হিজরি সনের প্রথম মাস মহররম এলে আমরা গভীরভাবে বেদনার্ত ও শোকাচ্ছন্ন হয়ে উঠি। এ মাসের দশম দিনটি ‘আশুরা’ হিসেবে সারা বিশ্বের মুসলমানরা অতীব তাজিম ও সম্মানের সঙ্গে উদযাপন করে। আশুরা মানেই দশম। মহররমের দশ তারিখটি নানা কারণে বেশ ঘটনাবহুল। এই দিনটিতে জগতের সূচনা হয়েছে এবং মহররমের আশুরা দিবসেই এই মহাবিশ্বের ইতি ঘটবে–যা কুরআন হাদিসের আলোকে প্রতীয়মান হয়। আশুরার এই দিনটি বিশ্ব মুসলমানদেরকে বিশেষভাবে নাড়া দেয় ৬১ হিজরিতে কারবালা ময়দানে সংঘটিত নবী দৌহিত্র হযরত ইমাম হোসাইন (রা) সহ আহলে বায়তে রাসূলের (দ) নির্মমভাবে শাহাদাতের ট্র্যাজেডির কারণে। মহররম যেমন শোক ও বেদনার মাস, তেমনি ঈমানি চেতনা ও প্রেরণায় মুসলমানদের জেগে উঠার মাস এই মহররম। প্রিয় নবী রাহমাতুল্লিল আলামিন শফিউল মুজনেবিন হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রবর্তিত দ্বীন ইসলামের স্বকীয়তা যখন পাপিষ্ঠ ইয়াজিদের হাতে আক্রান্ত হয়, ইয়াজিদ যখন গায়ের জোরে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে নবী পরিবারের ওপর জঘন্য নৃশংসতা চালায়, তখনই দুরাচারী ইয়াজিদিদের পরাভূত ও প্রতিহত করতে দ্বীন ইসলামের ঝাণ্ডা হাতে এগিয়ে আসেন প্রিয় নবীর (দ) দৌহিত্র জান্নাতের যুবকদের সর্দার মর্দে মুজাহিদ হযরত ইমাম হোসাইন (রা)। একদিকে নানাজানের দ্বীন ইসলামকে ইয়াজিদি কুচক্রীদের কবল থেকে রক্ষা করতে হবে, অন্যদিকে ইয়াজিদি দুঃশাসন থেকে জনগণকে পরিত্রাণ দিতে হবে এই দুটি লক্ষ্য সামনে নিয়ে কারবালা ময়দানে ইয়াজিদিদের সঙ্গে অসম যুদ্ধে অবতীর্ণ হন দ্বীনের প্রতীক হযরত ইমাম হোসাইন (রা)। অসম যুদ্ধে অসামান্য সাফল্যের দৃষ্টান্ত কারবালার যুদ্ধ। এই যুদ্ধে হযরত ইমাম হোসাইনের (রা) পক্ষে ছিলেন ৮২ জন, মতান্তরে ৩০০ জন। আর ইয়াজিদের সশস্ত্র সৈন্য সংখ্যা ছিল ১২ হাজার বা মতান্তরে ২২ হাজার। তবুও এই অসম যুদ্ধে ইমাম হোসাইনি কাফেলার বীর সৈন্যদের আঘাতে ইয়াজিদিদের প্রায় ৩০০ জন সৈন্য মারা যায়। অসম যুদ্ধে এতো সাফল্য সত্যিই বিস্ময়কর। পৃথিবীর ইতিহাসে কারবালা ট্র্যাজেডির মতো এমন হৃদয়বিদারক নৃশংস ঘটনা আর ঘটেনি। ফোরাত নদীর পানি থেকে নবী পরিবারের নারী শিশুদের পর্যন্ত বঞ্চিত করে জঘন্য নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছে পাপিষ্ঠ ইয়াজিদ। আল্লাহর নিয়ামত নদ–নদী সাগরের পানির ওপর পৃথিবীর সকল মানুষের সমান হক ও ন্যায্য অধিকার রয়েছে। অথচ পাষণ্ড ইয়াজিদ বাহিনী সেদিন কারবালা ময়দানে পানির জন্য ছটফট করতে থাকা অবুঝ নিষ্পাপ শিশু নারীদেরকে পর্যন্ত এক ফোটা পানি দেয়নি। ফোরাত নদী ঘেরাও করে রেখে পিপাসায় কাতর নবী পরিবারের সদস্যদের ওপর ইয়াজিদি গোষ্ঠী যে জঘন্য নির্মমতা দেখিয়েছে, দুনিয়ার ইতিহাসে এমন বর্বরতার দ্বিতীয় নজির নেই। তাই কারবালার ট্র্যাজেডির কথা স্মরণে এলে শুধু মুসলিম কেন, বিবেকবান দরদী যেকোনো মানুষের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটে। কারবালা ট্র্যাজেডি মননে চেতনায় ঝড় তোলে প্রতিটি মানুষের মাঝে। শাহাদাতে কারবালার শিক্ষা ও দর্শন হলো অন্যায় অসত্য ও মিথ্যার সঙ্গে আপস না করা। হক, সত্য ন্যায়নীতি ও ইনসাফভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার পক্ষে সুদৃঢ় অবস্থান নিয়ে গণবিরোধী অপশক্তিকে রুখে দেয়া। কারবালা ট্র্যাজেডির মধ্য দিয়ে স্বৈরতন্ত্র ও রাজতন্ত্রের কবর রচিত হয়েছে। গণতন্ত্রের বিজয় ঘটেছে এবং জনগণের অধিকার ও আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে হযরত ইমাম হোসাইন (রা) ও আহলে বায়তে রাসূলের (দ) ত্যাগ ও শাহাদাতের উসিলায়। তাই, মহররমের দশম তারিখে সংঘটিত কারবালার ট্র্যাজেডি যুগে যুগে সত্য অন্বেষী মুক্তি প্রত্যাশী মানুষের প্রেরণার উৎস হয়েই থাকবে।
পবিত্র আশুরার মাহাত্ম্য: ‘মহররম’ শব্দটি ‘হরমুন’ থেকে উদগত। এর অর্থ সম্মানিত, মর্যাদাসম্পন্ন, পবিত্র। ইসলামে মহররম মাসটি খুবই ফযিলতময় ও মাহাত্ম্যপূর্ণ। এ মহররম মাস অনেক ঘটনা ইতিহাসের সাক্ষী। এ মাসে অসংখ্য তথ্যবহুল ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল। তাই মুসলিম মিল্লাতের জীবনে এই মহররম মাস বেশ গুরুত্বপূর্ণ। জাহেলি যুগেও আরবরা এ মাসকে শ্রদ্ধা ও সম্মান করতো। জাহেলি যুগের আরবরা মহররম, জিলকদ, জিলহজ্ব ও রজব এই চার মাসে যুদ্ধ বিগ্রহ করত না। কুরআন মজিদের সূরা আত তাওবার ৯ : ৩৬ আয়াতে আল্লাহ পাক বলেন, ‘ফালা তাজলিমু ফিহিন্না আন্ফুসাকুম’–অর্থাৎ ‘এই মাসগুলোতে তোমরা পরস্পরের ওপর অত্যাচার করো না।’ অন্যদিকে, মহররম মাসের দশম দিনই আশুরা নামে পরিচিত। এ আশুরা দিবসে সংঘটিত হয় অনেক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল খাওয়ায় হযরত আদম (আ) ও মা হাওয়া (আ) কে আল্লাহ পাক বেহেশত থেকে এ দিনে দুনিয়ায় পাঠিয়ে দেন। সুদীর্ঘ সাড়ে তিনশত বছর পর তাদের তাওবা আশুরার দিবসে আল্লাহ পাক কবুল করেন। হযরত মুসা (আ) কে আল্লাহ পাক ফেরাউনের কবল থেকে মুক্তি দেন এই আশুরা দিবসে। ফেরাউন তার দলবলসহ নীল নদে ডুবিয়ে মরে এই দিনে। হযরত নূহ (আ) সাড়ে নয়শত বছর পর্যন্ত তাঁর উম্মতকে আল্লাহর পথে ডেকেও ব্যর্থ হন। তাদের আর ঈমান গ্রহণের আশা নেই দেখে হযরত নূহ (আ) আল্লাহর কাছে প্রার্থনা জানিয়ে বলেন, ‘রাব্বি লা তাজার আলাল আরদি মিনাল কাফিরিনা দাইয়ারা’ অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ পৃথিবীতে কাফিরদের একটি ঘরও অবশিষ্ট রেখো না’ (সূরা নূহ : ৭১ : ৭৮)। তখন পৃথিবীতে মহাপ্রলয় ঘটলো। প্রবল বন্যায় সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে গেল। হযরত নূহ (আ) চল্লিশজন ঈমানদার আর সকল প্রজাতির এক এক জোড়া পশুপাখি নিয়ে দীর্ঘ এক বছর ধরে এক বিশাল কিস্তিতে ভাসতে থাকে। যেদিন তাঁর কিস্তি বা নৌকাটি ‘জুদি’ পাহাড়ে ভিড়ল, পানি নেমে গেল, তারা দুনিয়ায় পদার্পণ করলেন যে শুভ দিনটিতে, দিনটি ছিল আশুরা বা দশই মহররম। হযরত ইউনুস (আ) মাছের পেট থেকে নিষ্কৃতি লাভ করেন এই আশুরার দিনে। হযরত ইউসুফ (আ) কে তার বিমাতা ভাইরা ষড়যন্ত্র করে গভীর অন্ধকার কূপে নিক্ষেপ করে। আল্লাহ পাক আশুরার দিনে হযরত ইউসুফ (আ) কে কূপ থেকে মুক্ত করেন। হযরত ইয়াকুব (আ) পুত্র ইউসূফের (আ) শোকে কাঁদতে কাঁদতে চোখের জ্যোতি হারিয়ে ফেলেন। হযরত ইউসুফ (আ) এর প্রেরিত জামার উসিলায় হযরত ইয়াকুব (আ) যেদিন চোখের আলো ফিরে পেলেন সেই মহিমান্বিত দিনটি ছিল পবিত্র আশুরা। হযরত আইয়ুব (আ) সতের বছর ধরে কঠিন রোগে ভোগার পর আরোগ্য লাভ করেন আশুরা দিবসে। হযরত ঈসা (আ) জন্ম নেন আশুরার দিনে। তাঁর জাতি যখন তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে তখন আল্লাহ পাক তাঁকে আশুরার দিনে শত্রুদের কবল থেকে মুক্ত করে চতুর্থ আসমানে তুলে নেন। মুসলিম মিল্লাতের পিতা হযরত ইবরাহিম খলিলুল্লাহ (আ) আশুরার দিনে পৃথিবীর বুকে ভূমিষ্ঠ হন। বশ্যতা না মানায় হযরত ইব্রাহিম (আ) কে নমরুদ আগুনে নিক্ষেপ করে। চল্লিশ দিন পর্যন্ত আগুন জ্বললেও হযরত ইব্রাহিমের (আ) কোনো ক্ষতি হয়নি। তিনি নমরুদের আগুন থেকে মুক্তি পেয়েছেন আশুরা দিবসে। জ্বিন ও মানবজাতির মহান বাদশাহ হযরত সোলাইমান (আ) পদচ্যুত হবার চল্লিশ দিন পর আশুরার দিনে পুনরায় রাজত্ব ফিরে পেয়েছেন। এভাবে আরো অনেক ঘটনার সাক্ষ্য বহন করে মহররম মাসের আশুরা দিবসটি। মহররমের দশম তারিখে আশুরার রোজা রাখার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রিয় নবী (দ) । তবে শুধু একদিন নয়, দুই দিন রোজা রাখতে উৎসাহিত করেছেন প্রিয় নবীজী (দ) । দশই মহররম একটি রোজা রাখতো ইহুদিরা। মহানবী (দ) এরশাদ করেছেন, ‘তোমরা আশুরার দিনে রোজা রাখো, তবে এক্ষেত্রে ইহুদিদের সঙ্গে মিল না হওয়ার জন্য ১০ তারিখের আগের দিন অথবা পরের দিন আরও একটি রোজা রাখো।’ (আহমদ : ২১৫৪)।
মহররম মাসে চট্টগ্রাম জমিয়তুল ফালাহ মসজিদে আহলে বায়তে রাসূল (দ) স্মরণে প্রতিবছর শাহাদাতে কারবালা মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। ১৯৮৬ সনে এ মসজিদ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ১০ দিন ধরে বর্ণাঢ্য আয়োজনে এ কারবালা মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এবার ৩৮তম মাহফিলেও দেশি–বিদেশি ইসলামী স্কলাররা অতিথি ও আলোচক হিসেবে অংশ নিচ্ছেন। এ মাহফিলের প্রবর্তন করেন জমিয়তুল ফালাহর প্রথম খতিব অধ্যক্ষ আল্লামা জালাল উদ্দিন আলকাদেরী (রহ)।
লেখক : সাংবাদিক, যুগ্ম মহাসচিব, হিজরি নববর্ষ উদযাপন পরিষদ