পতেঙ্গা কন্টেনার টার্মিনালে বিদেশি অপারেটরের কার্যক্রম শুরু

বার্থিং নিল জাহাজ ২২ বছর এটি পরিচালনা করবে সৌদি কোম্পানি

হাসান আকবর | মঙ্গলবার , ১১ জুন, ২০২৪ at ৭:১৪ পূর্বাহ্ণ

দেশের ইতিহাসে প্রথম বারের মতো বিদেশি অপারেটরের মাধ্যমে শুরু হলো চট্টগ্রাম বন্দরের পতেঙ্গা কন্টেনার টার্মিনালের যাত্রা। গতকাল দুপুরে সিঙ্গাপুরের পতাকাবাহী ‘এমভি মায়ের্সক দাভাও’ নামের একটি কন্টেনার জাহাজের হ্যান্ডলিং কার্যক্রম শুরুর মধ্য দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের নয়া পথের এই যাত্রা শুরু হলো। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে চুক্তি অনুযায়ী হিস্যা দিয়ে সৌদি আরবের রাজ পরিবারের মালিকানাধীন রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল বাংলাদেশ লিমিটেড আগামী ২২ বছর পিসিটি পরিচালনা করবে। এই টার্মিনালটিতে বছরে প্রায় ৫ লাখ টিইইউএস কন্টেনার হ্যান্ডলিং করা যাবে।

প্রথম দিনে বার্থিং নেয়া এমভি মায়ের্সক দাভাও জাহাজে শুধু রপ্তানি পণ্য বোঝাই কন্টেনার জাহাজীকরণ করা হবে। সেইসাথে নেয়া হবে কিছু খালি (এমটি) কন্টেনার। কী গ্যান্ট্রি ক্রেন স্থাপিত না হওয়ায় আগামী কয়েক মাস জাহাজের ক্রেন দিয়েই কন্টেনার হ্যান্ডলিং করা হবে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং কাস্টমস থেকে অনুমতি দিলেও গতকাল আমদানি পণ্যবাহী কোনো কন্টেনার নামানো হয়নি। কিছু কারিগরি সীমাবদ্ধতার কারণে আপাতত জাহাজ থেকে আমদানি কন্টেনার নামানো হয়নি বলে সূত্র জানিয়েছে। কবে নাগাদ আমদানি কন্টেনার খালাসসহ পুরো কার্যক্রম শুরু করা যাবে সে সম্পর্কে নিশ্চিত করে কেউ কিছু বলতে পারেননি।

১৪শ টিইইউএস কন্টেনার জাহাজীকরণ করতে আজ রাত পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। কন্টেনার বোঝাই শেষ হওয়ার পর কর্ণফুলী নদীতে জোয়ার থাকলে জাহাজটি আজ পিসিটি ছেড়ে যাবে। না হয় কাল সকালের জোয়ারের জন্য অপেক্ষা করবে।

ড্যানিশভিত্তিক বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ শিপিং কোম্পানি মায়ের্সক লাইনের মালিকানাধীন এমভি মায়ের্সক দাভাও জাহাজটি গত ৯ জুন প্রথমে বন্দরের জিসিবি৯ নম্বর জেটিতে ভিড়ে। সেখানে আমদানি কন্টেনার নামিয়ে ১০ জুন পিসিটিতে ভিড়ে। এখানে রপ্তানি পণ্য বোঝাই এবং খালি কন্টেনার মিলে ১৪শ টিইইউএস কন্টেনার জাহাজীকরণ করে জাহাজটি পোর্ট কেলাং এর উদ্দেশ্যে যাত্রা করবে।

মায়ের্কস লাইনের ইন্ট্রা এশিয়া৭ রুটে চলাচলকারী জাহাজটি চীনের শান্তৌ পোর্ট থেকে পণ্য নিয়ে যাত্রা শুরু করে নানশা, ইয়াংতিয়ান, হংকং, মালয়েশিয়ার তানজুম পেলিপাস, পোর্ট কেলাং, চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে ইয়াংগুন হয়ে আবার পোর্ট কেলাং এর পথ ধরবে। এই সার্ভিসটির মাধ্যমে বিশ্বের কারখানাখ্যাত চীনের সাথে চট্টগ্রাম বন্দরের পণ্য পরিবহনে নয়া গতি সৃষ্টি করবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে।

পিসিটিতে জাহাজ ভেড়ানো উপলক্ষে গতকাল দুপুরে পিসিটি চত্বরেই চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং রেড সি গেইটওয়ে টার্মিনাল চট্টগ্রাম যৌথভাবে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়াল এডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল এবং রেড সি গেইটওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনাল (আরএসজিটিআই) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এরউইন হেইজ উপস্থিত ছিলেন।

অনুষ্ঠানে বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান বলেন, ল্যান্ডলর্ড প্রক্রিয়ায় বন্দর পরিচালিত হয় বিশ্বজুড়ে। আমরা পিসিটি দিয়ে সেই প্রক্রিয়া শুরু করে ইতিহাসের সাক্ষী হলাম। এ মুহূর্ত চট্টগ্রাম বন্দর ও বাংলাদেশের জন্য বিশেষভাবে স্মরণীয়। আশাকরি, এভাবে বিদেশি বড় পার্টনারদের সঙ্গে আমরা কাজ করবো। যাতে সার্বিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার অনেকগুণ বেড়ে যাবে। আমাদের অনেক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। নতুন প্রযুক্তি এখানে আসছে। আরও আসবে। প্রযুক্তিগতভাবে আমরা লাভবান হবো। এখানে কাজ করে আমাদের লোকজন দক্ষ হবে।

রেড সি গেইটওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনাল (আরএসজিটিআই) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এরউইন হেইজ বলেন, আমরা ক্যাপ্টেন মায়ো মিন থান এবং মায়ের্সক দাভাওকে আরএসজিটিচট্টগ্রামে স্বাগত জানাতে পেরে গর্বিত এবং এই নতুন কনসেশন চুক্তির অধীনে প্রথম আনুষ্ঠানিক জাহাজ আগমনের গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক উদযাপন করছি। আমরা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এবং বৈশ্বিক লজিস্টিক চেইনে চট্টগ্রাম বন্দরের ভূমিকা বাড়াতে অবদান রাখতে চাই। আমরা বাংলাদেশ সরকার, বন্দর কর্তৃপক্ষ, এনবিআর, কাস্টমস এবং আমাদের দীর্ঘসময়ের ব্যবসায়িক অংশীদার মায়ের্সকে ধন্যবাদ ও আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই। তারা আমাদের বাংলাদেশের শিপিং কমিউনিটি এবং বৈশ্বিক বন্দর শিল্পকে বিশ্বমানের সেবা দেওয়ার সুযোগ দিয়েছে।

উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ৮ সেপ্টেম্বর পিসিটি নির্মাণ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে। বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজস্ব তহবিল থেকে প্রায় ১ হাজার ২৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে পিসিটি নির্মাণ করে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নকশা অনুযায়ী সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের তত্ত্বাবধানে দেশীয় প্রতিষ্ঠান সাইফ পাওয়ারটেকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড এটির নির্মাণ কাজ করে।

২০২২ সালের মাঝামাঝি নির্মাণকাজ শেষ হলেও নানা কারণে চালু হয়নি এই টার্মিনাল। অবশেষে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের আওতায় সৌদি আরবের রেড সি গেটওয়ে লিমিটেডের সঙ্গে গত ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে চুক্তি সম্পাদনের পর তাদের এই টার্মিনালটি পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু কাজ শুরু করতেই ছয়মাস লাগলো।

পিসিটি টার্মিনালে মোট তিনটি কন্টেনার জাহাজ ভেড়ার জেটি আছে, যার দৈর্ঘ্য ৫৮৪ মিটার। এছাড়া ১টি ২০৪ মিটারের তেল খালাসের ডলফিন জেটি, ৮০ হাজার বর্গমিটার ইয়ার্ড নির্মিত হয়েছে। এই জেটি ২শ মিটার দীর্ঘ এবং ১০ মিটার গভীরতার জাহাজ ভিড়ানো যাবে। সব সরঞ্জাম সংগ্রহ করে পিসিটি পূর্ণ সক্ষমতায় যেতে আরও এক বছর সময় লাগতে পারে। শর্ত অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সব ইকুইপমেন্ট সংগ্রহ করবে রেড সি গেটওয়ে লিমিটেড। আর চুক্তিমতো চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ তাদের কাছ থেকে নির্দিষ্ট হারে চার্জ পাবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও জোরদারের আশাবাদ
পরবর্তী নিবন্ধআরসার শীর্ষ নেতা আকিজসহ গ্রেপ্তার ৫