চারটি বিভাগীয় শহরসহ সারাদেশে ৯টি নতুন সরকারি মাধ্যমিক স্কুল স্থাপন প্রকল্পের আওতায় দুটি স্কুল পাচ্ছে চট্টগ্রাম। স্কুল দুটি স্থাপন হবে চট্টগ্রাম মহানগরেই। দীর্ঘ সময় ধরে অনেক খোঁজাখুঁজির পর অবশেষে পতেঙ্গা এলাকাতেই নতুন স্কুল দুটির জন্য জমি চিহ্নিত হয়েছে। প্রস্তাবিত দুটি স্কুলের স্থান হিসেবে একটি উত্তর পতেঙ্গা এলাকায় এবং অপরটি পূর্ব পতেঙ্গা এলাকা নির্বাচন করা হয়েছে। প্রস্তাবিত এই দুটি স্থানের মধ্যকার দূরত্ব বড় জোর ৩ থেকে ৪ কিলোমিটার বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।
অর্থাৎ সব ঠিক থাকলে পতেঙ্গা এলাকাতেই সরকারি নতুন দুটি স্কুল স্থাপন হবে। যদিও কাছাকাছি বা একই এলাকায় দুটি স্কুল স্থাপনের চাইতে অপরিহার্যতা বিবেচনায় নিয়ে যৌক্তিক দূরত্বে স্থাপন করা হলে চট্টগ্রামবাসী উপকৃত হবে বলে মনে করেন শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা। চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর শাহেদা ইসলাম মনে করেন, যেহেতু দীর্ঘ সময় পর চট্টগ্রাম শহরে দুটি নতুন স্কুল হচ্ছে, সেহেতু চাহিদা ও অপরিহার্যতাসহ সব দিক বিবেচনায় নিয়েই স্থান নির্বাচন করা উচিত। দুটি স্কুল শহরের দুই প্রান্তে অর্থাৎ পতেঙ্গা এলাকায় একটি হলে অপরটি চান্দগাঁও, মোহরা বা অক্সিজেন এলাকায় স্থাপন করতে পারলে সবচেয়ে বেশি ভালো হয়। তবে অনেক চেষ্টা করেও অক্সিজেন বা মোহরা এলাকায় জমি সংস্থান করা যায়নি বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াস হোসেন। জেলা প্রশাসক বলেন, আমরা অনেক খুঁজেছি। কিন্তু উপযুক্ত জমি পাইনি। অনেক চেষ্টায় শেষ পর্যন্ত পতেঙ্গার দিকে জমি খুঁজে পেয়েছি। তবে একটি পতেঙ্গা এলাকায় হলেও অপর একটি স্কুলের প্রস্তাবিত স্থান হালিশহর এলাকায় ধরে নেয়া যায় বলেও জানান তিনি।
জেলাপ্রশাসন সূত্রে জানা গেছে- প্রস্তাবিত দুটি স্কুলের জন্য পতেঙ্গা থানাধীন পূর্ব পতেঙ্গা মৌজায় একটি এবং অপরটি উত্তর পতেঙ্গা মৌজা এলাকায় স্থান নির্বাচন করা হয়েছে। এর মধ্যে উত্তর পতেঙ্গা মৌজায় প্রস্তাবিত স্কুলের জন্য দুই একর জমি পাওয়া গেলেও পূর্ব পতেঙ্গা এলাকার স্কুলটির জন্য জমি মিলেছে প্রায় এক একর। উত্তর পতেঙ্গা মৌজা এলাকায় প্রস্তাবিত স্কুলটির জন্য নির্বাচন করা জমি অধিগ্রহণের জন্য এরইমধ্যে ভূমি মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে জেলাপ্রশাসন। এ তথ্য নিশ্চিত করে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এল এ) আবু হাসান সিদ্দিক আজাদীকে বলেন, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পেলে স্কুলটির জন্য প্রস্তাবিত ভূমি অধিগ্রহনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। যদিও সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের অনাপত্তিসহ আরো বেশ কিছু প্রক্রিয়া বাকি রয়েছে পূর্ব পতেঙ্গা এলাকায় প্রস্তাবিত স্কুলটির জমির ক্ষেত্রে।
এদিকে প্রস্তাবিত স্কুল দুটি চট্টগ্রাম শাহ-আমানত বিমানবন্দরের কাছাকাছি এলাকায় হওয়ায় ভূমি ব্যবহারের সম্মতির পাশাপাশি বহুতল স্থাপনা নির্মাণের ক্ষেত্রেও সিভিল এভিয়েশনের অনাপত্তি নিতে হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
মাউশির (মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর) নতুন এই স্কুল স্থাপন প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে রয়েছেন রায়হানা তসলিম। তিনি আজাদীকে বলেন, প্রথমে একটি স্কুলের জন্য জমি নির্বাচন করা গেলেও অপরটির জন্য জমি পাওয়া যাচ্ছিল না। ২য় স্কুলের জন্য শেষ পর্যন্ত পতেঙ্গা এলাকাতেই জমি চিহ্নিত করা হয়েছে। অনেক চেষ্টা করে জেলাপ্রশাসন এ জমি খুঁজে দিয়েছে। যদিও প্রয়োজনের তুলনায় সেখানে জমির পরিমাণও কম। এরপরও মন্ত্রণালয় সেটি অনুমোদন দিয়েছে। কিন্তু নতুন করে আবার জমি খোঁজা বা নতুন এলাকা নিয়ে ভাবতে গেলে স্কুলই হয়তো অনিশ্চয়তায় পড়বে। প্রকল্প থেকেও বাদ দিতে হতে পারে।
প্রসঙ্গত, সারাদেশে ৯টি নতুন সরকারি মাধ্যমিক স্কুল স্থাপনের এই প্রকল্প হাতে নেয় মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর (মাউশি)। ৪৩৫ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সময়সীমা ধরা হয়েছে ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত। প্রকল্পটি ইতোমধ্যে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় চট্টগ্রাম মহানগরে নতুন দুটি স্কুল স্থাপন প্রক্রিয়া এখন চলমান।
মাউশি সূত্রে জানা গেছে, মোট ৯টি স্কুলের মধ্যে চট্টগ্রাম মহানগরে ২টি ছাড়াও রাজশাহীর বিভাগীয় শহরে ২টি ও জয়পুরহাটে ১টি, রংপুরে ২টি, ময়মনসিংহে ১টি ও সিলেট বিভাগের শ্রীমঙ্গলের চা বাগান এলাকায় ১টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হচ্ছে। এসব বিদ্যালয়ে থাকবে আধুনিক ভৌত অবকাঠামো সুবিধা ও যুগপোযোগী শিক্ষা সামগ্রী। বিভাগীয় শহরের ৭টি স্কুল হবে ১০ তলাবিশিষ্ট এবং জেলা-উপজেলা শহরের ২টি হবে ৬ তলাবিশিষ্ট। এসব স্কুলে পর্যাপ্ত সংখ্যক শ্রেণিকক্ষের পাশাপাশি আইসিটি ল্যাব, বিজ্ঞানাগার, লাইব্রেরি, মাল্টিপারপাস হল রুম, প্রধান শিক্ষকের কক্ষ, সহকারী প্রধান শিক্ষকের কক্ষ, অফিস কক্ষ, শিক্ষক কমনরুম, নামাজের ঘর, দর্শনার্থী কক্ষ, বিএনসিসি, গার্লস গাইড কক্ষ, প্রাথমিক চিকিৎসা কক্ষ, মিড ডে মিল কক্ষ ও সেমিনার কক্ষ থাকবে। এছাড়া ইন্টানেট সুবিধাসহ ল্যাপটপ, কম্পিউটার ও কম্পিউটার সামগ্রী, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর, বই-পুস্তক, খেলাধুলার সরঞ্জাম, বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ও আসবাবপত্রও থাকবে।
মাউশির তথ্য অনুযায়ী- চট্টগ্রাম মহানগরে প্রস্তাবিত দুটি স্কুলের প্রতিটির জন্য মহানগরের অভ্যন্তরেই ন্যূনতম ২ একর করে জমি প্রয়োজন। কিন্তু একটির জন্য জমি চিহ্নিত হলেও দীর্ঘ চেষ্টার পরও অপর একটির জন্য জমি পাওয়া যাচ্ছিল না চট্টগ্রাম মহানগরে। শেষ পর্যন্ত একটি স্কুলের জমি নির্বাচন ছাড়াই প্রকল্পটির ডিপিপি (ডিটেইল প্রজেক্ট প্রোফাইল) সাবমিট করা হয়। অনেক খোঁজাখুঁিজর পরও মহানগরে ২ একর জমি বের করতে না পারায় অনেকটা হাল ছেড়ে দেন মাউশি চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয়ের কর্মকর্তারাও। মাউশির তৎকালীন আঞ্চলিক পরিচালক (বর্তমানে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান) প্রফেসর প্রদীপ চক্রবর্তী ওই সময় আজাদীকে বলেন- অন্য এলাকার পাশাপাশি অক্সিজেন ও মোহরা এলাকায় বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে জমি খোঁজা হয়েছে। কিন্তু জমির সংস্থান হয়নি। জমির সংস্থান না হওয়ায় প্রস্তাবিত দুটি স্কুলের একটি হারানোর শঙ্কা দেখা দেয়। এ নিয়ে ২০১৮ সালের ১৫ ডিসেম্বর দৈনিক আজাদীর প্রথম পাতায় ‘জমির অভাবে নতুন স্কুল পেয়েও হারাবে চট্টগ্রাম?’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। মহানগরে কোনো ভাবেই জমির সংস্থান না হলে সরকার প্রস্তাবিত স্কুল চট্টগ্রাম থেকে অন্যত্র (অন্য কোন বিভাগীয় শহর বা জেলায়) সরিয়ে নিতে পারে মর্মে আশঙ্কার কথা তুলে ধরা হয় প্রতিবেদনে।
ওই সময় তত্ত্ববধায়ক সরকারের সাবেক শিক্ষা ও বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান আজাদীকে বলেন- চট্টগ্রাম মহানগরে জমি পাওয়াটা কঠিন সেটা ঠিক। কিন্তু আমাদের প্রয়োজনের বিষয়টি অগ্রাধিকার দেয়া উচিত। একই সাথে ২ একর জমি কিনতে পাওয়া না গেলেও বিকল্প উপায়ের কথা ভাবতে হবে। যেমন সরকারি জমি হয়তো কারো দখলে আছে, সেটাও দেখা যেতে পারে। আবার (সরকারি জমি) নিম্মমানের কোন কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে, তাও দেখা যেতে পারে। মোটকথা, হাল ছেড়ে দেয়াটা সমাধান না। সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো এ বিষয়ে আরো আন্তরিক হলে, আরো বেশি সচেষ্ট হলে জমি বের করাটা খুব কঠিন কিছু বলে মনে করেন না ড. হোসেন জিল্লুর রহমান।
পরবর্তীতে চট্টগ্রাম মহানহরে একই সাথে দুই একরের স্থলে আরো কম পরিমাণ জমিতেও নতুন স্কুল স্থাপনে অনুমোদন দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এর প্রেক্ষিতে ২য় স্কুলটির জন্য পতেঙ্গা এলাকাতেই প্রায় এক একর জমি চিহ্নিত করে চট্টগ্রাম জেলাপ্রশাসন। এতে করে প্রস্তাবিত নতুন দুটি স্কুলই শহরের এক পাশে (পতেঙ্গা এলাকায়) স্থাপনের প্রক্রিয়া এগিয়ে চলছে।