কোনো প্রকার ঘোষণা না দিয়ে হঠাৎ করেই জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে চট্টগ্রামে বন্ধ রয়েছে অধিকাংশ গণপরিবহন। গতকাল শুক্রবার ভোর ৬টা থেকে অনির্দিষ্টকালের এই ধর্মঘটে বন্ধ রয়েছে বাস চলাচল। চলছে না পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত ট্রাক-কাভার্ডভ্যানও। গত ৫০ বছরে একসঙ্গে জ্বালানি তেলের এত মূল্যবৃদ্ধি কখনও হয়নি বলেও জানান পরিবহন মালিক-শ্রমিক নেতৃবৃন্দ। পরিবহন চালকরা বলছেন, তেলের দাম বাড়ানোর ফলে বিদ্যমান ভাড়ায় তাদের পক্ষে গাড়ি চালানো সম্ভব নয়। আর মালিকরা বলছেন, ভর্তুকি দিয়ে তারা গাড়ি চালাতে দেবেন না।
সরকারি সিদ্ধান্তে গত বুধবার মধ্য রাত থেকে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ১৫ টাকা বেড়েছে। এরপর বৃহস্পতিবার পরিবহন চালানো বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন এবং বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান শ্রমিক ইউনিয়ন। শুক্রবার সরেজমিনে নগরীর মুরাদপুর, অক্সিজেন, টাইগারপাস, নিউমার্কেট, বহদ্দারহাট, কাপ্তাই রাস্তার মাথা ও কালুরঘাট এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ছুটির দিনেও বিভিন্ন কারখানা ও বেসরকারি অফিস খোলা থাকায় কর্মজীবী মানুষ মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছেন। কেউবা বাড়িতে যাওয়ার জন্য বাস স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছেন। এ সুযোগে বাড়তি ভাড়া আদায়ের সুযোগ নিচ্ছে প্রাইভেট কার, সিএনজি টেক্সিগুলো। নগরীর বিভিন্ন রুটে কিছু টেম্পো চললেও তারা আদায় করছে বাড়তি ভাড়া। সে সঙ্গে পরিবহন সংকটে বিপাকে পড়েছে শত শত মানুষ। নিরুপায় হয়ে কেউ পিকআপ বা ট্রাকে, কেউ বাইকে আবার কেউ প্রাইভেট কারে ছুটে চলেছেন গন্তব্যে। পরিবহন চালক-হেলপারের ক্ষোভের বলী সাধারণ যাত্রীরা ভোগান্তি আর দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে ধর্মঘটের প্রথম দিন অতিবাহিত করলেন। এতে করে তাদের সঙ্গে বাকবিতন্ডার ঘটনাও ঘটছে অহরহ। পরিবহন সংকট ও বাড়তি ভাড়ার খপ্পরে পড়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নিরুপায় যাত্রীরা। সাধারণ যাত্রীরা বলছেন, তেলের দাম বাড়ার কারণে সব গাড়ি বন্ধ, আর এই সুযোগে রিঙা, সিএনজি টেঙির ড্রাইভাররা আমাদের কাছে ন্যায্য ভাড়ার চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি নিচ্ছে। আমাদের সবদিকেই বিপদ; সময়, টাকা সবকিছুই বেশি লাগছে। শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় গণপরিবহন বন্ধের প্রভাব জোরালোভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে না। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা থাকায় নগরী থেকে হাটহাজারী সড়কে কিছু গাড়ি চলাচল করতে দেখা গেছে।
নগরীর ঈদগাঁ কাঁচা রাস্তা এলাকার বাসিন্দা একরাম হোসেন আজাদীকে বলেন, ঈদগাঁ থেকে অলংকার ভাড়া নেয় ৮ টাকা। আজ ভাড়া নিয়েছে ১০ টাকা। এভাবে জ্বালানি তেলের দাম হঠাৎ করে বাড়িয়ে সাধারণ মানুষকে কষ্ট দেয়ার কোনো মানেই হয় না।
পরিবার নিয়ে গ্রামের বাড়ি মীরসরাইয়ের বারৈয়ারহাট যেতে চান সোহরাব হোসাইন। তিনি বলেন, গ্রামের বাড়িতে আমার আম্মা খুব অসুস্থ। ভোরে হঠাৎ খবর আসায় পরিবার নিয়ে বাড়ি যেতে হচ্ছে। কিন্তু কোনো গাড়ি পাচ্ছি না। আর প্রাইভেট কার যে ভাড়া দাবি করছে সেটা আমার পোষাবে না। এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা করতে পারিনি।
আগ্রাবাদের বাসিন্দা মেরাজুল হক বলেন, জরুরি কাজে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার জন্য বের হয়ে গণপরিবহন না পেয়ে বিপাকে পড়তে হয়েছে। রিকশা নিয়ে পথের দূরত্ব কমাতে হচ্ছে। এভাবে জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষকে কষ্ট দেওয়ার কোনও অর্থ নেই।
বেসরকারি চাকরিজীবী মোহাম্মদ নাসির বলেন, আমাকে জরুরি প্রয়োজনে কুমিল্লা যেতে হবে। ৪০ মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে থেকেও কোনো বাস পাইনি। প্রাইভেটকারগুলো জন প্রতি হাজার টাকা দাবি করছে। এটা তো আমাদের মত সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব না।
নগরীর একে খান এলাকার শ্যামলী, সৌদিয়াসহ বিভিন্ন দূরপাল্লার বাস কাউন্টারে খবর নিয়ে জানা গেছে, সকাল থেকে চট্টগ্রাম ছেড়ে ঢাকার উদ্দেশে ৬টি বাস যাওয়ার কথা থাকলেও সবগুলো বাতিল করা হয়েছে। পরিবহন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তও দিয়েছে বাস কর্তৃপক্ষ। তবে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের কর্মবিরতির মধ্যেও নগর জুড়ে চলছে সোনার বাংলা ও মেট্রো প্রভাতী। গুটি কয়েক লোকাল বাস চলতে দেখা গেছে। তবে বরাবরের মতো বাড়তি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ তো আছেই।
বাস ড্রাইভার মো. বারিউল ইসলাম, জিল্লুর রহমান, কবির হোসেন বলেন, হঠাৎ তেলের দাম বৃদ্ধি হওয়ায় শুধু যাত্রীরা নয়, আমরাও বিপাকে পড়েছি। এখন এমনিতেই ব্যবসা নাই; আগে তেলের দাম যত টাকা ছিল, তখনই চলতে পারতাম না। এখন সরকারের কাছে আকুল আবেদন আগের মতই যেন তেলের দাম স্বাভাবিক করে দেয়। মেহেদী নামে এক বাস হেলপার বলেন, বুধবার রাতে হঠাৎ করে ডিজেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। আগের ভাড়ায় গাড়ি চালালে দিন শেষে গাড়ির মালিকের ইনকাম আর নিজের বেতন তুলতে হিমশিম খেতে হবে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন চট্টগ্রাম আঞ্চলিক শাখার সভাপতি মো. মুছা আজাদীকে বলেন, এটা আমাদের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত। সরকারের কাছ থেকে কোনো সিদ্ধান্ত না আসা পর্যন্ত কর্মবিরতি চলবে। তবে আমরা আগেও বলেছি, কেউ যদি ব্যক্তিগত উদ্যোগে লোকাল বাস বের করে চালাতে চায় এ ব্যাপারে আমাদের সাংগঠনিক কোনো বাধা নেই। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম নগরী, উত্তর, দক্ষিণ সব এলাকার মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলো সম্মিলিতভাবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। চট্টগ্রাম, কঙবাজার ও তিন পার্বত্য জেলার অভ্যন্তরীণ সব রুটে বাস চলাচল বন্ধ আছে। চট্টগ্রাম শহরে ১৫টি রুটে বাস, ১৭টি রুটে হিউম্যান হলার এবং ২১টি রুটে অটোটেম্পু বন্ধ আছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে চলাচলকারী ৬৮ রুটের বাসও বন্ধ আছে। এছাড়া উপজেলা ও আঞ্চলিক রুটের বাসও চলছে না। ডিজেলের দাম বাড়ানোর কারণে পরিবহন ভাড়া বাড়বে। যাত্রীরা ভোগান্তিতে পড়ুক-এটা আমরা চাই না। এটি কোনো ঘোষিত ধর্মঘট নয়। শ্রমিকরাও বাস বন্ধ করেননি। এটি মালিকপক্ষের সিদ্ধান্ত। মালিকরা বলছেন, হঠাৎ করে যেভাবে ডিজেলের দাম বাড়ানো হয়েছে, তাতে খরচ এত বেড়েছে যে, বিদ্যমান ভাড়ায় তারা আর গাড়ি চালাতে পারবেন না। তাদের লস হবে। ডিজেলের দাম বাড়ার পর প্রতিটি বাসে দৈনিক ৯০০ টাকা থেকে এক হাজার টাকা খরচ বেড়ে গেছে। আমরা কীভাবে গাড়ি চালাব?
আন্তঃজেলা মালামাল পরিবহন সংস্থা ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক তকিউর রহমান টিপু বলেন, বিচ্ছিন্নভাবে কিছু ট্রাক-কাভার্ডভ্যান চলছে। যেগুলো আগে মাল নিয়ে ফেলেছে, জরুরিভাবে পৌঁছাতে হবে সেগুলো চলছে। এর বাইরে বাকি সব বন্ধ আছে।












