নগরীর ডবলমুরিং থানাধীন ২৮ নম্বর পাঠানটুলি ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ সমর্থিত ও বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে একজন নিহত হয়েছেন। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন আরো ২ জন। গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে মগপুকুর পাড় এলাকায় এই ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছেন ডবলমুরিং থানা পুলিশ ও স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীরা। নিহতের নাম আজগর আলী বাবুল (৫৫)। তিনি মোগলটুলির কাটা বটগাছ এলাকার বাসিন্দা। তার ২ ছেলে ও ২ মেয়ে রয়েছে। বড় ছেলে কমার্স কলেজে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। ঘটনার পর প্রতিপক্ষের বিক্ষুদ্ধ কর্মী-সমর্থকদের তোপের মুখে বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী মো. আবদুল কাদেরসহ তার অনুসারীরা মগপুকুর পাড়ার আজিম ম্যানসনে ঢুকে পড়েন। বিক্ষুদ্ধ কর্মী-সমর্থকরা ওই ভবন ঘিরে রাখে। এছাড়া কাদেরের পোস্টারে আগুন ধরিয়ে দেয়। পরে পুলিশ এসে ভবনের চারদিকে অবস্থান নেয়। রাত ১২টা ২০ মিনিটে ভবনের বিভিন্ন ফ্লোরে অভিযান চালিয়ে প্রার্থী কাদেরসহ ২৬ জনকে গ্রেপ্তার করে। আবদুল কাদেরসহ তার অনুসারীদের গ্রেপ্তারের সময় এডিসি (দক্ষিণ) পলাশ কান্তি নাথ, এসি কোতোয়ালী নোবেল চাকমা, ডবলমুরিং থানার ওসি সদীপ কুমার দাশ, সদরঘাট থানার ওসি, ডিবি, ডবলমুরিং থানা পুলিশসহ বিপুল সংখ্যক পুলিশ উপস্থিত ছিল।
এই ব্যাপারে ডবলমুরিং থানার ওসি সদীপ কুমার দাশ জানান, মগপুকুর পাড়স্থ আজিম ম্যানসন নামক একটি ভবন থেকে কাউন্সিলর প্রার্থী আবদুল কাদেরসহ ২৬ জনকে আটক করা হয়েছে। এদের মধ্যে ঘটনায় সম্পৃক্ত কারা আছেন তা যাচাই-বাছাই করে দেখা হবে। পরে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হবে। এদিকে সন্ধ্যায় আজগর আলী বাবুল যখন নিহত হন, তখন এলাকাবাসীর প্রতিরোধে কাদেরসহ তার অনুসারীরা আজিম ম্যানসনের ভেতরে অবস্থান নেন। এ সময় নজরুল ইসলাম বাহাদুরের অনুসারীসহ শত শত এলাকাবাসী আজিম ম্যানসন গিরে ‘বাবুল ভাইয়ের রক্ত বৃথা যেতে দেব না’, ‘বাবুল ভাইয়ের খুনি কাদেরের ফাঁসি চাই’ বলে স্লোগান দিতে থাকেন। রাতে যখন আবদুল কাদেরসহ তার অনুসারীদের পুলিশ গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাচ্ছিল যখন এলাকাবাসী যেদিকে ঘেরাও করে রেখেছিল সেই পথ দিয়ে বের না করে বিকল্প পথে বের করে হেলমেট পরিয়ে মনসুরাবাদ ডিবি (বন্দর) কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
সিএমপির উপ-পুলিশ কমিশনার ফারুক উল হক আজাদীকে জানান, পাঠানটুলি ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাহাদুর এবং বিদ্রোহী আবদুল কাদেরের সমর্থকদের মধ্যে সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে সংঘর্ষ ও গোলাগুলি শুরু হয়। এক পর্যায়ে দুজন গুলিবিদ্ধ হন। একজন মারা যান। ঘটনাস্থলে পুলিশ উপস্থিত আছে। পরিস্থিতি বর্তমানে নিয়ন্ত্রণে আছে।
ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ডবলমুরিং থানার ওসি সদীপ কুমার দাশ।
ঘটনাস্থলে গিয়ে প্রত্যক্ষদর্শীদের সাথে কথা বলতে চাইলে অনেকেই ভয়ে মুখ খুলতে চাননি। সাইফুল ইসলাম নামে এক প্রত্যক্ষদর্শী আজাদীকে জানান, পাঠানটুলি ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের সমর্থিত প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাহাদুর এবং বিদ্রোহী প্রার্থী আবদুল কাদেরের সমর্থকদের মধ্যে সোয়া ৭টার দিকে সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। গোলাগুলিতে দুজন গুলিবিদ্ধ হন। আজগর আলী বাবুল মারা যান।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ (পরিদর্শক) জহিরুল ইসলাম ভূঁইয়া আজাদীকে বলেন, হাসপাতালে দুজনকে আনা হয়েছে। একজনের মাথায় গুলিবিদ্ধ ছিল। তাকে মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অপরজনকে চমেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এই দুজন ভালো আছেন। আজগর আলী বাবুল নামে একজন ঘটনাস্থলে মারা গেছেন।
আজগর আলী বাবুলের ছেলের বক্তব্য : আজগর আলী বাবুলের বড় ছেলে সিজান মোহাম্মদ সেতু বলেন, ফিশারিঘাটে আমার আব্বুর মাছের আড়ত আছে। তিনি যুবলীগের রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। বিকালে নজরুল ইসলাম বাহাদুরের গণসংযোগে গিয়েছিলেন। ওই সময় আমি নন্দনকাননে ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন আংকেলের বাসায় উনাকে জন্মদিনে ফুলের শুভেচ্ছা জানাতে গিয়েছিলাম কমার্স কলেজ থেকে। মোগলটুলি যখন পৌঁছি তখন দেখি লোকজন দৌড়াদৌড়ি করছে। গোলাগুলির আওয়াজ শুনে আমি আব্বুকে খুঁজতে থাকি। দূর থেকে তাকে দেখে টেনে নিয়ে যাওয়ার জন্য কাছে যেতেই সানমুন স্কুলের সামনে তার বুকে গুলি লাগে। তখন আব্বু পড়ে যান। আব্বুকে নিয়ে গাড়িতে করে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দিই। স্টেডিয়াম এলাকায় যখন আসি তখন আব্বুর কোনো সাড়া নেই। আমি তাড়াতাড়ি মেহেদিবাগ ন্যাশনাল হাসপাতালে নিয়ে যাই। আইসিইউতে ঢোকাতেই ডাক্তার বলেন, আব্বু নেই। কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন সেতু।
কাউন্সিলর প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাহাদুর : আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাহাদুর বলেন, আমি মোগলটুলি এলাকায় গণসংযোগ করছিলাম। সেখানে মেয়র প্রার্থী রেজাউল ভাইয়ের নির্বাচনী কার্যালয়ে কিছুক্ষণ বসি। পরে নজির ভান্ডার লেইনে গণসংযোগ করতে যাই। হঠাৎ করে বৃষ্টির মতো গুলি শুরু করে সন্ত্রাসীরা। আবদুল কাদেরের উপস্থিতিতে সন্ত্রাসীরা আমাদের ওপর হামলার পাশাপাশি গুলিবর্ষণ করে। আমাকে বাঁচাতে গিয়ে বাবুল নামে আমার একজন কর্মী নিহত হয়েছেন। মাহবুব নামে আমার আরেকজন কর্মী আহত হয়েছেন।
কাউন্সিলর প্রার্থী আবদুল কাদের : ঘটনার পর বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী আবদুল কাদের আজাদীকে বলেন, আমার গণসংযোগে বাহাদুরের অনুসারী টিপুসহ বেশ কয়েকজন গুলি করেছে। বাহাদুর সাহেবের লোকজন গতকালও (সোমবার) কদমতলীতে আমার পোস্টার ছিঁড়েছে। আজ (মঙ্গলবার) আমি পুলিশকে অবহিত করেছি। নির্বাচন অফিসে অভিযোগ করেছি। এখন আমি মগপুকুর পাড়ে গণসংযোগে এসেছি। এখানে তার লোকজন হামলা করেছে। হামলার সময় আমি একটি ভবনের দোতলায় ছিলাম। হঠাৎ গোলাগুলির শব্দ শুনি। তখন আমার লোকজন সবাই দৌড়ে চলে যায়। আমি প্রাণের ভয়ে একটি বাসায় আশ্রয় নিয়েছি। আমার চারদিকে বৃষ্টির মতো গুলি করছে। তারা পরিকল্পিতভাবে এই ঘটনা ঘটিয়েছে। তারা আমার বাসাবাড়ি ও গাড়ি ভাঙচুর করেছে।
স্থানীয়দের ভাষ্য : স্থানীয়রা জানান, আওয়ামী লীগের দলীয় কাউন্সিলর প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাহাদুর মহানগর আওয়ামী লীগের সদস্য এবং পাঠানটুলি ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি। তিনি নগর আওয়ামী লীগের প্রয়াত সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী। অপরদিকে বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী আবদুল কাদের নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী। বাহাদুর ২০১৫ সালের সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আবদুল কাদেরের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন।
মহানগর আওয়ামী লীগের বক্তব্য : পাঠানটুলি এলাকায় দুই কাউন্সিলর প্রার্থীর অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় তাৎক্ষণিক এক বিবৃতিতে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মেয়র আ.জ.ম. নাছির উদ্দীন আজাদীকে বলেন, নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ নষ্ট করার জন্য যারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে, যারা এর জন্য দায়ী তাদেরকে যেন পুলিশ খুঁজে বের করে। নির্বাচনকালীন এই ধরনের ঘটনা মেনে নেওয়া যায় না। আমি প্রশাসনকে অনুরোধ করব প্রকৃত দোষীকে গ্রেপ্তার করার জন্য।