্রাতৃত্ববোধ ও সহনশীলতার মাধ্যমে মানুষের জন্য শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের কাঙ্ক্ষিত পরিবেশ সৃষ্টি হয়। কালের বিবর্তনে মানব সভ্যতার ইতিহাসে বিভিন্ন পরিবর্তন ঘটেছে, বর্তমানে ঘটছে এবং ভবিষ্যতেও ঘটবে। পরিবর্তন বিচ্ছিন্ন কোনো বিষয় হবে না যদি নতুনের সৃজনে নিরবচ্ছিন্ন এ ঘটনাপ্রবাহ ইতিবাচক আদর্শ নিয়ে বহমান থাকে। ৫ আগস্ট আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া সরকার পরিবর্তনের ধারাটি ব্যতিক্রম কিছু না। এটি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে কল্যাণমূলক প্রতিশ্রুতি পূরণের মহান দায়িত্ব। কাজেই এ ধরনের পরিবর্তনের ধারাকে ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করে সমাজ, জাতি ও দেশের কল্যাণ অগ্রবর্তী করার প্রত্যয়ে দলমত, জাতিধর্ম নির্বিশেষে সকলকে একযোগে কাজ করতে হবে। সবাইকে মনে রাখতে হবে ব্যক্তি, দল, সমপ্রদায়, সবকিছুর উর্ধ্বে কিন্তু দেশ। ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, সততা, সহনশীলতা ও ত্যাগের মাধ্যমে দেশকে সমৃদ্ধ করা, দেশকে অগ্রগতির পথে নিয়ে যাওয়া সকলের নৈতিক দায়িত্ব। দায়িত্ববোধের সঠিক উপলব্ধির আলোকে পরিবর্তীত পরিস্থিতিতে দেশের সর্বোচ্চ উন্নয়নমুখী কর্মকাণ্ডে অন্তর্বর্তী সরকারসহ সকল জনগণকে এক ও অভিন্ন প্রচেষ্টা নিয়ে নিবেদিত থাকতে হবে। বিভেদ নয় ঐক্য, প্রতিশোধ নয় প্রতিরোধ, প্রতিহিংসা নয় সহনশীলতা হোক আমাদের অন্তরের অন্তর্নিবিষ্ট প্রার্থনা আর প্রত্যাশা। দেশ উন্নয়নের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে, দেশ অগ্রগতির পথে এগিয়ে যাবে সুনির্দিষ্ট গতিতে। বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।
লেখক : শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ও প্রাক্তন অধ্যক্ষ, রাংগুনিয়া সরকারি কলেজ।