বই পড়া নিয়ে ওমর খৈয়াম বলেছিলেন, রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে প্রিয়ার কালো চোখ দুটি ঘোলাটে হয়ে আসবে কিন্তু বইখানা অনন্ত যৌবনা, যদি তেমন বই হয়। আমার কাছে মনে হয়, বই যদি অনন্ত যৌবনা হয় পাঠাগার হবে একটি বাতিঘর। ইশকুল বেলায় চট্টগ্রামের কালের সাক্ষী অমর বই ঘরে গিয়ে অর্ধেক মূল্যে পুরাতন বই সংগ্রহ করতাম। যখন কোনো পাঠাগার থেকে কিংবা বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে পড়ার জন্য বই সংগ্রহ করি তখন নিজের কাছে মনে হতো বই নয় যেন আনন্দমিশ্রিত আলো সংগ্রহ করছি। সেই বই নিজে পড়ে আবার ইশকুল বেলার সহপাঠীদের পড়তে দিতাম, ইশকুল বেলায় বই সংগ্রহ করে পড়ার মধ্যে একটা আনন্দ ছিল। স্মৃতির ঝাঁপিতে আজও গেঁথে আছে।
২০১৬ সালের কথা অমর একুশের বইমেলায় আমার লেখা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গ্রন্থ ‘একাত্তরের শহিদ ছবুর’ বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর ধামাচাপা পড়ে যাওয়া অধ্যায় সম্পর্কে জানল, ২২ বছরের তরুণ মুক্তিযোদ্ধা যিনি কি না যুদ্ধশেষে বাড়ি ফিরেনি, গাজী আবদুস ছবুর শহিদ হওয়ার ৪৮ বছর পেরিয়ে।
একদিন সহকর্মী ফটোগ্রাফার আরিফ বলল, ভাইয়া ৭১–র শহিদ ছবুর বইটির নাম দিয়ে একটি ফেসবুক গ্রুপ খোলেন। আমিও রাজি হয়ে গেলাম। খোলা হলো একাত্তরে শহিদ ছবুর ফেইস বুক গ্রুপ। গ্রুপে শহিদ ছবুরের আত্মজীবনীও তাঁর স্মৃতি বিজড়িত গ্রাম, ইশকুল, যেখানে শহিদ হয়েছিল প্রত্যেকটি জায়গার ছবি পোস্ট করতাম। গ্রুপটির নির্বাহী ছিলাম আমি। সদস্যদের মধ্যে আরিফ, আফরোজা সিদ্দিকা, তাজল্লী, বেলায়েত হোসেন হিরু ভাইসহ আরো অনেকে।
৭১–র শহিদ ছবুর ফেসবুক গ্রুপে বর্তমান সদস্য সংখ্যা গিয়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় দুই হাজারের কাছাকাছি। আমাদের একটা উদ্দেশ্য ছিল, মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস, স্মৃতি বর্তমান প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা।
ছোটোবেলায় গল্পে পড়েছি, ছবি দেখে উপলব্ধি করেছি কীভাবে এই সোনার বাংলাদেশটি আমরা পেয়েছি। লাল সবুজের পতাকার জন্য কত আত্মত্যাগ। একাত্তরের চেতনাকে হৃদয়ে লালন করা, মা মাটি ও মাতৃভূমির জন্য যারা আত্মত্যাগ করেছে তাঁদের স্মৃতি রক্ষার্থে মহৎ কিছু করা মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি সংরক্ষণ করা। সচেতনতামূলক কাজ, সমাজের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো এবং মানুষের মধ্যে বোধ সৃষ্টি করা। বিশেষ করে নিষ্পেষিত মানুষের প্রতি ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দেওয়া সামাজিক দায়বদ্ধতার জন্য কিছু করার লক্ষ্যে উদ্দেশ্য ছিল ৭১–র শহিদ ছবুর ফেসবুক গ্রুপের।
একদিন ভাবলাম, নিজভূমে শিশুদের জন্য কিছু একটা করতে হবে। পরিকল্পনা করলাম। পটিয়ায় শিশুতোষ পাঠাগার নেই। যে করে হোক পটিয়ায় একটি শিশুতোষ পাঠাগার স্থাপন করব।
জীবনের প্রথম পাঠ নেওয়া আমার বিদ্যাপীঠ আমার অহংকার, শহিদ ছবুর স্মৃতি বিজড়িত পটিয়া পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ডের, পশ্চিম পটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ইতিকথা জানতে গিয়ে দেখলাম, এই ইশকুলের প্রাক্তন ছাত্রদের মধ্যে ১১ জন ছিলেন একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের একজন হলেন শহিদ ছবুর।
একদিন সকালে ইশকুল পরিদর্শন করতে গিয়ে দেখলাম, একটা খালি কক্ষ পড়ে আছে। ইসকুলের পরিচালনা কমিটির সভাপতি আলহাজ সিরাজুল মোস্তবাকে পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনার কথা বললাম, তিনি সানন্দে রাজি হয়ে গেলেন। ইশকুলের প্রধান শিক্ষক শাহিনা ইয়াছমিন শিশুতোষ পাঠাগারের কথা শুনে খুশি হলেন তিনিও বেশ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে অনুপ্রেরণা দিলেন।
ইশকুল পরিচালনা কমিটির সভাপতিকে বললাম, বই এবং একটি বুক সেলফ আমি দিব। আপনি কক্ষটা রং করে সজ্জিত করেন। সভাপতি নিজ উদ্যোগে একটা বুক সেলফ তৈরি করে দিলেন। কক্ষটি রং করিয়ে দিলেন।
পাঠাগারের কথা টইটম্বুরের উপদেষ্টা প্রফেসর শিল্পী সবিহ্ উল আলম এবং ইতিহাসের খসড়ার সম্পাদক লেখক ও গবেষক শামসুল হককে বললাম তাঁরাও বই দিয়ে সহযোগিতা করলেন। ইশকুল বেলার অনেক সহাপাঠীরাও সহযোগিতার হাত বাড়ালেন। সবাই খুশি মনে অভিনন্দন জানালেন।
গত ২৮ মার্চ ২০১৯ সালে সকালটা ছিল অন্যরকম। সকালের সোনাঝরা কাঁচা মিষ্টি রোদের ঝলকানি। গাছে গাছে নতুন পাতা দেখে মনে হচ্ছে যেন চির সবুজ শাড়ি দুলছে। পশ্চিম পটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বসেছে চাঁদের হাট। সবাই যেন খুশিতে আত্মহারা স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর শহিদ ছবুর স্মৃতিবিজড়িত গ্রামে শহিদ ছবুর শিশুতোষ পাঠাগার প্রতিষ্ঠা হতে যাচ্ছে। শহিদ ছবুরের পরিবারকে সম্মাননার মধ্যে দিয়ে পাঠাগারের উদ্বোধক–ও প্রধান আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, চারুকলা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ দেশ বরেণ্য চিত্র শিল্পী–সবিহ্–উল আলম, শহিদ ছবুর শিশুতোষ পাঠগারে বর্তমানে ২ হাজারেরও বেশি শিশুতোষ বই রয়েছে। বড়দের জন্য রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ ও ইতিহাসভিত্তিক বেশ কিছু বই। নিয়মিত জাতীয় পত্রিকাও থাকে। প্রতিদিন বিদ্যালয়ের কোমলমতি শিশুরা বই নিয়ে যায়, বই পড়ে আবার ফেরত দেন। শহিদ ছবুর শিশুতোষ পাঠাগারের গ্রন্থাগারিক হিসেবে স্বপ্রণোদিত হয়ে কাজ করছেন সহকারী শিক্ষক তৈয়াবা খানম শিমু। ইশকুলের দুপুর ছুটিতে অনেক শিশুরা পাঠাগারে বেশ আনন্দের সাথে বই পড়েন।
খুব ভালো লাগছে, শিশুতোষ পাঠাগারটি করতে পেরে। বর্তমান প্রজন্মরা আজকাল মোবাইলে আসক্ত হয়ে পড়ছে। শিশুদের হাতে মোবাইল নয় বই তুলে দিন। যদি শিশুদের আলোকিত করতে চান বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই। কবি রবি ঠাকুর বলেছিলেন, মানুষ বই দিয়ে অতীত ভবিষ্যৎ এর মাঝে সাঁকো বেঁধে দিয়েছে। আনন্দের সাথে পাঠদানের জন্য পাঠাগারের প্রয়োজন। বই পড়া বইপ্রেমী করে তোলার অভ্যাস শিশুকাল থেকে গড়ে তুলতে হবে। এখন ফেব্রুয়ারি মাস আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মাস আপনিও চাইলে পারেন আপনার গ্রামের প্রাথমিক ইশকুলে কিংবা নিজ এলাকায় বাড়িতে নিজ উদ্যোগে শিশুতোষ পাঠাগার গড়তে পারেন। আজকের শিশুরা আগামীদিনের কান্ডারি শিশুরা এগিয়ে গেলে বাংলাদেশ একদিন এগিয়ে যাবে। নতুন ভোর আসবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক