নির্বাচন : বিচিত্র ইতিহাস

এ. কে. এম. আবু বকর চৌধুরী | বুধবার , ১২ জুন, ২০২৪ at ৮:০৩ পূর্বাহ্ণ

১৪২ বছর আগে ১৮৮২র ১৩ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত কলকাতা কর্পোরেশন ও তার ১০ বছর পর ১৮৯২ সালে প্রাদেশিক আইন পরিষদ বেসরকারী আসনে সরাসরি নির্বাচন প্রথা চালু করে বৃটিশ সরকার। ১৯০৬র ১ অক্টোবর স্যার আগা খানের নেতৃত্বে ৩৫ সদস্য বিশিষ্ট এক মুসলিম প্রতিনিধি দল সিমলায় ভারতের বড়লাট লর্ড মিন্টোর কাছে উপস্থিত দাবীনামাসমূহের মধ্যে অন্যতম দাবী ছিল প্রদেশিক ও কেন্দ্রীয় আইন পরিষদে মুসলিমদের জন্য পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা (কোলকাতা / কেন্দ্রীয় বুদ্ধিজীবী / এম.আর. আখতার মুকুল / পৃ: ২৫৪)

১৯২৩ সালে দ্বরাজ পার্টির নেতা চিত্তরঞ্জন দাশের সাথে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মধ্যে স্বাক্ষরিত ঐতিহাসিক বেঙ্গল চুক্তিতে স্বীকৃত হয় যে, বাংলার মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে পৃথক নির্বাচনের প্রয়োজন, যাতে পরিষদে মুসলমানদের যথার্থ প্রতিনিধিত্ব থাকতে পারে (মেমোরিজ অব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী / মুহাম্মদ এইচ আর তালুকদার / পৃ: )

ছয় আনা ট্যাক্স প্রদানকারীদের পথ ধরে ১৮ বছরের যে কোন নরনারী ভোটাধিকার প্রয়োগের ভিত্তিতে বৃটিশ শাসনামল, পাকিস্তান আমল এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত অনেক প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় পরিষদের নির্বাচন হয়েছে। দুটি নির্বাচন ১৯৪৬ ও ১৯৭০ অনুষ্ঠিত নির্বাচন দু’টি মূলত দুটি পৃথক রাষ্ট্র তথা পাকিস্তান ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথ খুলে দেয়।

এই উপমহাদেশে প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন ১৮৮২র ১৩ ফেব্রুয়ারি (ভারতবর্ষে প্রথম ভোট / সরোজ ঘোষ / পরিবর্তন / পৃষ্ঠায় ৫৩৫৪ / ২৪৩০ নভে ৮৯)। এদিন বৃটিশ সরকারের বদান্যতায় ও ব্যবস্থাপনায় বাঙালিরা তথা উপমহাদেশেীয়রা প্রথম ভোটাধিকার প্রয়োগের স্বাধীনতা অর্জন করে। হয়তো তখনকার দিনে সভামিছিল, দেয়ালের লিখন, চিকা মারা, পোস্টারিং, প্রচারপত্র বিলি হয়নি, মাইকিং হয়নি, তবে সংবাদপত্রে ভোটের সংবাদ বেশ গুরুত্বের সাথে প্রকাশিত হত। পণ্ডিত দ্বারকা নাথ বিদ্যাভূষণ সম্পাদিত সাপ্তাহিক “সোমপ্রকাশ”এ “কলকাতার প্রথম ভোট পর্ব” শিরোনামে সংবাদ বের হয়।

ভোট প্রসঙ্গে কবি উকিল হেমান্দ্র বন্দোপাধ্যায় কয়েকটি ব্যঙ্গ কবিতাতে লিখেন “ছিলাম টেম্পল রাজা আচ্ছা মজা নিলে / ভোজং দিয়ে ভোটিং খুলে মিউনিসিপ্যাল বিলে। বলিহারি সুসভ্য কেতায় / ভেল্কিবাজি ইংরেজেরই হদ্দমজা হয়”।

১৮৮২র ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রথম যে নির্বাচন হয় তা ছিল কলকাতা কর্পোরেশনের। ১৮৬৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কর্পোরেশনের দায়িত্বভার জনগণের হাতে ছেড়ে দেয়ার লক্ষ্যে তিন ভাগের দুই ভাগ সদস্য জনগণের ভোটে নির্বাচিত হওয়ার পদ্ধতি চালু হয়।

ভোটার হলেন করদাতারা। ভোট কেন্দ্র ছিল হগ সাহেবের বাজারের কাছে এক প্রশস্ত হল ঘরে। সরাসরি পদ্ধতিতে ভোট প্রয়োগ হল। পোলিংপ্রিসাইডিং অফিসার, ব্যালট পেপার বক্স, বুথকালি ইত্যাদির কোন অবকাশ ছিল না। ভোট দাতা ও প্রার্থীরা মুখোমুখি বসেন। তাদের মাঝে কলকাতার পুলিশ কমিশনার স্যার স্টুয়ার্ট হগ, এর নামেই হগ বাজারটি প্রতিষ্ঠিত।

রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দেপাধ্যায় ও ঐতিহসাকি রজেন্দ্র লাল মিত্র প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ অন্যতম প্রার্থী ছিলেন। ভোটারদের মধ্যে কেশব চন্দ্র সেন, প্যারী চাঁদ মিত্র (১৮৫৮ সালে প্রকাশিত ‘আলালের ঘরে দুলাল’ নামক প্রথম সফল উপন্যাসের রচয়িতা) অন্যতম। প্রত্যেক ভোটারকে সরাসরি ডেকে তিনি কাকে ভোট দেবেন জিজ্ঞেস করা হয়। কেউ সরাসরি প্রার্থীর নাম, কেউ মুচকি হেসে বলেছিলেন আমি চাই খ্রীষ্টকে অর্থাৎ রেভারেন্ড কৃষ্ণ মোহনকে, কেউবা আকারেইঙ্গিতে। কবি হেমচন্দ্র লিখেছিলেন “আমার পছন্দ ওই খ্রীষ্টকে ভেকধারী/সাপোর্ট দিলাম ভোটে জিতি আর হারি।

১৮৯২ সালে প্রাদেশিক আইন পরিষদগুলোতে বেসরকারী আসনে সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়। এতে বিভিন্ন পদ্ধতি ছিল যেমন জমিদার, ব্যবসায়ী, বৃটিশের চামচা, বৃটিশ শাসন বিরোধী কিছু ব্যক্তিত্ব। ৪৩ বছর পর ১৯৩৫র ভারত শাসন আইনের অধীনে এই উপমহাদেশে ১৯৩৬র নভেম্বরডিসেম্বর বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর জন্য পৃথকভাবে নির্ধারিত আসনে অর্থাৎ পৃথক নির্বাচন ভিত্তিতে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৪৬ সালে মার্চে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনটি মূলতঃ ছিল ভারত ও পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র সৃষ্টির লক্ষ্যে। এরপর ১৯৫৪ হতে ২০২৪ সালে ১৬টি বিভিন্ন পদ্ধতিতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

১৯৫৪ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ১৬টি সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রামে আমার ছোট দাদা ইকবাল আলী চৌধুরীর পুত্র বৃটিশ আমলে চৌধুরী দারোগাখ্যাত খান বাহাদুর আব্দুল জব্বার চৌধুরী ১ম ও ২য় পুত্র, তিন নাতি, এক নাত বউ অর্থাৎ ৬ জনে ৪টি নির্বাচন (১৯৭০, ৭৩, ৮৮ফেব্রুয়ারি ও ৯৬ ফেব্রুয়ারি) ব্যতীত বাকী ১২টি ও ১টি সংরক্ষিত আসনের নির্বাচনে উভয় প্রার্থী হয়েছিলেন।

এরা হলেন ১) ফজলুল কবির চৌধুরী ২ বার (’৬২ ও ’৬৮ স্বতন্ত্র / বিরোধী দলের স্বতন্ত্র গ্রুপের নেতা ’৬২-’৬৫) ) ফজলুল কাদের চৌধুরী ৪ বার (’৫৪স্বতন্ত্র মুসলিম লীগ – ’৬২, ’৬৩ উপনির্বাচন ’৬৫মুসলিম লীগ)। ’৭০র নির্বাচনে তিনি হেরে যান। তাঁরা দুই ভাই ’৭১ অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন।

ফজলুল কাদের চৌধুরী দুই পুত্র ১) সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ৬ বার (’৭৯ মুসলিম লীগ, ’৮৬ জাপা, ’৯১ এনডিপি, ’৯৬ জুন, ০১ ও ০৮বিএনপি) ও ২) গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরী ২ বার (’৮৬জাপা ও ৯৬ জুনবিএনপি) এবং ফজলুল কবির চৌধুরী ৩য় পুত্র এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী আওয়ামী লীগ প্রার্থী হয়ে এ পর্যন্ত ৫ বার (’০৯, ’০৮, ’১৪, ’১৮ ও ’২৪) এবং তার বড় ভাই ফজলে রশীদ চৌধুরীর স্ত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক অধ্যাপক ড. সায়েমা রশীদ চৌধুরী সংরক্ষিত মহিলা আসনে জাপা মনোনীত ৩ বার (’১২, ’১৪ ও ’১৮) নির্বাচিত হন। এবার তার একমাত্র পুত্র ব্যারিষ্টার সানজিদ রশীদ চৌধুরী চট্টগ্রাম৯ আসনে জাপা মনোনীত প্রার্থী ছিল।

ফজলুল কাদের চৌধুরী পাকিস্তানের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট (৬৩৬৫), জাতীয় পরিষদের স্পিকার (’৬৩-’৬৫) ও শিক্ষাসহ ১৩টি দপ্তরের মন্ত্রী, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী মন্ত্রী (৮৫৮৮) ও প্রধানমন্ত্রী সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা (’০১-’০৬) ছিলেন ও ফজলে করিম চৌধুরী সভাপতি, রেলওয়ে সংসদ বিষয়ক কমিটির (’১৪-’২৪) দায়িত্ব পালন করেছেন।

চট্টগ্রাম হতে সাবেক মন্ত্রী (’৯৮-’০১) ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন আওয়ামীলীগ হয়ে ৭ বার (১৯৭০, ’৭৩, ’৮৬, ’৯৬ জুন উপনির্বাচন ’০৮, ’১৪, ’ ১৮, মন্ত্রী ৯৮০১/১৪১৮) বর্তমান বিরোধী দলের উপনেতা ’২৪ ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী (৮৯৯০) ব্যরিষ্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ৭ বার (৭৯বিএনপি, জাপার হয়ে ৮৬, ৮৮, ০৮, ১৪, ১৮ ও ২৪), সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রী কর্ণেল ড. অলি আহমদ বীর বিক্রম ৬ বার (’৮০ উপনির্বাচন, ’৯১ ও ৯৬ ফেব্রুয়ারি, ৯৬ জুন, ০১ ও ০৮), আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ও বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাসান মাহমুদ ৪ বার (০৮, ১৪, ১৮ ও ২৪) এবং দাদাপিতামেয়ে অর্থাৎ মুসলিম লীগ নেতা ক্যাপ্টেন এয়ার আলী খান ২ বার (১৯৪৬ ও ৬৫), তাঁর পুত্র আওয়ামীলীগের আতাউর রহমান খান কায়সার ১ বার (১৯৭০) ও তদীয় কন্যা অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়েশা খান সংরক্ষিত আসনে ৩ বার (১৪, ১৮ ও ২৪) নির্বাচিত হন।

লেখক : জীবন সদস্যবাংলা একাডেমি; সভাপতি (১৯৭২৯০)-শেখ মুজিব গণ পাঠাগার (গহিরা, রাউজান, চট্টগ্রাম) ও কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধনতুন শিক্ষাক্রমে নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতি