মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আসার আগে পেশাগত কারণে আমি বেশ কয়েক বছর সংযুক্ত আরব আমিরাত ছিলাম। সে হিসেবে অনেকটা সময় ধরেই দেশের বাইরের সঙ্গে সংযুক্ত। অনেকেই বলেন বিদেশে আসার পর প্রথম একটা বছরটা নাকি অনেক কঠিন, কারণ এই সময়টায় কষ্ট সবচেয়ে বেশি লাগে, সবচেয়ে বেশি সংগ্রাম করতে হয়, নতুন পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে অনেক সংগ্রাম করতে হয়। দেশের জন্য, পরিবারের সদস্যদের জন্য, আপনজনদের জন্য, বন্ধু বান্ধব, চেনা মানুষ, চেনা পরিবেশের জন্য মনটা কাঁদে। এই অনুভূতিটা আসলে কেবলমাত্র একজন প্রবাসীর পক্ষেই অনুভব করা সম্ভব। তবে এক বছর পর আস্তে আস্তে সব সহ্য হয়ে যায়, নতুন জায়গা নতুন পরিবেশ আর নতুন মানুষদের সাথে একটা সখ্যতা গড়ে উঠে। কিন্তু আমি এতোটা সময় বিদেশে থেকেও এখনো পর্যন্ত দেশের জন্য, পরিবারের সদস্যদের জন্য, আপনজনদের জন্য, বন্ধু বান্ধব, চেনা মানুষ, চেনা পরিবেশের জন্য বুকের মধ্যে অদ্ভুত এক হাহাকার করে ওঠে। সম্ভবতঃ আমি একটু গ্রাম্য এবং ক্ষ্যাত ধরনের বলেই মনে হয় এরকমটা লাগে। যেহেতু একসময় সংযুক্ত আরব আমিরাতে ছিলাম, তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এসে নিজে গাড়ি চালাতে তেমন একটা বেগ পেতে হয়নি। মোটামুটি সবকিছু একই রকমের, কেবল কয়েকটা জিনিস বাদে। পোশাকের বিষয়টা তো অবশ্যই অনেক বড়ো একটা পার্থক্য। যদিও মধ্যপ্রাচ্যে বিশেষতঃ সংযুক্ত আরব আমিরাতে বেশ ভালো সংখ্যায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ক্যানাডা এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মানুষেরা কর্মরত আছেন। আমাদের অঞ্চলের সাথে অল্প কয়েকটা অমিল ছাড়া বাদবাকি সব কিছুই মোটামুটি একই রকম। আমরা অনেকেই জানি যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পতাকায় ৫০টা তারা আছে। আমেরিকান পতাকার এই ৫০টা তারা আমেরিকার ৫০টা স্টেটকে রিপ্রেজেন্ট করে। প্রত্যেকটি স্টেটের আবার আলাদা আলাদা রাজধানী আছে। আমি বর্তমানে আছি ফ্লোরিডাতে যার রাজধানী হচ্ছে টালাহাসি/ঠালাহাসি। মোট জনসংখ্যার বিশাল অংশই হচ্ছে কিউবান অভিবাসী যাদের বেশিরভাগই দীর্ঘ সময় ধরে এই দেশে থাকার পরেও ইংরেজিতে একটা দুইটা বাক্য ছাড়া আর কিছুই জানে না। ফ্লোরিডা রিপাবলিকানদের শক্তিশালী ঘাঁটি, অসম্ভব রকমের সুন্দর এবং মনোমুগ্ধকর একটা জায়গা। বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত এবং আকর্ষণীয় সব সমুদ্র সৈকত, ডিজনী ওয়ার্ল্ড, ইউনিভার্সাল স্টুডিও, ঘঅঝঅ এর লাঞ্চিং প্যাড ছাড়াও অনেক বিশ্বখ্যাত স্থাপনা, প্রচুর গাছপালা, বড়ো বড়ো পার্ক, উদ্যান আর পরিস্কার পরিচ্ছন্ন, ঝকঝকে তকতকে রাস্তাঘাট। সাউথ বীচ, নেপলস্, ওয়েস্ট পাম বীচের বাড়িগুলো অসম্ভব রকমের বিলাসবহুল এবং দামি। বেশিরভাগ বাড়িঘরই দোতলা কিংবা একতলা। অনেক বাসাতেই বেইজমেন্ট থাকে। সবাই মোটামুটি আইনকানুন মেনে চলেন। অকারণে হর্ন দেন না। রাতের ২টা ৩টা বাজে রাস্তা সম্পূর্ণ ফাঁকা থাকলেও রেড লাইটে কেউ গাড়ি টান দিয়ে চলে যান না, অপেক্ষা করেন সবুজ লাইটের জন্য। নির্দিষ্ট জায়গা ছাড়া মানুষজন যদি রাস্তা পার হয় এবং পুলিশ যদি দেখতে পারে তবে ডাক দিয়ে এনে হাতে টিকেট (জরিমানা) ধরিয়ে দিয়ে যাবে। ফ্লোরিডার রাস্তাগুলো অন্যান্য স্টেটের তুলনায় বেশ বড়ো। তবে কাজের শুরু এবং কাজ শেষে বাড়ি ফেরার সময়টুকু ছাড়া রাস্তাঘাটে মানুষজন তেমন একটা নেই বললেই চলে। কিছুদুর পর পরই লেক। ফ্লোরিডার পুরোটাই যেন পানির উপর ভেসে রয়েছে। ফ্লোরিডা আসার পর প্রথমবার সবচেয়ে অবাক হয়েছিলাম এখানকার আবহাওয়া দেখে। এ যেন দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে সম্পূর্ণ আরেক টুকরো বাংলাদেশে। প্রচন্ড গরম থাকে সব সময়। ঘেমে নেয়ে পুরোই একাকার অবস্থা হতে হয়। কিছু বাংলাদেশীদের বাসায় গিয়ে দেখি তাঁরা পুরো বাংলাদেশী স্টাইলে পুঁই শাক, লাল শাক, লাউ, মিষ্টি কুমড়ো, কচু, পেয়ারা, আম, জাম, পেপে গাছ লাগিয়ে রেখেছেন। আবার কি সুন্দর সুন্দর ফল ধরেছে তাতে। আছে অসংখ্য কৃষ্ণচূড়া আর জারুল গাছ। কৃষ্ণচূড়া ফুল ফোটার সময় চারপাশটা লাল আগুনরঙা হয়ে থাকে। আর দেখতে পাবেন পাম গাছ। সৌদি আরবের মত সব জায়গায় খালি পাম গাছ আর পাম গাছ। সময়ের সাথে সাথে এই নগরীতে সারি সারি পাম গাছগুলোও বেড়ে ওঠে, কৃষ্ণচূড়া আর জারুল গাছে ফুল ফোটে এবং বেলাশেষে ঝরেও যায়। আর এর মধ্যেই বদলাতে থাকে বহু বর্ণের, বহু গোত্রের, বহু ধর্মের, বহু জাতির, বহু সংস্কৃতির সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা এ বর্ণিল নগরীর ঘড়ির কাঁটা, ক্যালেন্ডারের পাতা। এদের মধ্যে আছেন অনেক অনেকদিন আগে দু চোখ ভরা স্বপ্ন আর নতুন দিনের আশায় নিজের মাটি, নিজের শিকড়, অতি চেনা, অতি পরিচিত জগত ছেড়ে সম্পূর্ণ অজানা, অচেনা, অপরিচিত একটা ঠিকানায় জীবন যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া অনেক অনেক বাংলাদেশী পরিবারও। তাদের মধ্যে কোনো এক নিঃসঙ্গ প্রবীণের কোনো এক শুক্রবার রাতে দু’চোখ জুড়ে গোপনে গড়িয়ে পরে বুকের গহীন থেকে তৈরি হওয়া নিঃশব্দ কান্না। আস্তে আস্তে বিছানা ছেড়ে গভীর রাতের নিস্তব্ধতা গায়ে মেখে বাড়ির কাছের পার্কটির এক্কেবারে কোণার দিকে একটা বেঞ্চে গিয়ে বসেন। বেশ কিছু কিউবান, জ্যামাইকান, মেক্সিকান ছাড়াও ল্যাটিন আমেরিকার আরও বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন বয়সের মানুষেরা হৈ–হুল্লোরে, আনন্দে উল্লাসে মেতে আছে, আগুন জ্বালিয়ে বার বি কিউ পার্টি করছে। এই উৎসব মূখর, কলকাকলী মুখর মুখগুলোর মাঝে কেনো যেন তাঁর নিজেকে বড় বেশী বেমানান ঠেকল। কেনো যেন ওদের জীবনকে খানিকটা ঈর্ষাও হলো হঠাৎ। তারা ভরা রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে অনেকদিন পর নিজের মায়ের নাম ধরে ডুকড়ে কেঁদে ওঠেন তিনি। জানেন না কেমন আছেন তার আম্মা। আজ কতোদিন হয়ে গেল মায়ের ঘর্মাক্ত, ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত অথচ স্নিগ্ধ মুখটা দেখেন না। তার কাছে তো ঘর মানেই যে মা, মা মানেই যে ঠিকানা। কতোদিন হয়ে গেলো আম্মার হাতের সেই কাঁঠালের বিচি দিয়ে শুটকি, ইচা মাছের বড়া, সুরমা মাছ ভাজি অথবা আদার ফুলের ভর্তা খাওয়া হয় না। ভাবেন, “আচ্ছা, আমি খেতে পাই না বলে আম্মা কি এখন আমার পছন্দের এইসব খাবার রান্না বন্ধ করে দিয়েছেন? আমাকে খাওয়াতে পারেন না বলে কি শুক্রবার দুপুরে ভালো–মন্দ রান্না করাই বন্ধ করে দিয়েছেন?” আর এভাবেই দিন যায়, নতুন দিন আসে। সন্ধ্যা নামে, সন্ধ্যামালতির গন্ধহীন রাতের শেষে ভোর হয়।
লেখক : প্রাবন্ধিক