ফরাসি দেশের মহাপরাক্রমশালী সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্টের ধমনীতে রাজরক্ত প্রবাহিত ছিলনা। সাম্য, মৈত্রী স্বাধীনতার ডাক দিয়ে বিপ্লবী ফরাসী জনতা যখন লুইদের বুরবোঁ সিংহাসন ধরে টান দেয় নেপোলিয়ন তখন বিশ বছরের যুবক; সেনা বিদ্যালয়ের এক সাধারণ শিক্ষার্থী মাত্র। দিনে একবেলা খেয়ে কোনমতে দিনাতিপাত করছিলেন। ফরাসিদের প্রতি তীব্র ঘৃণা তাঁর বুকে। ভূমধ্যসাগরের বুকে অপূর্ব সুন্দর কর্সিকা দ্বীপ তাঁর জন্মভূমি; নেপোলিয়ন ভূমিষ্ঠ হবার আগের বছরই ইতালির হাত থেকে জোর করে ছিনিয়ে নিয়েছিল ফ্রান্স। কাগজেকলমে বোনাপার্ট পরিবারের সকলেই তখন ফরাসি নাগরিক। শিক্ষা ও পারিবারিক প্রয়োজনে প্যারিসে অবস্থান করলেও যুবক নেপোলিয়নের স্বপ্ন মাতৃভূমিকে ফরাসি শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্ত করা।
ফরাসি রাজতন্ত্রের সমাধি রচিত হয় গিলোটিন যন্ত্রে রাজা রানীর শিরশ্ছেদের মাধ্যমে। সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতা তাৎক্ষণিক ধরা দেয় না। তবে নেপোলিয়নের কপাল খুলে যায় বিপ্লবের সূচনাতেই। সৈনিক থেকে সেনাপতি, ধীরেধীরে সর্বাধিনায়ক। বিপ্লবী সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় দিগ্বিজয়ে বের হন নেপোলিয়ন। ইউরোপ, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্যের বিরাট অংশ পদানত করে প্যারিসে প্রত্যাবর্তন করেন। কেন? দেশ বাঁচাতে? না, তদানিন্তন কিম্ভুতকিমাকার সরকার ব্যবস্থায় দুর্বলতার গন্ধ আঁচ করতে পেরে সিংহাসন দখল করতে।
অনেক স্বপ্ন নিয়ে বিপ্লব করলেও এক দশকে এক দণ্ড শান্তিও পায়নি ফরাসি জনতা। কোন্দল, হানাহানি, রক্তপাত বিরামহীনভাবে চলেছে রাজপথে, গৃহে, প্রাসাদে। রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয় বুদ্ধিবৃত্তিক সমপ্রদায়ের। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠে দলের পর দল। যত দল, তত মত, তত পথ। গৃহযুদ্ধ অনিবার্য। ইতিহাস বলে যে কোন দুর্যোগ জনজীবনে ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনলেও কেউ না কেউ দুর্যোগের সুফল ভোগ করে; আলাদিনের চেরাগ পেয়ে ভাগ্য বদলে ফেলে কেউ কেউ। সত্যি তাই, নেপোলিয়ন যেন সেই চেরাগই পেয়ে যান।
এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি নেপোলিয়নকে। দুই দশকে পৃথিবীর ঘুম কেড়ে নিয়েছিলেন। ইউরোপের রাজতন্ত্রবাদী নৃপতিদের নাকানিচুবানি খাইয়ে ছেড়েছেন। মাতৃভূমি কর্সিকা মুক্ত করার কথা কবেই ভুলে গিয়েছেন! ফরাসি দেশের রাষ্ট্রপতি হয়েও সাধ মেটেনি তাঁর। স্বপ্ন দেখেন সম্র্রাট হওয়ার। রাজসিংহাসন, লুইদের মুকুট, মণিমুক্তা খচিত জরির আলোয়ান সবকিছুর সাধ নেন একে একে। বিজিত রাজ্যসমূহে নিজের ভাইবেরাদরকে রাজার আসনে অধিষ্ঠিত করেন। সন্তান দিতে ব্যর্থ হওয়ায় ভালোবাসার জোসেফাইনকে পরিত্যাগ করে অস্ট্রিয়ার রাজকন্যার পানি গ্রহণ করেন, এবং সদ্যজাত শিশুপুত্রকে নতুন অধিকৃত ভূখণ্ডের রাজা বলে ঘোষণা দেন। এমনি করে যথেচ্ছাচার করে গেছেন ইতিহাসের মহানায়ক নেপোলিয়ন। বড় সাধ ছিল তাঁর প্রাচ্যদেশ বিশেষ করে ভারত জয় করার। নেপোলিয়নদের ছেলেবেলায় বইতে পড়ানো হত- জ্ঞান গরিমা ও সম্পদের আধার ভারতবর্ষ। সোনা ফলানো এই ভূখণ্ডকে একবার চোখের দেখাও দেখতে না পেলে মানবজীবন বৃথা। পাঁচ দশকের ক্ষুদ্র অথচ কর্মময় জীবনে নেপোলিয়ন প্রাচ্য সফরের সময়সূচি ঠিক করে উঠতে পারেননি।
ভলতেয়ার, মন্টেস্কু, রুশো দিদেরোদের দর্শন বুকে ধারণ করে রাজতন্ত্রের পতন ঘটিয়েছিল ফরাসিরা। পনের বছরের মাথায় সেই তুইলারি প্রাসাদে রাজার বেশেই অভিষিক্ত হলেন মহামতি নেপোলিয়ন; রাজা নয় সম্রাট উপাধি ধারণ করে। বিপ্লবের বাণী সেদিন কেঁদে উঠেছিল কী নেপোলিয়নের রাজবেশ দেখে? বেশ দম্ভ সহকারেই উচ্চারণ করেন নেপোলিয়ন ‘আমি বিপ্লবের সন্তান’। দুদিন পর এক মুখে তিনি পুনরায় ঘোষণা দেন- ‘আমিই বিপ্লবকে ধ্বংস করেছি’। বাহ! কী চমৎকার স্বীকারোক্তি! আর তো কথা থাকতে পাওে না। বিপ্লবের আদর্শকে ধ্বংস করলেও নেপোলিয়ন কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে দৃশ্যমান উন্নয়ন, রাজধানীর সৌন্দর্যবর্ধন ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করে জনমনে কিছুটা স্বস্তি এনে দিয়েছিলেন, যা তাকে নিঃসন্দেহে এক মহান রাষ্ট্রনায়কের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করে। তবে কেবল ফরাসি দেশের অধিপতি হয়ে মন ভরে না তাঁর। দিগ্বিজয়ের নেশা তাই কাটে না।
কিন্তু ঐ ওপরে ঊর্ধ্বাকাশে একজন বসে মুচকি হাসেন- এই দিন দিন নয়। ওয়াটার লু’র প্রান্তরে ইংরেজ নেতৃত্বাধীন সম্মিলিত বাহিনীর হাতে পরাজিত হন নেপোলিয়ন। আটলান্টিক মহাসাগরের মাঝবরাবর নিঝুম দ্বীপ সেন্ট হেলেনায় নির্বাসিত জীবনের পঞ্চম বছরে মাত্র একান্ন বছর বয়সে চোখ বুজেন অবশেষে। সে প্রায় দুশো বছর আগের কথা। সত্যিই কী এই ধরাধাম ছেড়ে বিদায় নিয়েছেন নেপোলিয়ন? নাকি নানান ছদ্মবেশ ধারণ করে পৃথিবীর নানা জনপদে আবির্ভূত হয়েছেন?
ইতিহাস বলে, বিপ্লবীদের অনেকে ক্ষমতার স্বাদ পেলে ভোল পাল্টে ফেলেন, বিপ্লব দমনে শক্তি প্রয়োগ করেন, প্রয়োজনে রক্তপাতও করেন। সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদের বাণী ছড়িয়ে জনতার আস্থা অর্জনশেষে একজন সাম্যবাদী নেতা শেষপর্যন্ত আর জনতার কাতারে থাকেন না। খুব দ্রুত শাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন, প্রয়োজনে শোষকের। উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের শতবর্ষ পেরোবার পর স্বদেশী আন্দোলনের ডাক দেয় বাঙালি বিপ্লবীরা। আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করতে সাধারণ জনতা অনেক কষ্টের টাকায় কেনা বিলেতি পণ্য পুড়িয়ে ফেললেও অনেক বিপ্লবী নেতা আভিজাত্যের প্রতীক বিলেতি ভোগ্যপণ্য অবাধে ব্যবহার করেছেন। কালেকালে বিপ্লবীদের অনেকে ভুখা নাঙ্গা জনতার ওপর ভর করে ইতিহাসে নাম লিখিয়ে অমরত্ব কিনে নিয়েছেন।
সেই ধারা আজও বহমান। জনতার সেবায় প্রাণ কোরবান করার অঙ্গীকার করে আইনপ্রণেতার আসনে বসে আমাদের জনপ্রতিনিধিদের অনেকে জনতার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে আখের গোছাতে লেগে যান। দ্বিতীয়, তৃতীয় আবাস গড়ে তোলেন বিশ্বের নামীদামী নগরে। নিরাপদ আস্তানায় বসে হুংকার ছাড়েন জীবনবাজি রেখে কাজ করা নানান পেশাজীবীদের ওপর।
নেপোলিয়নের প্রেতাত্মা কী তবে পৃথিবী ছেড়ে যায়নি! মৃত্যুর প্রায় দু’দশক পর তার দেহাবশেষ ফিরিয়ে আনা হয় প্যারিসে। নেপোলিয়নের ভ্রাতুষ্পুত্র দ্বিতীয় ফরাসী সম্রাট তথা তৃতীয় নেপোলিয়ন রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করেন পিতৃব্যকে। এটা কিন্তু আনুগত্য কিংবা ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ নয় মোটেও। নামের যাদুকে কাজে লাগিয়ে নিজের পায়ের তলার মাটি শক্ত করার অভিপ্রায়মাত্র। এ-বিষয়ে বিশদ আলোকপাত করার সুযোগ নেই এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে। যেকথা বলার জন্য এতো কথা- নেপোলিয়ন বোনাপার্টের দেহাবশেষ প্যারিসের লা’ ইনভেলিড নামক সেনাজাদুঘরে দ্বিতীয়বারের মতো সমাহিত হবার ঠিক শতবর্ষ পরে, সেই সমাধি পরিদর্শনে আসেন ইতিহাসের আরেক মহানায়ক, যাকে সচরাচর খলনায়কই বলা হয়। ইউরোপ তখন তার পদানত। ইহুদি নিধনজজ্ঞ চলছে পুরোদমে। তিনি আর কেউ নন, জার্মান একনায়ক এডলফ হিটলার। নেপোলিয়নের সমাধির পাশে দাঁড়িয়ে নীরবে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন নাৎসি স্বৈরশাসক, আর অকপটে স্বীকার করেন যে সেটা ছিল তার জীবনের সেরা মুহূর্ত। নেপোলিয়নকেই তিনি জীবনের নায়ক হিসেবে অনুসরণ করেছিলেন এবং নেপোলিয়নের পথে হেঁটে আমৃত্যু ভুগিয়েছেন ইউরোপ তথা পৃথিবীকে ।
তাই বলে ফরাসী বিপ্লব কিন্তু ব্যর্থ হয়ে যায়নি। বারবার বিপ্লব এসেছে ভলতেয়ার, রুশো,মন্টেস্কু, দিদেরোদের পুণ্যভূমিতে। তাঁদের সত্য, শিক্ষা, দর্শন মুছে যায়নি। বিপ্লবের প্রকৃত সুফল পেতে ফরাসি জনগণকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল প্রায় দেড়শ বছর। জনতার মুক্তি এল। আপাতদৃষ্টিতে সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতার দেখা পেল ফরাসি সমাজ। প্রতি জুলাইয়ের চৌদ্দতম দিনে মহাসমারোহ জাতীয় দিবস পালন করে ফরাসি জনতা, দুঃশাসন ও অবিচারের প্রতীক বাস্তিল দুর্গের পতন ও জনতার বিজয়ের প্রধান মাইলফলককে স্মরণ করে। এতো গেল ভেতরের কথা। বহির্বিশ্বে ইতোমধ্যে ফ্রান্স বিশ্ব মোড়লদের কাতারে ভিড়তে শুরু করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বিজিত অঞ্চল বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের অবসানে অরক্ষিত রাষ্ট্রগুলোর ভাগ বাটোয়ারায় চিরকালের শত্রু ব্রিটিশ শক্তির সঙ্গে হাত মেলায়, আঁতাত করে। তাহলে এর অর্থ কী দাঁড়াচ্ছে- স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব প্রয়োজন কেবলই নিজের জন্য? অনেক সংগ্রাম, ত্যাগ তিতিক্ষার দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে আমারটা পাওয়া হয়ে গেলে অন্য কারও কাছ থেকে স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব কেড়ে নিতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হব না? ইতিহাসে খুব বেশী জাতীয়তাবাদী নেতার দেখা মেলে না যাঁরা ক্ষমতার স্বাদ পাবার পর নিরীহ মানুষের রক্তে হাত রাঙাননি। মহানায়ক অবতীর্ণ হন খলনায়কের ভূমিকায়! তবুও দম্ভ, তবুও প্রশস্তি!
জগতের এই রীতির অবসান কী কোনদিন হবে না? পৃথিবীর নামীদামী শহরে আজও সদম্ভে দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাসের খলনায়কদের অতিকায় মূর্তি। ‘ব্লাক লাইভস ম্যাটার’ এর সূত্র ধরে একে একে ভূপতিত হয়েছে অনেকে। নেপোলিয়নও কী সেই দলে পড়েন না? ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির কথা সত্য বলে মেনে নিলে, সত্যজিতের ‘হীরক রাজার দেশে’র সেই চৌম্বক অংশের মতো একদিন পৃথিবীর সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী আওয়াজ তুলবে সেই যাদুকরী ছন্দে- ‘দড়ি ধরে মারো টান, রাজা হবে খান খান’।
সে প্রায় দুশো বছর আগের কথা। সত্যিই কী এই ধরাধাম ছেড়ে বিদায় নিয়েছেন নেপোলিয়ন? নাকি নানান ছদ্মবেশ ধারণ করে পৃথিবীর নানা জনপদে আবির্ভূত হয়েছেন?