ডুলাহাজারা সংরক্ষিত বন তিন কিলোমিটার বনের পরিবেশ ধ্বংস
ছোটন কান্তি নাথ, চকরিয়া
কক্সবাজারের চকরিয়ার ডুলাহাজারায় সংরক্ষিত বনের ভেতর পরিবেশবিধ্বংসী কর্মকাণ্ড আবারও শুরু করেছে দুর্বৃত্তরা। অন্তত তিন কিলোমিটারজুড়ে বনের সবুজাভ পরিবেশ ধ্বংস করেছে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন ও মাটি সংগ্রহ করতে। বালু ও মাটি লুট করার কারণে বনের ভেতর বিশাল বিশাল পরিখার মতো খনন করা হয়েছে।
এমনকি সেই পরিখার তীরের বালু সংগ্রহের জন্য মেশিন দিয়ে ছিঁটানো হচ্ছে পানিও। যাতে পানির সঙ্গে পাহাড়ের বালু ও মাটি ধসে যায়। সেই বালু ও মাটি সংগ্রহের পর খোলা জায়গায় স্তূপের পর ট্রাকভর্তি করে দেশের বিভিন্ন স্থানে করা হচ্ছে পাচার। এ কারণে পুরো এলাকায় ধুলোময় পরিবেশের সৃষ্টি হয়ে জনদুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে।
সরজমিন এমন দৃশ্য দেখা গেছে কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের ফাঁসিয়াখালী রেঞ্জ ও ফুলছড়ি রেঞ্জের অধীন ডুলাহাজারা, বগাচতর, বগাছড়ি, পাগলির বিল মৌজায়। সেখানে গত একমাস ধরে নতুন করে শুরু করা হয়েছে পরিবেশবিধ্বংসী এই কর্মকাণ্ড। বনবিভাগের নাকের ডগায় পরিবেশবিধ্বংসী এমন কর্ম তৎপরতা অব্যাহত ভাবে চললেও বনবিভাগ একেবারেই নিশ্চুপ রয়েছে।
সরজমিন পরিবেশবিধ্বংসী এসব কর্মকাণ্ডের চিত্র ধারণ করতে গিয়ে কিছুদূর পর পর বাধার সম্মুখীনও হতে হয়েছে গণমাধ্যমকর্মীদের। এমনকি সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের পাহারাও বসানো হয়েছে সেখানে। নতুন করে এই পরিবেশবিধ্বংসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সরকারি দলের স্থানীয় নেতারাই জড়িত রয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
তন্মধ্যে রয়েছে ডুলাহাজারা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি জমিল হোছাইন, আওয়ামী লীগ নেতা মনসুর, কলিম, সোনা মিয়া, জয়নাল, সোলাইমান, মাঈনউদ্দিন, এমরানসহ ১২০ জনের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেটে জড়িত রয়েছেন বলে জানা গেছে।
অভিযোগ ওঠেছে, বনবিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করেই সংরক্ষিত বনের ভেতর পরিবেশবিধ্বংসী এই কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অবৈধভাবে উত্তোলিত বালু প্রতিদিন শত ট্রাকে করে অন্যত্র পাচার করা হচ্ছে। প্রকাশ্যে এই কর্মকাণ্ড একমাস ধরে নির্বিঘ্নে চললেও প্রশাসন বা বনবিভাগ একেবারেই নিশ্চুপ রয়েছে। খোদ বনবিভাগের রেঞ্জ কার্যালয়ের সামনে দিয়েও প্রতিনিয়ত বালুভর্তি গাড়ি যাওয়া–আসা করছে। এতে নতুন করে পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে সংরক্ষিত বনের ৩–৪ কিলোমিটার এলাকা এবং ছড়াখাল দুটি।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ডুলাহাজারা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি জমিল হোছাইন দাবি করেন, তিনি এবং দলের অন্য কেউ পরিবেশবিধ্বংসী এই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। তাহলে নতুন করে একমাস ধরে কারা এই কর্মকাণ্ড সংঘটিত করছেন – এমন প্রশ্নে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘ভুট্টো নামের এক ব্যক্তিই এসব কাজ করে চলেছেন। হয়তো বনবিভাগ এবং প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই বালু উত্তোলনসহ সার্বিক কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছেন তিনি।’ এদিকে অভিযুক্ত অন্যরাও পরিবেশবিধ্বংসী এমন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নয় মর্মে দাবি করেছেন।
তবে আওয়ামী লীগ সভাপতির দাবি অনুযায়ী ভুট্টোর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘অনেক আগের উত্তোলিত বালু জব্দ করার পর বনবিভাগ প্রকাশ্যে নিলাম দেয়। সেই নিলামের বালু আমি বিক্রি করছি। তার মানে এই নয় যে, আমি বন ধ্বংস করে বালু ও মাটি সংগ্রহ করছি। যদিওবা বন ধ্বংস করে বালু ও মাটি লুট করছে একটি চক্র। সেই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে আমার বিন্দুমাত্রও সম্পৃক্ততা নেই।’
নতুন করে পরিবেশবিধ্বসী কর্মকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের ফাঁসিয়াখালী রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. মেহরাজ দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘জানা মতে আমার অধীনস্থ সংরক্ষিত বনের ভেতর পরিবেশবিধ্বংসী কর্মকাণ্ড কেউ করছে কী–না তা জানা নেই। তবে প্রতিনিয়ত নজরদারি করা হচ্ছে।’
চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ফখরুল ইসলাম দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘ডুলাহাজারার সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ভেতর পরিবেশবিধ্বংসী কর্মকাণ্ড সংঘটিত করা হলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। যে কোনো মূল্যে এসব কর্মকাণ্ড কঠোরভাবে দমন করা হবে।’
প্রসঙ্গত, কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের ফাঁসিয়াখালী রেঞ্জের আওতাধীন ডুলাহাজারার সংরক্ষিত বনাঞ্চলের উপরোক্ত মৌজায় ওপর দিয়ে বহমান দুটি ছড়াখাল তথা কথিত বালু মহাল ইজারা নেওয়ার নামে ২০১৯ সাল থেকে একই ধরনের তৎপরতা শুরু করে প্রভাবশালী বালুদস্যুরা। এ নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বেশ কয়েকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এর পর টনক নড়ে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর। তখন আদালতের
কঠোর নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন এবং বনবিভাগের একের পর এক অভিযানে বন্ধ হয়ে যায় বালুখেকোদের অপতৎপরতা।
ডুলাহাজারা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান হাসানুল ইসলাম আদর বর্তমান পরিস্থিতি প্রসঙ্গে বলেন, ‘বেলার মামলা এবং উচ্চ আদালতের নির্দেশনায় পাগলির ছড়া ও বগাছড়ি ছড়ার কথিত বালু মহাল ইজারা প্রদান বন্ধ থাকলেও পুরোনো কায়দায় নতুন করে আবারও ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয় ঘটিয়ে বালু উত্তোলনের মহা কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে এখানে। তবে কারা এই বালু তোলায় জড়িত রয়েছে তাদের নাম বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ তারা এতই প্রভাবশালী যে, বনবিভাগ বা প্রশাসন কেউই এই অবৈধ কর্মকাণ্ড বন্ধে অভিযান পরিচালনা করতেও সাহস করছে না।