বাজারটা আজ দখল নিয়েছে সিন্ডিকেট নামের দল, ফসল ফলায় কষ্টে কারা, কারা ভোগ করে ফল? বন্ধুবর অধ্যাপক নূরুল আলমের কবিতাংশ নিয়ে আজকের লেখাটি শুরু করতে চাই। কবিতার ভাবার্থ অত্যন্ত বাস্তবসম্মত। কেননা কৃষক চায় ন্যায্য মূল্য, ভোক্তা চায় কম মূল্য আর ব্যবসায়ী চায় বেশী মূল্য। এ তিন মূল্য সমন্বয় করে সকলকে সন্তুষ্ট করা বেশ চ্যালেঞ্জিং। সাম্প্রতিক সময়ে তরমুজ এর দাম নিয়ে ক্রেতা-বিক্রেতাদের মাঝে বাক-বিতন্ডা তাই প্রমাণ করে। কৃষক থেকে তরমুজ পিস হিসাবে কিনে কেজি দরে বেশী দামে বিক্রি করায় তার মূল কারণ। এ অসন্তোষ্টি দূরীকরণের জন্য মোবাইল কোর্ট পর্যন্ত বসাতে হয়েছে। তারপরও পুরোপুরি সুরাহা মিলছে না। প্রশ্ন আসতে পারে কেন এমনটি হচ্ছে? সহজ উত্তর ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফা অর্জনের জন্য এমনটি করছে। যদিও তারা হরেক-রকম যুক্তি দেখাচ্ছে। কার্যত এ যুক্তি অযৌক্তিক। কারণ কৃষক কর্তৃক প্রাপ্ত মূল্য আর খুচরা মূল্যের মধ্যে ফারাক বিস্তর। ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফা লাভের মানসিকতা থেকে এটা হচ্ছে। তাই ক্রেতাগণ সরকারের নিকট সহনীয় দাম নির্ধারণের দাবি উঠায়। দাবি উঠানোটা স্বাভাবিক। পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেওয়াটাই আধুনিক বাজার ব্যবস্থাপনার ধারণার মধ্যে পড়ে। এ জন্য মূল্য কমিশন গঠনেরও অনেকে প্রস্তাব করেন। মূলত ফড়িয়াদের দৌরাত্ন্য এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের যোগসাজসই কৃষক ন্যায্য মূল্য না পাওয়ার প্রধান কারণ।
বিদ্যমান বাজার ব্যবস্থায় একটি পণ্য উৎপাদিত হওয়ার পর কৃষক থেকে ফড়িয়া বা বেপারী বা পাইকারী ব্যবসায়ী সরাসরি ক্রয় করে থাকেন। ফড়িয়া বা বেপারী বা পাইকার এদেরকে মধ্যসত্বভোগী ব্যবসায়ীও বলা হয়ে থাকে। তারা ক্রয়কৃত পণ্যটি সরাসরি আড়তদারের নিকট বিক্রি করে থাকেন। আড়তদার লাভের উপর নির্দিষ্ট কমিশনে খুচরা বা পাইকারী ব্যবসায়ীদের নিকট পণ্য বিক্রয় করে থাকেন। খুচরা ব্যবসায়ীরা সরাসরি কৃষক বা ফড়িয়া, বেপারী ও পাইকারী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেও পণ্য কিনে থাকেন। কৃষক ছাড়া বাকী সব ব্যবসায়ীদের মাঝে একটি নিবিড় সম্পর্ক থাকে। অনেক ক্ষেত্রে সেটাকে যোগসাজস বা সিন্ডিকেট বলা হয়। মূলত খুচরা বাজারে দাম বৃ্দ্ধির অন্যতম কারণ হলো এই সিন্ডিকেট। আমাদের দেশের বেশীরভাগ কৃষক প্রান্তিক ও ছোট। ফসল উৎপাদনের জন্য তাদের নগদ টাকার প্রায় অভাব থাকে। ফলে বেশীর ভাগ কৃষক সুদে মহাজন থেকে ধার কর্জ করে ফসল ফলায়। কৃষকদের সংগঠন না থাকার কারণে বিছিন্নভাবে পণ্য বিক্রি করে থাকেন। ফলে দরকষাকষির ক্ষমতা হারায়। অনেক জায়গায় সংগঠন থাকলেও সেটা দূর্বল প্রকৃতির। অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা সংখ্যায় কম থাকলেও নিজেদের মধ্যে বুঝাপড়া থাকে। আর এ বুঝাপড়ার কারণে কৃষক তার চাহিদা মতো দাম হাকাতে পারে না। বেশীরভাগ কৃষি পণ্য যেহেতু পচনশীল তাই এটা বেশীদিন ধরে রাখাও যায় না। আবার ধরে রাখার মতো সংরক্ষনাগারের খুব অভাব। ফলে অনেকটা বাধ্য হয়ে তড়িঘড়ি করে অথবা আগাম পণ্য বিক্রি করে দেয়। ফলে ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়।
কৃষক তার পণ্যের ন্যয্যা দাম না পাওয়ার অন্য আর একটি কারণ হলো কৃষক ফসল উৎপাদনের জন্য যত না আন্তরিক তার চেয়ে বিক্রি করার ক্ষেত্রে অনেকটা উদাসীন। যেমন কষ্ট করে তারা বাজার যাচাই করে না। ব্যবসায়ীদের সাথেও পূর্বে থেকে তেমন যোগাযোগ রক্ষা করে না। আশেপাশের বাজারটাই তাদের জন্য শেষ সম্বল মনে করে। উৎপাদিত পণ্য পরিমানে কম হলে মাথায় নিয়ে নিকটস্থ হাটবাজারে বিক্রি করে। দেখা যায় অল্প পণ্য বিক্রি করার জন্য সারাদিন বসে থাকতে হয়। মৌসুমে যোগান বেশী থাকলে দামও কমে যায়। কিন্তুু অমৌসুমে উৎপাদিত পণ্যে ভালো দাম পায়। তাই কৃষকদের অমৌসুমী ফসল উৎপাদনের উপর বেশী জোর দিতে হবে। দুর্গম উৎপাদনস্থল, বিক্রেতা বেশী ক্রেতা কম, পরিবহন সংকট (বিশেষ করে পাহাড়ী এলাকায়), ভঙ্গুর রাস্তাঘাট এবং খারাপ মানের পণ্য এসবের কারণেও কৃষক ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়।
কৃষককদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে হলে প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকদের সরাসরি বাজারে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট এলাকা ভিত্তিক কৃষক সংগঠন তৈরী করে গ্রুপ মার্কেটিং এর মাধ্যমে করা যেতে পারে। তবে এ কাজটি করা কঠিন। কারণ কৃষক সংঘবদ্ধ থাকতে চায় না। অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা বেশ সংঘবদ্ধ। মাঠ পর্যায়ে কৃষি বিভাগের কর্মীরা উৎপাদনের পিছনে যে পরিমাণ শ্রম ও সময় ব্যয় করেন তার কিছুটা সময় যদি ফসল বিক্রয়ে সহায়তা করতে পারতো তবে কৃষক কিছুটা লাভবান হতো। যদিও বিপনন কাজটি করার দায়িত্ব বর্তায় কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের উপর। কিন্তু কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের সেট-আপ ইউনিয়ন বা উপজেলা পর্যায়ে নাই। আছে শুধু জেলা পর্যায়ে সীমিত জনবল নিয়ে। জেলা পর্যায়ে বাজার মনিটরিং করতেই তাদের হিমশিম খেতে হয়। ইউনিয়ন বা উপজেলা পর্যায়ে দেখবে কে? তাই উপজেলা পর্যায়ে কৃষি বিপণন কর্মকর্তার জনবল সহ একটা পূর্ণাঙ্গ সেট-আপ দরকার। সে পরিকল্পনাও সরকারের রয়েছে। ইতিমধ্যে মাননীয় কৃষি মন্ত্রী এ ব্যাপরে বেশ উৎসাহী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।
কৃষকদের ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য উৎপাদন খরচ কমানোর দিকে প্রথম নজর দেওয়া দরকার। সে সাথে ব্যবসায়ী আর কৃষকদের মাঝে যোগাযোগ স্থাপন করা প্রয়োজন। মধ্যস্বত্বভোগীদের সিন্ডিকেট ভঙ্গ করতে প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ দরকার। কৃষক- গবেষক- সম্প্রসারণ কর্মী-ব্যবসায়ীদের মধ্যে সংযোগ সাধন অতীব জরুরি। কৃষির বিভিন্ন প্রকল্পে কৃষক প্রশিক্ষণে স্থানীয় ব্যবসায়ীকে অন্তর্ভুক্ত করে আধুনিক বাজার ব্যবস্থাপনার উপর পাঠদান দেওয়া যেতে পারে। এতে কৃষক ও ব্যবসায়ী আধুনিক বাজারজাতকরণ সম্পর্কে সম্যাক ধারণা লাভ করবে। নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি হবে। ন্যায্য মূল্য নিশ্চিতের জন্য কৃষকের দরকষাকষির ক্ষমতা বাড়ানো, সংগঠন তৈরী ও শক্তিশালীকরণ, নেতৃত্বের উন্নয়ন, গ্রুপ বা সমবায়ভিত্তিক মার্কেটি এর মাধ্যমে পণ্য বিক্রি অভ্যস্তকরণ, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের বৃহৎ বাজারে প্রবেশাধিকার নিশ্চিতকরণ, মিডিয়াতে বাজার তথ্য সম্প্রচার, পণ্য পরিবহনকালীন চাঁদা বন্ধকরণ, অপচয় কমানো, প্রত্যন্ত অঞ্চলে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নতকরণ, ব্লক বা ইউনিয়ন পর্যায়ে পর্যাপ্ত কালেকশন সেন্টার স্থাপন, ইউনিয়ন পর্যায়ে কৃষি ও বিপণন সেবা চালুকরণ, উপজেলা পর্যায়ে সংরক্ষণাগার বা প্যাক-হাউস স্থাপন এবং জেলা পর্যায়ে কৃষি পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা স্থাপন করা সময়ের দাবী। প্রক্রিয়াজাতকারীদের সাথে কনটাক্ট ফার্মিং এর মাধ্যমে চাহিদা ভিত্তিক পণ্য উৎপাদন করলে ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তি সহজ হয়।
কৃষকদের ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিতের জন্য সরকার নির্ধারিত মূল্যে ধান ও গম সংগ্রহ করে থাকেন। একইভাবে ভারতের কেরালা রাজ্যেও আনারস বিক্রির উপর রাজ্য সরকার কর্তৃক একটা নির্দিষ্ট দাম নির্ধারণ করে দেয়। ফলে ক্রেতা এবং বিক্রেতা উভয়েই সন্তুুষ্ট থাকতে দেখা যায়। সেখানে কেরালা পাইনএপল সিটি নামে একটি বৃহৎ আকার মার্কেট রয়েছে। সেখান থেকে পুরো ভারতসহ পাকিস্তানের বহু রাজ্যে আনারস সররবাহ করে থাকে।‘কেরালা পাইনএপল কৃষক সমবায় সমিতি’ নামে ১০০০ সদস্যের রেজিস্ট্রার্ড একটি শক্তিশালী কৃষক সংগঠন রয়েছে। সংগঠনকে শক্তিশালীকরণের পিছনে রাজ্য সরকারের যথেষ্ট পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে। শক্তিশালী কৃষক সংগঠনের মাধ্যমে ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিতকরণের তা একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে। আমাদের দেশেও কৃষক সংগঠন শক্তিশালীকরণের মধ্য দিয়ে ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করা যেতে পারে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ভাষায় কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে। সুতরাং কৃষক ফসলের ন্যায্য মূল্য পাক, এটাই হোক সবার অঙ্গীকার।
লেখক : ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও কৃষি অর্থনীতিবিদ, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সাবেক ন্যাশনাল কনসালটেন্ট, আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।