চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটগ্রহণের সময় যত ঘনিয়ে আসছে, প্রার্থীদের প্রচারে নির্বাচনী এলাকা ততই সরগরম হয়ে উঠছে। করোনাকালীন নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও নির্বাচনী উত্তাপ বাড়তে শুরু করেছে। চলছে নগর উন্নয়নে, নগরীর বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে প্রার্থীদের এখন নানা প্রতিশ্রুতির জোয়ার। নগরবাসী এ ধরনের প্রতিশ্রুতি আগেও শুনেছে। কিন্তু সেসব প্রতিশ্রুতি কতটা পূরণ হয়, সেই হিসাব-নিকাশও তারা করছে। নগরবাসীরও রয়েছে নানা দাবি প্রার্থীদের কাছে।
এক মেয়র প্রার্থী নগরবাসীকে আশ্বস্ত করে বলেন, হোল্ডিং ট্যাঙ যাতে বোঝা না হয় সেজন্য তা সহনীয় পর্যায়ে রাখা হবে। বাইশ মহল্লার কবরস্থানে সার্বিক উন্নয়নে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণেরও আশ্বাস দেন তিনি। প্রতিশ্রুতি দেন এই বলে যে জনগণ আমাকে চট্টগ্রামের মেয়র হিসেবে নির্বাচিত করলে হোল্ডিং ট্যাঙ বাড়ানো হবে না। এই চট্টগ্রামের মানুষের মাঝে আতঙ্ক আছে ক্ষোভ আছে, এটা নিয়ে আমি নিজেও আন্দোলন করেছি। এলাকার মানুষও আন্দোলন করেছে। হোল্ডিং ট্যাঙ আমি বাড়াব না। জনগণের উপর অসহনীয় কোনো হোল্ডিং ট্যাঙ ধার্য করা হবে না। আরেকটা আছে যেমন করোনাকালে দেখেছি মানুষ অসহায় হয়ে পড়েছে। বিপদ বলে কয়ে আসে না। মানুষ যাতে বিনামূল্যে স্বাস্থ্য সেবা পায় সেজন্য ৪১টা ওয়ার্ডে ৪১টা স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র গড়ে তুলব। মানুষ একটু শান্তি চায়। সন্ত্রাস ও মাদক পাড়ায় পাড়ায় খুঁটি গেড়ে বসেছে। এগুলো হল শতকরা পাঁচজন। ৯৫ জন লোক ভালো। তাদের নিয়ে চট্টগ্রামকে শতভাগ না পারলেও ৮০-৯০ ভাগ মাদক ও সন্ত্রাসমুক্ত নগরীতে পরিণত করব।
অন্যদিকে অপর প্রার্থী বলেন, গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা সমুন্নত রাখতেই চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আমরা অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু বিগত নির্বাচনগুলোতে ইভিএমের মাধ্যমে ভোটচুরির যে মহোৎসব দেখেছে তাতে ভোটারেরা আতঙ্কিত। তাই প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে হবে। অন্যথায় জনগণ ভোট কেন্দ্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। তিনি বলেন, মেয়র নির্বাচিত হলে চট্টগ্রামকে বিশ্বের কাছে অন্যতম পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ে তুলব। কর্ণফুলী নদীকে পরিবেশবান্ধব করে চট্টগ্রামকে হেলদি সিটিতে রূপান্তরিত করব। জনগণের পাশে থাকব এবং জনগণের পরামর্শ নিয়ে চট্টগ্রামকে জলাবদ্ধতামুক্ত নগর হিসেবে গড়ে তুলব।
নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রার্থীদের প্রতিশ্রুতিতে অনেক বড় বড় স্বপ্নের কথা রয়েছে। কিন্তু সেসব স্বপ্ন কতটা বাস্তবায়নযোগ্য তা ভেবে দেখা দরকার। তাঁরা বলেন, এখনই কোনো ধরনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া উচিত নয়। কেবল নগর ব্যবস্থাপনায় সুশাসন নিশ্চিত করা অঙ্গীকার থাকা উচিত। তাঁদের মতে, সিটি করপোরেশনের যে আইনি ও আর্থিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে তা বিবেচনায় রেখে ভোটারদেরও উচিত তাদের প্রত্যাশা লাগামহীন না করা।
নাগরিকদের অনেকের দাবি, ফুটপাত দখলদারমুক্ত করতে হবে, গণপরিবহন ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে। সুস্থ সুন্দর সবুজ নগরী গড়তে শহরের রাস্তা, খোলা জায়গা ও ভবনের ছাদে বনায়ন, এলাকাভিত্তিক পার্ক ও খেলার মাঠ নির্মাণ, কাঁচাবাজারে ভেজালমুক্ত পণ্য, জলাশয়-জলপথের অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ, প্রয়োজনমাফিক গণশৌচাগার, টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, মশক নিধনে নিরবচ্ছিন্ন কার্যক্রম, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তরুণদের অনুপ্রেরণা, অপরাধ ও মাদকের বিস্তার রোধে জনসচেতনতা তৈরি ও সৃজনশীল কার্যক্রম পরিচালনাসহ বিভিন্ন দাবি পূরণে আশ্বাস চেয়েছে তারা। বিশেষ করে বর্ষাকালীন জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের কথা।
তবে প্রার্থীদের নানা প্রতিশ্রুতি ও পরিকল্পনার বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য ভিন্ন। তাঁরা বলেন, ‘নির্বাচনের সময় মেয়র প্রার্থী ও কাউন্সিলররা নানা প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে কিছুই বাস্তবায়ন করেন না।’ তাঁরা বলেন, ‘পরিকল্পনা তো অনেকেই দেন, আগেও দিয়েছেন; কিন্তু বাস্তবায়ন হয় কি না, সেটাই দেখার বিষয়। কেবল পরিকল্পনার মধ্যে বসে থাকলে হবে না। যিনিই নির্বাচিত হোন, মানুষের সমস্যা নিয়ে কথা বলতে হবে, কাজ করতে হবে। নগরীর বিদ্যমান সমস্যা সমাধান করতে যাঁর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নযোগ্য মনে হবে, তাঁকেই অগ্রাধিকার দেয়া দরকার।’
নগরবিদেরা বলছেন, নির্বাচনের আগে প্রার্থীরা এমন অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকেন, যেগুলো সিটি করপোরেশনের এখতিয়ারের বাইরে। আবার এমন অনেক প্রতিশ্রুতি দেন, যেগুলোর বাস্তবায়ন সিটি করপোরেশনের একার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে যেসব প্রতিশ্রুতি সরাসরি সিটি করপোরেশনের বাস্তবায়নের কথা, সেগুলোতে বেশি গুরুত্বারোপ করা দরকার।