ভোগান্তি পিছু ছাড়ছে না চট্টগ্রামের নগরবাসীর। প্রতি বছর বর্ষা এলেই ডুবে যায় চট্টগ্রাম নগরীর বেশিরভাগ এলাকা। যদিও জলাবদ্ধতা নিরসনে সরকারের পক্ষ থেকে কম চেষ্টা হচ্ছে না। এর জন্য ১১ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকার কাজ চলমান রয়েছে। তবু এর মধ্যেই এবার ভয়াবহ জলাবদ্ধতা দেখেছে নগরবাসী। অন্যদিকে তার জন্য চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন আর চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের মধ্যে রয়েছে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ। এই দুই কর্তৃপক্ষ কেবল পরস্পরকে দোষারোপ করেই দায়িত্ব সারছে না, দায়ও নিতে চায় না। ফলে সমাধান হচ্ছে না নগরবাসীর ভোগান্তির। দীর্ঘদিন ধরেই জলাবদ্ধতার শিকার বাণিজ্যিক রাজধানী খ্যাত চট্টগ্রাম। গত কয়েকদিনে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখেছে চট্টলাবাসী।
সংবাদ সম্মেলন করে সিডিএ চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ বলেছেন, নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনের কাজ সিডিএর (চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) না। চসিক (চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন) না পারায় সিডিএকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে আমরা কাজ করছি। সে অনুযায়ী কাজ চলমান রয়েছে। প্রকল্পের আওতায় থাকা খালে কোনো ময়লা নেই, পরিষ্কার রয়েছে। নালা–ড্রেন পরিষ্কার না করায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। নালা–ড্রেন পরিষ্কারের কাজ তো সিডিএ’র না। এটি সিটি কর্পোরেশনের কাজ। যেটা সত্য, সেটাই বলছি। আমরা কাউকে দোষারোপ করছি না।
অন্যদিকে সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজ সিটি কর্পোরেশনের হাতে নেই। এখানে আমি কাজ করতে পারছি না, ওভারলেপিং হয়ে যাবে। যে সংস্থা কাজ করছে মেইনটেইনেন্সের সব দায়িত্ব তাদের। যেমন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ চলছে, সেখানে রাস্তাঘাট নষ্ট হচ্ছে। কিন্তু সেখানে সিটি কর্পোরেশন কাজ করতে পারবে না। ওভারলেপিং হলে পরে আমাকে জবাবদিহি করতে হবে। বলবে, একটা প্রকল্পের কাজ চলছে সেখানে তুমি কেন টাকা খরচ করতে গেছ। জলাবদ্ধতা নিরসনে সিডিএ’র মেগা প্রকল্প প্রসঙ্গে মেয়র বলেন, আমি বারবার বলেছি জলাবদ্ধতার কাজ চলছে। কিন্তু কত মাটি উত্তোলন করা হবে, খালের গভীরতা কত হবে আমরা জানি না। ডিপিপিতে (মেগা প্রকল্পের) দেখেছি, সাড়ে নয় লক্ষ ঘনমিটার মাটি উত্তোলনের কথা। এর জন্য ভূমি অধিগ্রহণের কথা। হয়তো উনারা বলতে পারে, আমরা ভূমি অধিগ্রহণ না করে মাটি সরিয়েছি।
মেয়র বলেন, মাটি উত্তোলন করেছেন খুব ভালো কথা। চাক্তাই খাল দৃশ্যমান জিনিস, এখানে কাউকে দোষারোপ করার প্রশ্নই আসে না। মহিউদ্দিন চৌধুরীর আমলে চাক্তাই খালের তলা পাকা করা হয়েছে। সাংবাদিক, সুশীল সমাজের প্রতি আবেদন জানাব, আপনারা এখনি গিয়ে দেখে আসেন, যদি এটা (চাক্তাই খাল) খনন করা হয় তাহলে আগের ওই পাকাতলা পর্যন্ত ক্লিয়ার থাকবে। পাহাড় পরিমাণ মাটি কীভাবে চাক্তাই খালে থাকে? বীর্জা খাল, মহেশখাল দেখে আসেন। এগুলোও দৃশ্যমান জিনিস, দোষারোপ নয়। বিষয়গুলো উঠে আসছে এ জন্য, যেহেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন হলেই চট্টগ্রামবাসী সুফল পাবে। এ প্রকল্প সিটি কর্পোরেশনের হাতে থাকলে দায়দায়িত্ব আমার ওপর পড়ত। কারণ মানুষ চায় একটু স্বস্তি। মানুষ কষ্ট পাচ্ছে, সেটা আপনারা অবগত আছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে নানা পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, তার অনেকগুলো বাস্তবায়নও হয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি, বরং দিন দিন অবনতি হয়েছে। এর কারণ গৃহীত প্রকল্পের অকার্যকরতা ও তার বিপরীতে অব্যাহত অপরিকল্পিত নগরায়ণ। সিডিএ, চসিক ও চট্টগ্রাম ওয়াসার মধ্যে সমন্বয়ের কথা উঠেছে, উঠেছিল জলাবদ্ধতা নিরসনে মেগা প্রকল্প গ্রহণ করার কথা। বক্স কালভার্ট নির্মাণ, খাল খনন ও প্রশস্তকরণ, খালে জলকপাট বা স্লুইসগেট নির্মাণ ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, কাজ হয়নি। জনগণ তাদের নিয়মে শহরে বসতি গড়ছে, খাল ভরাট হচ্ছে, আবার প্রাকৃতিক নিয়মে সমুদ্রের উচ্চতা বাড়ছে। সরকারের অর্থাৎ জনগণের টাকা যাচ্ছে, কিন্তু বর্ষার অভিশাপ চলছে, ভোগান্তি ও আর্থিক ক্ষতি দিন দিন বাড়ছে। বর্তমানে একটি বৃহৎ প্রকল্পের ৭৬ শতাংশ কাজ শেষ হওয়ার পরও পরিস্থিতির অবনতি বন্ধ হয়নি। ভোগান্তি ও ক্ষয়ক্ষতি অব্যাহতভাবেই বেড়ে চলেছে।
তাঁরা বলেন, ‘জলাবদ্ধতা নিরসনে সিডিএ, চসিক ও ওয়াসার সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। এতে কে নেতৃত্ব দেবেন সেই দ্বন্দ্ব ঠেকাতে তিন সংস্থার প্রধানদের মধ্যে কোয়ার্টারলি পালাবদলের প্রথা চালু করা যায়। কিন্তু সমন্বয় আবশ্যিক। তাই বরাদ্দকৃত অর্থ পরিকল্পনামাফিক খরচ হচ্ছে কিনা, ব্যয়িত অর্থের সুফল মিলছে কিনা এসব দেখার জন্য নজরদারি ও খবরদারি তাদেরই করতে হবে। এর প্রথম পদক্ষেপ হওয়া উচিত তিন সংস্থার সমন্বয়ে চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনের একটি শীর্ষ সংস্থা তৈরি। সেটি যাতে কার্যকর ও সফল হয় তার যথোচিত ব্যবস্থাও নিতে হবে। দেশের বন্দরনগরী ও বাণিজ্যিক রাজধানীতে এ রকম অব্যবস্থা চলতে পারে না।’