জ্ঞান–বিজ্ঞানে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখা বিশ্বের শীর্ষ ১০ ব্যক্তির তালিকা করেছে বিজ্ঞানবিষয়ক ব্রিটিশ সাময়িকী নেচার। এই তালিকায় রয়েছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। নেচার সাময়িকী এই নোবেলজয়ীকে নিয়ে শিরোনাম করেছে, ‘দ্য রেভল্যুশনারি ইকোনমিস্ট হু বিকাম দ্য আনলাইকলি লিডারস অব বাংলাদেশ’। প্রতিবেদনে বলা হয়, কয়েক সপ্তাহ বিক্ষোভের পর আগস্টে বাংলাদেশের স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। এরপর ছাত্রনেতারা শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে দেশের নেতৃত্ব নেওয়ার আমন্ত্রণ জানান। খবর বাংলানিউজের।
এটি মুহাম্মদ ইউনূসের জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ছয় দশকের ক্যারিয়ারে তিনি দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নতুন ধারণার জন্য নিজেকে পরিচিত করেছেন। যারা ইউনূসকে চেনেন তারা বলেন, গবেষণার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং সমস্যা সমাধানে মূল বিষয়গুলো গভীরভাবে বোঝার দক্ষতাই তার কাজের মূল ভিত্তি। ইউনূসের সঙ্গে ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কাজ করা অ্যালেঙ কাউন্টস বলেন, তিনি আশির ঘরে পা দিয়েছেন, কিন্তু শারীরিক ও মানসিকভাবে এখনও সম্পূর্ণ সচল। তার মধ্যে সহানুভূতি রয়েছে। তার যোগাযোগ পদ্ধতিও চমৎকার।
অধ্যাপক ইউনূসের জন্ম ব্রিটিশ শাসিত ভারতে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর তার জন্মস্থান চট্টগ্রাম পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৬০–এর দশকে, মুহাম্মদ ইউনুস যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান এবং সেখানে নিকোলাস জর্জেসকু–রোগেনের অধীনে পড়াশোনা করেন। তিনি ছিলেন পরিবেশ অর্থনীতির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। বিষয়টি অর্থনীতি ও প্রাকৃতিক জগতের পারস্পরিক সম্পর্ক বোঝার ক্ষেত্রে জোর দেয়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের কাছ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে দেশে ফিরে আসেন ইউনূস। দেশ গঠনে নিজের ভূমিকার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন তিনি।
মুহাম্মদ ইউনুস ক্ষুদ্রঋণের উদ্ভাবনী ধারণার জন্য সর্বাধিক পরিচিত। এটি এমন একটি পদ্ধতি যেখানে প্রায়ই ১০০ মার্কিন ডলারের চেয়েও কম ঋণ দেওয়া হয়। সাধারণত ক্ষুদ্র ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো দরিদ্রদের কাছ থেকে অত্যধিক সুদ আদায়ের মাধ্যমে শোষণ চালিয়ে থাকে। তবে ইউনূস দেখিয়েছেন, ন্যায়সঙ্গতভাবে পরিচালিত হলে এই ক্ষুদ্র ঋণ সমাজের দরিদ্র মানুষের জীবন বদলে দিতে পারে।
সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সময়ে মুহাম্মদ ইউনূস ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে কাজ শুরু করেন। তিনি একটি মডেল তৈরি করেন যেখানে ব্যবসার মাধ্যমে নারীদের স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে খুব অল্প পরিমাণ ঋণ দেওয়া হয়। ১৯৮৩ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন গ্রামীণ ব্যাংক। তার এই উদ্ভাবনী ধারণা বিশ্বজুড়ে পরিচিতি পায়।
নেচারের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, গ্রামীণ ব্যাংকের মতো একটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার চেয়ে ১৭ কোটি মানুষের একটি দেশের সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশে এখন প্রায় সবারই একটি প্রশ্ন– ইউনূস কি ছাত্রদের দাবিগুলো পূরণে সক্ষম হবেন? এসব দাবির মধ্যে রয়েছে দুর্নীতি দূরীকরণ, নাগরিক অধিকার সুরক্ষা, চাকরি ও শিক্ষায় সমান সুযোগ নিশ্চিত করা এবং বিক্ষোভে নিহতদের পরিবারের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা।
কানেকটিকাটের নিউ হেভেনে অবস্থিত ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ মুশফিক মোবারক বলেন, আগস্ট বিপ্লবের আগে দেশের বেশিরভাগ পুলিশ, সিভিল সার্ভিস, বিচারব্যবস্থা, এমনকি অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ও ব্যাংকও শাসকদলের একপ্রকার শাখায় পরিণত হয়েছিল। মুহাম্মদ ইউনূস ও ছাত্ররা–যাদের কয়েকজন অন্তর্বর্তী সরকারের মন্ত্রিসভায় রয়েছেন, তারা বিশেষজ্ঞদের কমিটি গঠন করেছেন, যেন যেকোনো রাজনৈতিক দলের শাসনামলে সরকারি প্রতিষ্ঠানের ওপর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করা যায়। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার দ্রুত ঘটে না, বলেন কুমিল্লার বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমির গবেষণা পরিচালক ফৌজিয়া সুলতানা। তার কথায়, এটি একটি জটিল এবং ধীরগতির প্রক্রিয়া। আরেকটি চিন্তার বিষয় হলো, কেউ কেউ দ্রুত পরিবর্তন চান, আবার অন্যরা মনে করেন, তার ‘তত্ত্বাবধায়ক’ ভূমিকা পালন করার সময় ব্যাপক সংস্কারের প্রস্তাব দেওয়া সঠিক নয়।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে মুহাম্মদ ইউনূসের মেয়াদের সাফল্য অনেকাংশেই নির্ভর করবে সেই তরুণ ছাত্র–আন্দোলনকারীদের ওপর, যারা তাকে ক্ষমতায় আনতে সাহায্য করেছেন। তরুণেরা শক্তিশালী অংশীজন। তাদের ভূমিকা ২০১০ সালে শুরু হওয়া আরব বসন্তের সময় মধ্যপ্রাচ্যের স্বৈরাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠা তরুণ প্রজন্মের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। আরব বসন্তের সহিংসভাবে আন্দোলন দমন করা হয়েছিল, যা অঞ্চলজুড়ে এবং বৈশ্বিকভাবে অস্থিরতার ঢেউ তোলে। তবে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের গল্পটি ভিন্ন। এখানে সেনাবাহিনী এবং মুহাম্মদ ইউনূস উভয়ই ছাত্রদের পাশে রয়েছেন। কিন্তু এটি একজন ব্যক্তির ওপর বিশাল দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছে। সেপ্টেম্বর মাসে ইয়েলে অনুষ্ঠিত একটি সেমিনারে ঢাকার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ছাত্রী প্রাপ্তি তাপসী বলেন, আমরা পড়তে চাই। আমরা লিখতে চাই। আমরা পরীক্ষা দিতে চাই এবং গবেষণা করতে চাই। রাষ্ট্রকে তার দায়িত্ব পালন করতে হবে।