স্বল্প ড্রাফটের কোনো জাহাজ নেই, ফলে অভ্যন্তরীণ রুটে পরিবহন করা যাচ্ছে না কন্টেনার। এতে নৌপথে বিপুল সম্ভাবনা হাতছাড়া করছে বাংলাদেশ। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে কন্টেনার পরিবহনের অন্তত ৭০ শতাংশ অভ্যন্তরীণ নৌরুটে হলেও এদেশে এক শতাংশও হয় না। ফলে জাহাজের ডিজাইনের কারণে পণ্য পরিবহনে পৃথিবীর সবচেয়ে সস্তা রুট ব্যবহার করতে পারছে না বাংলাদেশ। তবে ইউরোপের দেশগুলোর সহায়তা নিয়ে অভ্যন্তরীণ নৌরুটে কন্টেনার পরিবহন শুরু করতে পারলে বাংলাদেশে পণ্য পরিবহন খরচ বহুলাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব বলে অভিমত সংশ্লিষ্টদের। এক্ষেত্রে নেদারল্যান্ড থেকে বড় ধরনের সহায়তার প্রত্যাশা করা হচ্ছে। নেদারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূতও এক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সহায়তা করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
সূত্র জানিয়েছে, পৃথিবীর সমুদ্রপৃষ্ঠের বেশ নিচের একটি দেশ নেদারল্যান্ড। চারদিকে বাঁধ দিয়ে দেশটিকে রক্ষা করা হয়। পানি ব্যবস্থাপনায় দেশটি পৃথিবীর সবচেয়ে বিশেষজ্ঞ। বিশেষ করে বাঁধ নির্মাণ থেকে শুরু করে নৌরুটে পণ্য পরিবহনসহ সর্বক্ষেত্রে পৃথিবীর সেরা প্রযুক্তি ব্যবহার করে থাকে তারা। তাদের সহায়তায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশ পানি ও বন্দর ব্যবস্থাপনা এবং জাহাজ চলাচলের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক উন্নয়ন সাধন করেছে। ইউরোপের দেশগুলোতে ছোট ছোট নদী ও খালে কন্টেনারবাহী জাহাজ চলাচল করে। স্বল্প ড্রাফটের নৌযান তৈরি ও নদীতে পরিচালনার ক্ষেত্রে ইউরোপ প্রত্যাশিত অগ্রগতি লাভ করেছে। ২০/৫০টি কন্টেনার নিয়ে নদী বা খালে চলাচল করে ছোট ছোট নৌযান। দুই/চারশ’ ট্রাক বা কাভার্ড ভ্যানের পণ্য ছোট্ট একটি নৌযান গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। এতে পণ্য পরিবহন খরচ অনেক কম পড়ে। পৃথিবীর সবচেয়ে সস্তা এই রুট ব্যবহার করে ইউরোপের দেশগুলো বিভিন্নভাবে লাভবান হচ্ছে। এসব দেশের অভ্যন্তরীণ নৌরুটে অন্তত ৭০ শতাংশ কন্টেনার পরিবহন করা হয়। এতে তাদের রাস্তার উপর চাপ বহুলাংশে কমে গেছে। ফলে রাস্তায় যানজটও তেমন পড়ে না। রাস্তার আয়ুষ্কালও থাকে বেশি। অপরদিকে নদীমাতৃক বাংলাদেশে নৌপথ ব্যবহার করার অপার সম্ভাবনা থাকলেও শুধুমাত্র জাহাজের ডিজাইনের কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। বাংলাদেশে নদী বা খালে কন্টেনার নিয়ে চলাচল করার মতো কোনো নৌযান তৈরি হয়নি। একমাত্র চট্টগ্রাম-পানগাঁও রুটে কিছু কন্টেনার পরিবাহিত হয়। দেশে অভ্যন্তরীণ সড়ক পথ ব্যবহার করে ৯৫ শতাংশ এবং রেল পথ ব্যবহার করে পাঁচ শতাংশ কন্টেনার পরিবহন করা হয়। নদী পথে তেমন কোনো কন্টেনার পরিবহন হয় না। অথচ নদীপথে কন্টেনার পরিবহনের সুযোগ তৈরি করা গেলে দেশের সড়কগুলোর উপর চাপ বহুলাংশে কমত। যানজটসহ অন্যান্য প্রতিকূল পরিস্থিতি থেকেও রক্ষা পাওয়া যেত।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, শুধুমাত্র জাহাজ ডিজাইনের কারণে বিপুল সম্ভাবনার এই সুযোগ হাতছাড়া রয়ে গেছে। স্বল্প ড্রাফটের জাহাজ ডিজাইন করা গেলে চট্টগ্রাম থেকে আশুগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ নোয়াপাড়াসহ অন্তত পঁচিশটি রুটে নিয়মিত কন্টেনার পরিবহন করা যেত। যেখানে নদী পথে বর্তমানে লাইটারেজ জাহাজের মাধ্যমে খোলা পণ্য পরিবাহিত হয়। লাইটারেজ জাহাজের মতো স্বল্প ড্রাফটের জাহাজ তৈরি করে কন্টেনার পরিবহন খুব কঠিন কাজ নয় বলেও মন্তব্য সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের।
বিষয়টি নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (প্ল্যানিং এন্ড এডমিন) মোহাম্মদ জাফর আলম দৈনিক আজাদীকে বলেন, পৃথিবীর সবচেয়ে সস্তা রুট হচ্ছে নৌরুট। এত স্বল্প খরচে অন্য কোনো রুটে পণ্য পরিবহন সম্ভব নয়। অথচ আমাদের এই সুযোগ থাকলেও তা আমরা বাস্তবায়ন করতে পারিনি। আমাদের উল্লেখ করার মতো কোনো কন্টেনার নদীপথে পরিবহন করা হয় না। অথচ এখানে অপার সম্ভাবনা রয়েছে। জাফর আলম বলেন, স্বল্প ড্রাফটের জাহাজ তৈরি খুব কঠিন কাজ নয়। লাইটারেজ জাহাজ চলতে পারলে একই ড্রাফটে কন্টেনার জাহাজও চালানো সম্ভব। শুধু ডিজাইনে পরিবর্তন আনতে হবে। এটি করতে পারলেই আমাদের অভ্যন্তরীণ নৌ সেক্টরে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। তিনি বলেন, ২১০০ সালে বাংলাদেশের বন্দর এবং অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন রুট কেমন হবে তা নিয়ে এখন থেকেই কাজ শুরু করতে হবে। আমাদের ডেল্টা প্ল্যানে এসব বিষয়গুলো খুবই গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। নেদারল্যান্ড এক্ষেত্রে বেশ এগিয়ে রয়েছে উল্লেখ করে জাফর আলম বলেন, আমরা নেদারল্যান্ডের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারি। তারা আমাদের সহায়তা করতেও আগ্রহী। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে ১৯৭২ সাল থেকে নেদারল্যান্ড বাংলাদেশের চরাঞ্চলের উন্নয়ন ও বেঁড়িবাধ নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা দিচ্ছে। অভ্যন্তরীণ নৌরুটে কন্টেনার পরিবহনে তাদের সহায়তা চাওয়া হলে তারা করবে। এক্ষেত্রে আমাদেরকে অগ্রসর হতে হবে। নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত হ্যারি ভারওয়াচও গতকাল চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম শাহজাহানের সাথে সৌজন্য সাক্ষাতকালে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহায়তা করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এই সহায়তা কাজে লাগিয়ে দেশের অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন সেক্টরে কন্টেনারে পণ্য পরিবহনে গতিশীলতা সৃষ্টির সুযোগ রয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।