‘পঙ্খিরাজকে’ থামাবে কে

নগরে আবার ব্যাটারি রিকশার দাপট যত্রতত্র দুর্ঘটনা, বিদ্যুতেও চাপ

আজাদী প্রতিবেদন | বুধবার , ৬ অক্টোবর, ২০২১ at ৫:২১ পূর্বাহ্ণ

বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা মাহবুব জামান গত সোমবার সকাল পৌনে দশটার দিকে দেওয়ানবাজার থেকে কর্মস্থল জুবিলী রোড যাচ্ছিলেন ব্যাটারি চালিত রিকশায় চড়ে। বিদ্যুৎ গতিতে ছুটতে থাকে রিকশা, প্যাডেল মারার প্রয়োজন পড়ছে না, চালক শিস দিতে দিতে ছুটছে- যেন পঙ্খিরাজ ঘোড়া। সাধারণ রিকশাগুলোকে পাশ কাটাতে কাটাতে তার উল্লাস দেখে কে? মাহবুব আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। চালককে অনুরোধ করেও লাভ হয়নি। যা হওয়ার তা-ই হল। চেরাগী পাহাড় মোড়ে এসে বাঁক ঘুরতে গিয়ে রিকশা উল্টে গেল। চোট পেলেন হাতে। রিকশাওয়ালাকে কিছু বলার আগেই সে আরো গরম- ব্যাটারি রিকশায় বসার নিয়মই নাকি তিনি জানেন না, নিজের দোষেই…। এটিই একমাত্র নয়, ব্যাটারি রিকশার গতি নিয়ন্ত্রণে অক্ষমতা, চালকদের অনভিজ্ঞতা এবং ওভারটেক প্রবণতার কারণে ব্যাটারি রিকশায় দুর্ঘটনা ঘটছে যত্রতত্র।
লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণায় অস্থির নগরবাসী। দিন নেই রাত নেই, যখন তখন লোডশেডিং কেড়ে নিচ্ছে কর্ম-চাঞ্চল্য। বিদ্যুৎ যতটুকু জুটছে, অবৈধ বিদুৎ সংযোগ তার একটি বড় অংশ কেড়ে নিচ্ছে। মরার উপর খাড়ার ঘাঁয়ের মতো অনুমোদনহীনভাবে নগরী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ব্যাটারি রিকশা। দিনকে দিন এর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। লকডাউনে অন্য যানবাহন চলাচলে কড়াকড়ির সুযোগে ব্যাটারি রিকশা আরো বেপরোয়া! সিএমপি কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীরের কড়া নির্দেশনার পরও নগরীর অলিগলিতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে চলাচল নিষিদ্ধ এ রিকশা।
সরেজমিনে গতকাল মঙ্গলবার দেখা যায়, নগরীর জামালখান, চেরাগী পাহাড়, আন্দরকিল্লা, জেল রোড, পাথরঘাটা, নিউমার্কেট, খাতুনগঞ্জ, আছদগঞ্জ, চাক্তাই, আসকার দীঘির পাড়, চকবাজার ডিসি রোড, বাদশা চেয়ারম্যান ঘাটা, বাকলিয়া সৈয়দ শাহ রোড, আবদুল লতিফ হাট, বহদ্দারহাট খাজা রোড, খতিবের হাট, মুরাদপুর-অঙিজেন রোড, বায়েজিদ বোস্তামী রোড, চান্দগাঁও সিএন্ডবি এলাকায় অবাধে ব্যাটারি রিকশা চলছে। প্রতিটি সড়কে গড়ে দশটি রিকসার মধ্যে অন্তত তিনটি রিকশা ব্যাটারি চালিত। নির্দিষ্ট কোনো গণ্ডি নেই, চলছে নিজেদের ইচ্ছেমত।
অনভিজ্ঞ এসব চালকের বেশিরভাগেরই দ্রুতগতি সম্পন্ন ব্যাটারি রিকসা চালানোর কোনো প্রশিক্ষণ নেই। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে কাজের সন্ধানে আসা হতদরিদ্র মানুষগুলো সহজ পেশা হিসেবে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচলে নেমে যাচ্ছে। প্যাডেল রিকশা চালানো কষ্টসাধ্য বলেই তারা দ্রুতগতির ব্যাটারি রিকশার দিকেই বেশি ঝুঁকছে। প্রাথমিক পর্যায়ে দরিদ্র প্রতিবন্ধীদের আয়ের উৎস হিসেবে এই সকল রিকশা চলতে দেওয়া হলেও বর্তমানে তা ব্যবহার করছে সকলে। এই যান চালাতে সহজ হওয়ায় অনেক সুস্থ মানুষ প্যাডেল চালিত রিকশা ছেড়ে বেছে নিচ্ছে এই রিকশা। অনেক যাত্রী সময় বাঁচাতে বা সাশ্রয়ী হওয়ায় ব্যাটারি রিকশা ব্যবহারে আগ্রহী হয়, আবার অনেকে এ ধরনের রিকশার বেপরোয়া গতি দেখে অনিচ্ছাও প্রকাশ করে।
তথ্য মতে, নগরীতে প্রতিদিন কমপক্ষে ১০ হাজার ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল করে। বৈদ্যুতিক মোটরচালিত এসব রিকশার প্রতিটির ব্যাটারি চার্জ দিতে দৈনিক খরচ হয় ৮ দশমিক ৭৫ ইউনিট করে বিদ্যুৎ। সে হিসেবে প্রতিদিন খরচ হয় ৮৭ হাজার ৫০০ ইউনিট বিদ্যুৎ। প্রতিদিন ৭০ টাকার বৈদ্যুতিক চার্জ দিতে হয় এসব রিকশায়। বিভিন্ন স্থানে রিকশার ব্যাটারি চার্জ করা হচ্ছে বিদ্যুতের চোরাই সংযোগ নিয়ে। যার কারণে নগরীতে বাড়ছে লোডশেডিং।
গতকাল আন্দরকিল্লা থেকে বহদ্দারহাট যাওয়ার পথে ব্যাটারি রিকশা চালক সুমন এ রিকশার অনুমোদন না থাকার কথা স্বীকার করে বলেন, অনুমোদন না থাকলেও আমরা সড়কে গাড়ি চালাচ্ছি। এজন্য মালিককে দৈনিক দিতে হয় তিনশ টাকা। এছাড়া ব্যাটারি চার্জ দিতে খরচ হয় ৬০ টাকা। চার ঘণ্টা চার্জ দিলে আট ঘণ্টা চালানো যায়। চালকদের দেয়া তথ্য মতে, সিরাজদ্দৌলা রোড থেকে বাকলিয়া পর্যন্ত এলাকায় ২০/২৫টি ব্যাটারি চার্জের গ্যারেজ খোলা হয়েছে। এর কোনোটি বস্তির মধ্যে, কোনোটি রাস্তার পাশের কোনো দোকানের পেছনে। একইভাবে হালিশহর, ছোটপোল, পাহাড়তলী আমবাগান, কর্নেলহাট এলাকায় এসব গাড়ির মালিকদের অনেকে ঘরের সংযোগ থেকে নিজের একাধিক গাড়ি চার্জ দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন বলেও জানিয়েছেন চালকরা।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (যানবাহন) শ্যামল কুমার নাথ আজাদীকে বলেন, ব্যাটারি চলাচল অনেক আগেই নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ট্রাফিক পুলিশের জন্য তারা মূল সড়কে সচরাচর চলাচল করতে পারে না। তবে অভ্যন্তরীণ সড়কগুলোতে এসব রিকশা চলছে। তিনি আরও জানান, ট্রাফিক পুলিশের হাতে ধরা পড়লে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। আমাদের ডাম্পিং চেক করলেই বুঝবেন কত হাজার ব্যাটারি আর ব্যাটারি চালিত রিকশা আটক আছে। তবু ফাঁকি দিয়ে যে চলছে না তা বলছি না। কিন্তু সার্জেন্টের চোখে পড়লেই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ১৮ অক্টোবর খুলছে চবির আবাসিক হল
পরবর্তী নিবন্ধডিও প্রথায় যত সমস্যা