বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ছাত্র রাজনীতি ফেরানোর দাবিতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশ করার পর প্রকাশ্যে নেতাকর্মীদের নিয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করলেন ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন এবং সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালি আসিফ ইনান। গতকাল রোববার দুপুর আড়াইটার দিকে কয়েকশ নেতাকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে বুয়েট শহীদ মিনারে ফুল দেন তারা। সেখানে ফুল দেওয়ার পর অল্প সময়ের মধ্যে বুয়েট ত্যাগ করেন। এ সময় বুয়েটের মূল ফটক এবং বিভিন্ন হলের প্রবেশ পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়।
তিন দিন আগে গভীর রাতে বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ নেতাদের প্রবেশের প্রতিবাদে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পাল্টায় গতকাল ক্যাম্পাসে ঢুকে নিজেদের শক্তির জানান দিল সরকার সমর্থক ছাত্র সংগঠনটি। দুপুরে বুয়েট ক্যাম্পাসে যাওয়ার আগে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশ করে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি ফেরানোর দাবিতে আলটিমেটাম দেন ছাত্রলীগ সভাপতি।
এদিকে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের প্রবেশের ঘটনার প্রতিবাদে আন্দোলন নেমে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগার কথা জানিয়েছেন বুয়েটের শিক্ষার্থীরা। খবর বিডিনিউজের।
ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বলেন, বুয়েট প্রশাসনের কাছে আমাদের আহ্বান থাকবে, অনতিবিলম্বে ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি চালু করতে হবে। যে নিয়ম আপনারা শুরু করেছেন সেটি কালাকানুন, সেটি কালো আইন। বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করার কোনো আইন নাই। যদি থেকেও থাকে সেটি সংবিধানবিরাধী। আমরা আজ শহীদ মিনার থেকে বুয়েট প্রশাসনকে আলটিমেটাম দিচ্ছি, অনতিবিলম্বে ছাত্ররাজনীতি চালু করতে হবে। স্বল্পতম সময়ের মধ্যে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিতে হবে। বুয়েট শিক্ষার্থী ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ইমতিয়াজ হোসেন রাহিম রাব্বির সিট ফিরিয়ে দিতে হবে।
২০১৯ সালে বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনার পর আন্দোলনের মুখে ওই ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হয়। বৃহস্পতিবার গভীর রাতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি, দপ্তর সম্পাদকসহ অনেকে বুয়েট ক্যাম্পাসে প্রবেশ করলে এর প্রতিবাদে শুক্রবার থেকে ফের আন্দোলন শুরু হয়। শিক্ষার্থীদের ভাষ্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধিমালা লঙ্ঘন করে পুরকৌশল বিভাগের ২১তম ব্যাচের ছাত্র ও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ইমতিয়াজ হোসেন রাহিম এ সমাগম ঘটান।
এ ঘটনায় শুক্রবার বিকালে বুয়েটের শহীদ মিনারের সামনে শিক্ষার্থীরা সংবাদ সম্মেলন করেন। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকল্যাণ পরিদপ্তরের পরিচালকের (ডিএসডব্লিউ) কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিক্ষোভ দেখান। এরপর রাতে বুয়েটের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ফোরকান উদ্দিনের স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে ইমতিয়াজ হোসেন রাহিমের হলের সিট বাতিল করা হয়। পাশাপাশি বিষয়টি তদন্তে কমিটি গঠন করে ৮ এপ্রিলের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়।
ইমতিয়াজকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করাসহ ছয় দফা দাবিতে গতকাল সকাল থেকে ফের বিক্ষোভের ঘোষণা দিয়েছিলেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। তবে গতকাল সকাল থেকে ক্যাম্পাসে তাদের কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি।
আন্দোলনে নেতৃত্বে থাকা এক শিক্ষার্থী বলেছেন, আমাদের আন্দোলন সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছে। গতকাল (শনিবার) বিকাল ৪টায় ভিসি স্যারের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। আজও ভিসি স্যারের সঙ্গে এক দফা মিটিং আছে। মিটিং শেষে সামগ্রিক একটা ব্রিফ হতে পারে।
শিক্ষার্থীরা আন্দোলন স্থগিতের ইঙ্গিত দিলেও ইমতিয়াজকে বহিষ্কারের প্রতিবাদে এবং বুয়েটে নিয়মতান্ত্রিক ছাত্র রাজনীতি ফেরাতে পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রতিবাদ সমাবেশ করে ছাত্রলীগ।
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালি আসিফ ইনানের সঞ্চালনায় প্রতিবাদ সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন। জায়ামাত–শিবির–রাজাকার, তাড়াতাড়ি বাংলা ছাড়, মৌলবাদের বিরুদ্ধে ডাইরেক্ট অ্যাকশন, শিবিরের বিরুদ্ধে ডাইরেক্ট অ্যাকশন, শিবিরের আস্তানা, ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও স্লোগান দেওয়া হয় সমাবেশ থেকে।
ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম বলেন, আমরা জানি, ছাত্র রাজনীতিতে নেগেটিভ এলিমেন্ট রয়েছে। তবে এটাকে সংস্কার করতে হবে আরও ভালো ছাত্ররাজনীতি দিয়ে। ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের নামে সংবিধান অবমাননা করা হয়, যাচ্ছে তাই ক্যাম্পাস কালচার তৈরি করে। অন্ধকার রাজনীতি চর্চা করবে মৌলবাদী ও স্বাধীনতার বিপক্ষের গোষ্ঠীরা। হিজবুত তাহরীর শিক্ষার্থীদের অফিসিয়াল ইমেইলে মেইল পাঠায় খেলাফত প্রতিষ্ঠার, ক্যাম্পাসে কিউআর কোড লাগায় জঙ্গিবাদ চর্চার। আমরা চাই বুয়েটের শিক্ষার্থীরা আধুনিকায়ন করে স্মার্ট ছাত্ররাজনীতি উপহার দেবে। তারা তাক লাগানো প্রযুক্তি তৈরি করে বাংলাদেশকে গর্বিত করবে।
নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত আন্দোলনকারীরা : ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের প্রবেশের ঘটনার প্রতিবাদে আন্দোলন নেমে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগার কথা জানিয়েছেন বুয়েটের শিক্ষার্থীরা। নিরাপত্তা পেলে একাডেমিক কার্যক্রমে ফিরবেন বলেও জানিয়েছেন তারা। গতকাল বিকালে বুয়েটের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সংবাদ সম্মেলন করে এসব কথা বলেন আন্দোলনকারীরা। সংবাদ সম্মেলনে দুজন শিক্ষার্থী লিখিত বক্তব্য পাঠ করে শোনান। তবে তাদের নাম পরিচয় দেননি।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, আমাদের ক্যাম্পাসের রাজনীতিমুক্ত থাকা, অপশক্তির কবল থেকে মুক্ত থাকা এবং নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পেলে আমরা সকল ব্যাচের শিক্ষার্থীরা অনতিবিলম্বে আমাদের একাডেমিক কার্যক্রমে ফেরত যাব। যে দুদিন শিক্ষার্থীরা টার্ম ফাইনাল পরীক্ষা বর্জন করেছে, সেই দুদিনের পরীক্ষার তারিখ নির্ধারণের দাবি জানিয়েছেন আন্দোলনকারীরা।
সংবাদ সম্মেলন নিজেদের অবস্থান তুলে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে বলা হয়, বুয়েটে ছাত্র রাজনীতিবিহীন ক্যাম্পাসের পক্ষে আন্দোলনরত সকল ব্যাচের সকল শিক্ষার্থীরা আজ নিরাপত্তাজনিত তীব্র শঙ্কার কারণে কেউ কোনোরূপ সমাগম করেনি। ক্যাম্পাসের আশপাশের সকল এলাকায় গতকাল রাত থেকে ক্রমাগত মাইকিং, শিক্ষার্থীদের ফোন কলে হুমকি ধামকি প্রদান করা, সোশ্যাল মিডিয়ায় নানারকম গুজব, বুয়েট শিক্ষার্থীদের মিথ্যা ট্যাগ দেওয়া, শিক্ষার্থীদের ছবি নাম পরিচয়সহ পোস্ট করে তাদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা গুরুতরভাবে বিঘ্নিত হয়–এমন সকল অপপ্রচার চালানো হয়েছে।
ক্লাস–পরীক্ষা বর্জনের বিষয়ে বলা হয়, আজ বুয়েটের ২০ ব্যাচের টার্ম ফাইনাল পরীক্ষা ছিল। উক্ত পরীক্ষায় ক্যাম্পাসে কোনোরূপ অবস্থান আন্দোলন ছাড়াই, কোনো বাধা ছাড়াই নিয়মিত শিক্ষার্থীদের শুধুমাত্র ১ জন বাদে সকল শিক্ষার্থীই স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত ছিল। ১২১৫ জন ২০ ব্যাচের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ১২১৪ জনই পরীক্ষায় অংশ নেয়নি। এ থেকেই শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত নৈতিক অবস্থান ক্যাম্পাসে পুনরায় ছাত্ররাজনীতি প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে কতটুকু সুদৃঢ় তা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়।
বুয়েটে হিযবুত তাহরীর কার্যক্রম নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বর্তমানে হিজবুত তাহরীর নিয়ে কথা উঠেছে। এটি কোনো রাজনৈতিক দল না, বরং নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন। এদের কর্মকাণ্ড আমরা ক্যাম্পাসে দেখতে পাই বহিরাগতদের (সিসি ফুটেজ অনুযায়ী) লাগানো বিভিন্ন পোস্টার, মেইল বা প্রচারপত্র ইত্যাদির ভিত্তিতে। তাদের পরিচয় সম্পর্কে আমরা স্পষ্ট না।