ইসলামের একটি প্রধানতম রোকন হচ্ছে হজ। কিছু নির্দিষ্ট শর্ত ও সামর্থ্য থাকা সাপেক্ষে প্রত্যেক মুসলমানের ওপর যিলহজ মাসের প্রথম দশকে মক্কা শরিফে অবস্থিত মসজিদুল হারামে, আরাফাতের ময়দানে, মুজদালিফা ও মিনায় হাজির হয়ে কিছু আনুষ্ঠানিক ইবাদত–বন্দেগি পালন করতে হয় এবং এর নামই হজ যা ইসলামের অন্যতম প্রধান ফরয। হজ সর্বপ্রথম অনুষ্ঠিত হয়েছিল হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর সময়ে, মহানবী (সা.)-এর আগমনের অনেক আগে। তখন থেকেই হজ ও ওমরার বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা যেমন ইহরাম পরিধান, সাফা ও মারওয়ার মাঝখানে দৌড়ানো, আরাফার ময়দানে উপস্থিত হওয়া, কাবাঘরের চারদিকে প্রদক্ষিণ করা বা তাওয়াফ, কাবাঘরের দেয়ালে স্থাপিত কালো পাথর–হাজরে আসওয়াদে চুমু দেয়া প্রভৃতির প্রচলন ছিল। মহানবী (সা.)-এর আগমনের পর যে হজ পালিত হচ্ছে তাতে আগের বিধানগুলোর সাথে মাত্র কয়েকটি ইসলামি শিক্ষার সংযোজন হয়েছে।
হজ আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ ইচ্ছা বা সংকল্প করা। ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায় মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশ পালনার্থে নির্দিষ্ট সময়ে, নির্ধারিত তারিখে, নির্দিষ্ট স্থান তথা কাবা শরিফ ও তৎসংশ্লিষ্ট স্থানগুলো জিয়ারত করার সংকল্প করাকে হজ বলা হয়। হজ ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম স্তম্ভ। হজে রয়েছে নানাবিধ ফায়দা ও শিক্ষা। তম্মধ্যে অন্যতম শিক্ষা হলো মুসলমানদের ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্যের শিক্ষা। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কাবাগৃহে যাতায়াতের জন্য (দৈহিক ও আর্থিকভাবে) সক্ষম প্রত্যেক মু’মিনের ওপর হজ করা ফরজ। (সূরা আলে–ইমরান–৯৭) রাসূলুল্লাহ (সা.)-বলেছেন অনিবার্য প্রয়োজন কিংবা অত্যাচারী শাসক অথবা কঠিন রোগ যদি (হজে সামর্থ্যবান) কোনো ব্যক্তিকে হজ পালনে বিরত না রাখে তবে সে যদি হজ পালন না করে মারা যায় সে যেন ইহুদি ও নাসারার মতোই মৃত্যুবরণ করে। সুতরাং যে ব্যক্তি হজব্রত পালন করল সে স্রষ্টার নির্দেশ পালন করে নিজেকে ধন্য ও জান্নাতি মানবে পরিণত করল।
পবিত্র স্থানগুলো অবলোকন : পবিত্র মক্কা ও মদিনায় রয়েছে অগণিত পবিত্র স্থান। যেমন আল্লাহতায়ালার ঘর, হাজরে আসওয়াদ, সাফা–মারওয়া, আরাফার মাঠ, মিনা, মুজদালিফা, মসজিদে হারাম, মসজিদে নববী, প্রিয় নবী সা:-এর রওজা মোবারক, জান্নাতুল বাকি, জান্নাতুল মুয়াল্লা, জমজম কূপ ইত্যাদি। এসব স্থান দেখার ফলে ঈমান বৃদ্ধি পায়। পবিত্র হজের মাধ্যমেই এসব স্থান দেখার সুবর্ণ সুযোগ লাভ হয়।
হজ ঐক্যের প্রতীক : ইসলাম ঐক্যের ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করেছে। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন–হে মুুমিনরা! তোমরা ঐক্যবদ্ধভাবে আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়ে ধরো পারস্পরিক বিচ্ছিন্ন হয়ো না। (সূরা আলে–ইমরান–১০৩) পাঁচ ওয়াক্ত সালাত জামাতের সাথে পড়া জুমা ও ঈদের সালাত মুসলমানদের ঐক্যের প্রতি ইঙ্গিত করে। বিশেষ করে হজ মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের প্রতীক। এ ধরনের সম্মেলন অন্য কোনো ধর্ম বা জাতির মধ্যে অনুষ্ঠিত হয় না। একমাত্র তৌহিদবাদী মুসলমানরাই পৃথিবীর দিগ্দগন্ত থেকে ছুটে আসে কাবা পানে। এখানে বর্ণ ও ভাষার ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে সবাই এক কাতারে হয়ে একই কণ্ঠে উচ্চারণ করেন–লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক। লাব্বাইক লা শারিকা লাকা লাব্বাইক। ইন্নাল হামদা ওয়ান নিমাতা লাকা ওয়ালমুলক লা শারিকা লাক। হজে–সুন্নি, লা–মাজহাবি, আহলে হাদিস, বিভিন্ন পীরের মুরিদ, বিভিন্ন দলের অনুসারীদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আরাফাতের মাঠে সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অবস্থান করে। আল্লাহর ঘর তাওয়াফ করে। সাফা–মারওয়া সায়ি করে। মিনায় কোরবানি করে। তদ্রুপ হজের পরও তাদের মধ্যে মতভেদ ও মতানৈক্য থাকা উচিত নয়। আমাদের পরিচয় হওয়া উচিত আমরা সবাই মুসলমান।
সমতার শিক্ষা : হজ থেকে লাভ করা যায় সমতার শিক্ষা। রাজা–প্রজা, ধনী–গরিব, শিক্ষিত–অশিক্ষিত, সাদা–কালো ও নানা দেশের নানা ভাষী মানুষ ইহরাম অবস্থায় ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে সাদা কাপড় পরিধান করে একই কাতারে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ইবাদত করার এ দৃশ্য মমতা ও অভিন্নতার শিক্ষা দান করে।
ত্যাগের শিক্ষা : আল্লাহর রাহে হজরত ইবরাহিম আ:, ইসমাইল আ: ও হাজেরা আ:-এর ত্যাগ তিতিক্ষা, শ্রম, কোরবানি, আত্মসমর্পণ ও অগ্নি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার সুমহান ঐতিহ্য আল্লাহপ্রেমিক মানবের হৃদয়কে অনুপ্রাণিত করে। হজ ও কোরবানি এ ত্যাগের শিক্ষা দেয়।
ভ্রাতৃত্বের শিক্ষা : মহানবী সা: বলেছেন সব মুসলমান ভাই ভাই। তার জ্বলন্ত নিদর্শন হজব্রত পালন। সবধরনের ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে আরাফার মাঠে সব একত্রিত হয়। যেন সবাই একই মায়ের সন্তান। একই ইমামের পেছনে সালাত আদায় করে একই স্রষ্টার কাছে দোয়া করে। হজ বিশ্বমুসলমানদের ভ্রাতৃত্বের বন্ধন জোরদার করে। হজ শেষ করে নিজ নিজ দেশে গিয়ে বিশ্বভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে আরো সুদৃঢ় করে।
আল্লাহর নিয়ামত লাভ : হজব্রত পালনকারীদের ওপর আল্লাহর নিয়ামত বর্ষিত হয়। মহানবী সা: বলেছেন যখন হাজীরা আরাফাতে অবস্থান করে দোয়া ও কান্নাকাটি করতে থাকে তখন আল্লাহতায়ালা দুনিয়ার আসমানে আসেন এবং ফেরেশতাদের বলেন–আমার বান্দাদের দেখো ওদের চুল এলোমেলো হয়ে আছে পরিধেয় বস্ত্র ধুলাবালুতে মলিন। দেখো ওরা এ অবস্থায়ই আমার কাছে চলে এসেছে। লোকেরা যখন আরাফাতে উপস্থিত হয়ে কান্নাকাটি করে তখন আল্লাহর তরফ থেকে তাদের জন্য বিশেষ রহমত বর্ষিত হয়। আর আল্লাহতায়ালার রহমতে আরাফার দিন অধিকসংখ্যক পাপীকে ক্ষমা করে দেয়ার ফলে শয়তান খুবই ব্যথিত হয়।
আন্তর্জাতিক যোগাযোগের সুযোগ : হজে উপস্থিত হয় বিশ্বের নানা দেশের মানুষ। এ সুযোগে তাদের সাথে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় ইত্যাদি বিষয়ে যোগাযোগ করার সুযোগ সৃষ্টি হয়। একে অন্যের সাথে মিশে ভাবের আদান–প্রদান করা যায় এবং সুখ–দুঃখের আলোচনা করা যায়। ফলে হজ আন্তর্জাতিক যোগাযোগের একটি উত্তম ক্ষেত্র। হজ বিশ্বমুসলিমের বার্ষিক মিলনমেলা। আল্লাহতায়ালা দিনে পাঁচবার জামাতে কিছুসংখ্যক লোকের, তারপর সপ্তাহে একবার জুমার দিনে আরো কিছু বেশি লোকের, তারপর বছরে দুবার আরো কিছু বেশি লোকের, তারপর বছরে একবার হজে আরাফার মাঠে বিশ্বের সব মানুষকে একত্রিত করার সুব্যবস্থা করেছেন।
জান্নাতি হওয়ার সুযোগ : ইসলামে হজের গুরুত্ব অপরিসীম। আল্লাহর পবিত্র ঘর দেখা থেকে শুরু করে বিদায়ী তাওয়াফ পর্যন্ত প্রতিটি কাজই আল্লাহতায়ালার একত্ববাদ, বিশ্বমুসলিমের ভ্রাতৃত্ব, ঐক্য ও সংহতির প্রশিক্ষণ। হজের মাধ্যমে একজন হাজী নিজেকে জান্নাতে যাওয়ার উপযোগী করে তোলেন। তাই মহানবী সা: বলেছেন মকবুল হজের প্রতিদান জান্নাত ছাড়া আর কিছু নয়। (বুখারি ও মুসলিম)
মোট কথা হচ্ছে হজের প্রতিটি হুকুমের মধ্যে রয়েছে বহুবিধ হিকমত ও জীবন দর্শন। এগুলোর পূর্ণ বিবরণ দেয়া কারো পক্ষে সম্ভব নয়। তবে সংক্ষেপে বলা যায় যে পবিত্র হজের আনুষ্ঠানিকতা হচ্ছে মানুষের দুনিয়ার জীবন, কবরের জীবন, হাশরের ময়দানে উপস্থিতি, হিসাব–কিতাব ও রোজ কিয়ামতের দৃশ্যপটের ক্ষুদ্র পরিসরে প্রদর্শনী। তাই পবিত্র হজ মুমিনের জন্য শ্রেষ্ঠ উপহার।
লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট।